টাঙ্গাইল প্রতিনিধি : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, আজ সত্যিই আমি গর্বিত, বাংলাদেশের জন্য আজ একটি ঐতিহাসিক দিন। যে দেশের নারীরা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা দিয়েছেন সে দেশের নারীরা পিছিয়ে থাকবে না।  

আজ ২৯ জানুয়ারি প্রথম মহিলা মিলিটারি প্যারামেডিকস্ রিক্রুট ব্যাচের শপথ গ্রহণ ও প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণে এ কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী।

টাঙ্গাইলের ঘাটাইলে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজ ৮৭৯ জন নবীন মহিলা প্রশিক্ষণার্থী তাদের মৌলিক সামরিক প্রশিক্ষণ শেষে শপথ নিলেন। আমি সকল নবীন সৈনিককে জানাই আমার আন্তরিক শুভেচ্ছা ও প্রাণঢালা অভিনন্দন।

‘সমরে ও শান্তিতে রাখিব সুস্থ’ এ মন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে সেনাবাহিনী তথা জাতিকে সেবাদানের জন্য পেশাগত উৎকর্ষ, নিরলস পরিশ্রম এবং ত্যাগের মহান ব্রত নিয়ে নিজেদের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের যোগ্য অনুসারী হিসেবে গড়ে তুলতে নবীন সেনাদের আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।

সশস্ত্র বাহিনীকে একবিংশ শতাব্দীর পেশাদার চৌকস বাহিনী হিসেবে গড়ে তোলার জন্য সরকার ব্যাপক কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৯৬ সালে আর্মি মেডিক্যাল কোরে নারী অফিসারের পাশাপাশি অন্যান্য কোরেও নারী অফিসার নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয় তার সরকার। ২০০০ সালে এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন শুরু হয়।

বর্তমানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর বিভিন্ন আর্মস ও সার্ভিসে মহিলা অফিসাররা দেশে ও শান্তিরক্ষা মিশনে সুনামের সাথে দায়িত্ব পালন করছেন বলে উল্লেখ করেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ফোর্সেস গোল ২০৩০ বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় সেনাবাহিনীতে নারী অফিসারের পাশাপাশি নারী সৈনিক নিয়োগেরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীবলেন,সেনাবাহিনীর মত একটি চ্যালেঞ্জিং পেশায় নারীদের অংশগ্রহণ নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। সমাজের অর্ধেক জনসংখ্যাই নারী। নারীদের স্বতঃস্ফুর্ত অংশগ্রহণ ছাড়া কোন ক্ষেত্রেই পূর্ণাঙ্গ সাফল্য অর্জন সম্ভব নয়, আমরা জানি ক্রিমিয়ান যুদ্ধে ফ্লোরেন্স নাইটিংগেল এর সাহসী পদক্ষেপের মাধ্যমে নার্সিং সার্ভিসের পথচলা শুরু হয়েছিল। সেই নার্সিং সার্ভিস আজ পৃথিবীর সকল পেশাদার সেনাবাহিনীর অনিবার্য অংশ হিসেবে চিকিৎসাসেবা দিয়ে যাচ্ছে।

তিনি জানান, বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মেডিকেল সার্ভিস আরও বিস্তৃত, আধুনিক ও যুগোপযোগী করার লক্ষ্যে ২০১৩ সালের ১৮ই সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় আর্মি মেডিক্যাল কোর সেন্টার অ্যান্ড স্কুলকে ‘ডিপ্লোমা ইন মেডিক্যাল অ্যান্ড হেলথ টেকনোলজি’ পরিচালনার অনুমতি দেয়।

প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত নারী সৈনিকদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আজকের দিনটি আপনাদের জীবনে অত্যন্ত আনন্দের এবং খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর একজন গর্বিত সৈনিক হিসেবে আপনারা বৃহত্তর কর্মজীবনে প্রবেশ করতে যাচ্ছেন। আপনাদের উপর ন্যস্ত হচ্ছে দেশমাতৃকার মহান স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার পবিত্র দায়িত্ব।

