শোভন সাহা : পঞ্চগড় জেলা শহর থেকে ১৬ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে সদর উপজেলার অমরখানা ইউনিয়নে ঐতিহাসিক ভিতরগড় দুর্গনগরীর অবস্থান। ২৫বর্গ কিলোমিটার জায়গার উপর অবস্থিত ভিতরগড় প্রত্নস্থল বাংলাদেশে এ যাবৎ প্রাপ্ত প্রাচীন দুর্গনগরীগুলির মধ্যে সর্ববৃহৎ। স্থানীয় জনশ্রুতি মতে, ভিতরগড় ছিল মহারাজা পৃথু এর রাজধানী।

২০০৮ সালে ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশ (ইউল্যাব) এর অধ্যাপক ড. শাহনাজ হুসনে জাহান এর হাত ধরে শুরু হয় ভিতরগড় প্রত্নস্থলে প্রত্নতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের কাজ। উল্লেখ্য যে, এটাই পঞ্চগড় জেলার প্রথম প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখনন। চীনের প্রাচীরের যেমন উল্লেখযোগ্য ইতিহাস আছে তেমনি ভিতরগড়ের ইতিহাসও অনেক সমৃদ্ধ। তৎকালীন পৃথুরাজার বুদ্ধি বিবেচনা, চিন্তাধারা ও শিক্ষার কোন তুলনা হয় না। তিনি ছিলেন একজন মহান জ্ঞানী। প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের মাধ্যমে ইতিমধ্যে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় বেষ্টনীর মধ্যে মোট নয়টি ইট দিয়ে তৈরী স্থাপনার ভিত্তি কাঠামো আবিস্কার হয়েছে। পাশাপাশি লাল ও ধূসর রঙ্গের নকশা খচিত মৃৎপাত্রের ভগ্নাংশ এবং লোহা ও তামার তৈরী দ্রব্যাদি পাওয়া গেছে। মৃৎপাত্রের মধ্যে বেশীর ভাগই হলো- থালা, বাটি, রান্নার হাড়ি, তাওয়া ও মাটির প্রদীপ। ২০১৪ সাল পর্যন্ত নিয়মিত প্রত্নতাত্ত্বিক উৎখননের ফলে প্রাপ্ত নিদর্শন সমূহ উপরোক্ত কথাটি প্রমাণ করে। ড. শাহনাজ হুসনে জাহান তার গবেষণার আলোকে জানান “(১) সুনির্দিষ্ট গঠন বিন্যাসসহ দুর্গনগরীর সু-বিন্যস্ত নগর পরিকল্পনা, নিরাপদ ব্যবস্থা, বাণিজ্য, শিল্প কারখানা ইত্যাদি বাস্তবায়নের দিক বিবেচনায় ভিতরগড় অন্যতম; (২) ষষ্ঠ শতক হতে দ্বাদশ শতক পর্যন্ত ভিতরগড়ে সম্ভবত: একটি স্বাধীন রাজ্য হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল; (৩) চাষাবাদের জন্য সেচ ব্যবস্থা ও নদীর পানি নিয়ন্ত্রণের নিমিত্তে পাথরের বাঁধ নির্মাণের নৈপুন্য কৌশল ভিতরগড়ের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য; (৪) প্রাচীন বাণিজ্য সড়ক ও নদীপথের উপর অবস্থিত হওয়ায় ভিতরগড় এলাকার অধিবাসী সম্ভবত: নেপাল, ভুটান, সিকিম, আসাম, কোচবিহার, তিব্বত, চীন, বিহার এবং পশ্চিম ও দক্ষিণ বাংলার সঙ্গে বাণিজ্যিক ও সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বজায় রেখেছিল।” ভিতরগড় শুধু একটি সভ্যতার নিদর্শন নয়। এখানে রয়েছে একটি সভ্যতার নিচে আরেকটি সভ্যতা দেখা যায়। অতএব এই ভিতরগড় বহু সভ্যতার মিলনস্থল।

হিমালয় কন্যার কোলে অবস্থিত ভিতরগড় প্রত্নস্থল নি:সন্দেহে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক লীলা ভূমি। গ্রাম্য রূপের অপরূপ মোহনায় আজও মানুষকে মুগ্ধ করে এই স্থানের নানা সৌন্দর্য। ভিতরগড় প্রত্নস্থল আধুনিক সভ্যতার মাঝে প্রাচীন সভ্যতাকে উপস্থাপনের এবং পরিবেশ বান্ধব প্রত্ন-পর্যটনের এক উল্লেখ্যযোগ্য উদাহরণ হতে পারে শুধু একটু সুপরিকল্পনা ও উদ্যোগের মাধমে। এখানে আজও পথিক শালবনের মাঝে মেঠোপথ ধরে শালমারা নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে সূর্য উদয়ের উষ্ণতায় সূদর হিমালয়ের বিশালতা উপভোগ করে। এখানে কাঞ্চনজঙ্ঘার বিশুদ্ধতার প্রতীক দেখতে পাওয়া যায়। ভিতরগড়ের ১০টি প্রাচীন দীঘিতে এবং শালমারা ও তালমা নদীতে পান কৌড়ি, সাদা বকসহ বিভিন্ন ধরণের অতিথি পাখি পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

অত্যন্ত দু:খের বিষয় এই যে, ভিতরগড় দুর্গনগরীর অমূল্য প্রত্নসম্পদ ও এর অভ্যন্তরে অবস্থিত অসখ্য প্রাচীন স্থাপত্যিক নিদর্শন স্থানীয়ভাবে মানুষের হাতে দ্রুত বিলীন হবার পথে। ভিতরগড় প্রত্নস্থল প্রত্নতত্ত্বের এক বিশাল ভান্ডার হওয়া সত্ত্বেও ভিতরগড়কে রক্ষা করার জন্য সরকারের কোন পদক্ষেপ চোখে পড়ছে না। উপরন্তু ভিতরগড় প্রত্নস্থলকে এখনো পুরাকীর্তি আইনের আওতায় সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসাবে ঘোষণা দেওয়া হয়নি। ২০০৮ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত ভিতরগড়ে স্থানীয় অধিবাসীসহ এসোট প্লাস লিমিটেড, স্যালিলান টি এস্টেট, এসিআই গোদরেজ পোল্ট্রি ফার্ম ইত্যাদি কোম্পানীর দ্বারা ভিতরগড়ের প্রাচীন নিদর্শন ধ্বংস হয়। ক্রমাগত ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম পরিচালিত হলে। ড. শাহনাজ হুসনে জাহান এই সকল ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম তুলে ধরলে মানবাধিকার ও বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন ‘হিউম্যান রাইটস এন্ড পিস ফর বাংলাদেশ’ এর পক্ষে ভিতরগড় রক্ষার নির্দেশনা চেয়ে ২০১১ সালে ১৪ই জুন তারিখে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করেন এ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ। এই মর্মে ভিতরগড় দুর্গনগরীকে কেন প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা হিসাবে ঘোষণা দেওয়া হবে না জানতে চেয়ে একটি রুল জারি করা হয়। একই সংগে ভিতরগড় ও সোনারবান মৌজায় ২৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে অবস্থিত এই ঐতিহাসিক স্থাপনা সংরক্ষনে সব ধরণের নির্মাণ কাজ বন্ধ করে স্থিতাবস্থা বজায় রাখতে নির্দেশ দেয় আদালত। পাশাপাশি ভিতরগড় দুর্গনগরীর ২৫বর্গ কিলোমিটার এলাকায় সকল ধরণের ধ্বংসাত্মক কার্যক্রমের উপর নজরদারি করার জন্য স্থানীয় প্রশাসন তথা, পঞ্চগড় জেলার জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও সদর থানার ওসি কে নির্দেশ দেন আদালত।

কিন্তু হাইকোর্টের রুল অমান্য করে ভিতরগড় প্রত্নস্থলে ধ্বংসাত্মক কার্যক্রম অব্যাহত থাকে এবং সরকারীভাবে কোন পদক্ষেপ পরিলক্ষিত হয় না। আদালত অবমাননা করে ভিতরগড় প্রত্নস্থলে গড়ে উঠে মাজার, নতুন মসজিদ, ইটের তৈরী দোকানপাট, বসতবাড়ীসহ নানা ধরণের স্থায়ী ইমারত ও পারিবারিক কবরস্থান। এ বিষয়টি আদালতকে জানানো হলে ২৪শে জানুয়ারী ২০১২ সালে মাননীয় আদালত একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালককে ০৬ (ছয়) মাসের মধ্যে একটি প্রতিবেদন দাখিল করতে নির্দেশ দেন। কিন্তু ভিতরগড় রক্ষার জন্য কোন কর্মসূচী দেখা যায় না উপরন্তু আদালত অবমাননা অব্যাহত রয়েছে। এখনো প্রতিদিন গড়ে উঠছে নতুন নতুন স্থাপনা এবং প্রতিনিয়ত ভিতরগড় প্রত্নস্থলের বিভিন্ন স্থান থেকে পাথর উত্তোলনের মাধ্যমে প্রত্নতাত্ত্বিক এই সম্পদকে ক্ষতিগ্রস্থ করা হচ্ছে।

২০০৮ সাল থেকে ড. শাহনাজ হুসনে জাহান ভিতরগড় প্রত্নস্থলের অধিবাসীদের সচেতনতার জন্য নানা ধরণের কর্মসূচী পরিচালনা করছেন। কিন্তু বলা বাহুল্য যে, কাজীর গরু কেবল সাদা কাগজে থাকে, বাস্তবে এর চিত্র আলাদা। যেখানে শিক্ষিত সমাজ গড়ার অন্যতম কারীগর শিক্ষক সেখানে শিক্ষক সমাজও আদালত অবমাননা করে চলেছেন। উদাহরণ স্বরূপ শালমাড়া ভিতরগড় হাইস্কুল প্রাঙ্গণে গড়ে উঠেছে ইটের তৈরী শহীদ মিনার, শালমাড়া ভিতরগড় হাইস্কুলের সভাপতি গড়ে তোলেন ভিতরগড় প্রত্নস্থলের প্রাণ কেন্দ্রে ইটের তৈরী বাড়ী, মহারাজা জুনিয়র হাইস্কুলের পাশে ২০১২-১৩ সালে আবিস্কৃত একটি প্রাচীন স্থাপনার উপরে গড়ে উঠে চা বাগান। যেখানে শিক্ষক সম্প্রদায় এ ধরণের ধ্বংসাত্মক কাজে নিয়োজিত এবং ভিতরগড় রক্ষার নির্দশনার উদাহরণ সৃষ্টি করতে ব্যর্থ সেখানে সমাজের অন্যান্য শ্রেণীর মানুষদের উক্ত কার্যক্রম থেকে বিরত রাখা স্বাভাবিক ভাবেই অসম্ভব বলে প্রতীয়মান হয়।

প্রত্নতত্ত্ব এই বিশাল ভান্ডারকে বাঁচাতে ড. শাহনাজ হুসনে জাহান বিভিন্ন ধরণের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিহিংসার শিকার হইয়াছেন। অতএব ভিতরগড় প্রত্নস্থলকে প্রতিনিয়ত ধ্বংসের কবল হতে রক্ষা করে এবং প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব বিবেচনা করে সরকার অতি শীঘ্রই বেষ্টনী দেয়াল দ্বারা পরিবেষ্টিত ২৫ বর্গ কিলোমিটার এলাকাটি সামগ্রিক ভাবে ১৯৬৮ সালে (১৯৭৬ সালে সংশোধিত) পুরাকীর্তি আইনের আওতায় সংরক্ষিত পুরাকীর্তি হিসেবে ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্য রক্ষায় একটি যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে এই আমাদের প্রত্যাশা।

২০১৫ সালের ০৬ই মার্চ ভিতরগড়কে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী প্রত্নতাত্ত্বিক অঞ্চল হিসাবে আখ্যায়িত করা হবে এবং প্রতি বছর মার্চ মাসের ১ম শনিবার কে ভিতরগড় দিবস হিসাবে পালন করা হবে। অনুষ্ঠানটিতে সংস্কৃতিক মন্ত্রী আসাদুজ্জামান নুর সহ পঞ্চগড় ০১ আসনের এমপি নাজমুল হক প্রধান, সাবেক এমপি মজাহারুল হক প্রধান, ড. শাহনাজ হুসনে জাহান এবং সকল শ্রেণীর ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত হবেন।

ড. শাহনাজ হুসনে জাহান এবং এলাকার কিছু ব্যক্তিবর্গ এই অতীত সমৃদ্ধশীল সময়কে জানতে এবং রক্ষার্থে সার্বিকভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। এই বিশাল সম্পদকে বাঁচাতে তিনি দ্রুত সরকারের সুনির্দিষ্ট ও সুপরিকল্পনার পদক্ষেপের প্রতি আহ্বান করেছেন।

(এসএস/অ/জানুয়ারি ২৭, ২০১৫)