এএমসি সেন্টার অ্যান্ড স্কুলে ডিপ্লোমা ইন মেডিকেল অ্যান্ড হেলথ টেকনোলজি স¤পন্ন করে সেনাবাহিনীর চিকিৎসাসেবায় এই সৈনিকরা বাংলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়বেন এই প্রত্যাশা ব্যক্ত করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সেবার মহান ব্রত নিয়ে আজ আপনারা যে শপথ গ্রহণ করলেন, তা আপনাদের আত্মত্যাগ, পেশাদারিত্ব ও দায়িত্বের প্রতি একাগ্রতার মাধ্যমে এবং দেশের আপামর জনসাধারণের চিকিৎসা সেবায় ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে বলে আমি আশাবাদী।

আপনারা নিঃস্বার্থভাবে দেশ ও জনগণের সেবা করবেন। আমার দো’য়া ও শুভ কামনা আপনাদের জন্য সবসময় থাকবে, বলেন শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, ইসলামের সেবার প্রথম এগিয়ে এসেছিলেন একজন নারী তিনি বিবি খাদিজা। প্রায় শত বছর আগে বেগম রোকেয়া বাঙালি মুসলিম নারী সমাজকে মুক্তির পথ দেখিয়েছিলেন। বেগম রোকেয়ার অবদান বাঙালি নারীর জন্য চিরকাল অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নারীদের উজ্জ্বল ভূমিকার কথাও স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, আমার মা বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব আগাগোড়া এই সংগ্রামে ধৈর্য ও সাহসিকতার পরিচয় দেন। সদা সর্বদা জাতির পিতার পাশে থেকে অনুপ্রেরণা দেন। প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও তিনি দমে যাননি।


প্রধানমন্ত্রী আরও স্মরণ করেন, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে সাহসী ও বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য বীরপ্রতীক খেতাবপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন ডা. সেতারা বেগম এবং তারামন বিবির কথা। তিনি বলেন, তারা আমাদের গর্ব ও অহঙ্কার। ৭১-এ নারীরা সশস্ত্র যুদ্ধে অংশ নিয়ে এবং খাদ্য ও আশ্রয় দিয়ে, অনুপ্রেরণা ও ত্যাগের যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছিলেন, তা ইতিহাসে অমর হয়ে থাকবে।

শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশের নারীরা আজ আর পিছিয়ে নেই। নিজেদের শ্রম, মেধা এবং দক্ষতা দিয়ে বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে নারীরা এগিয়ে চলছে সর্বক্ষেত্রে। ইতোমধ্যে নানা ধরনের চ্যালেঞ্জিং এবং দুঃসাহসিক কর্মসফলতার স্বাক্ষর রেখেছেন নারীরা।

এভারেস্ট জয়ী নিশাত মজুমদার, ওয়াসফিয়া নাজনীন, সামরিক বাহিনীতে কর্মরত ক্যাপ্টেন জান্নাতুল ফেরদৌস প্রথম মহিলা ছত্রীসেনা হওয়ার গৌরব অর্জন, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর ফ্লাইট লেফটেনেন্ট নাঈমা হক এবং ফ্লাইং অফিসার তামান্না-ই-লুৎফী প্রথম সামরিক বৈমানিক হওয়ার যোগ্যতা লাভের কথাও স্মরণ করেন প্রধানমন্ত্রী। এদের সবাইকে আন্তরিক অভিনন্দন জানান তিনি।

নবীন নারী সৈনিকদের উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রাথমিক প্রশিক্ষণ শেষ করে আজ আপনারা সেনাবাহিনীর গর্বিত সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হলেন। আপনাদের মনে রাখতে হবে আপনারা এদেশের জনগণের অবিচ্ছেদ্য অংশ।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুঃসময়ে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিপন্ন মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। আর্মি মেডিক্যাল কোর আর্ত-মানবতার সেবায় নিবেদিতপ্রাণ। যাঁদের সেবার প্রসার বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়েছে। জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা মিশনসহ বিভিন্ন বৈদেশিক মিশনে এ কোরের অফিসার ও সৈনিকরা নিঃস্বার্থ সেবা দিয়ে যাচ্ছেন।

বর্তমানে কঙ্গো, লাইবেরিয়া, আইভরিকোস্ট, পশ্চিম সাহারা ও কুয়েতসহ মোট ৫টি দেশে এই কোরের সদস্যগণ চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত আছেন বলেও বক্তব্যে উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।

তিনি বলেন, মানবতার সেবায় এই কোরের ফিল্ড ইউনিটগুলো বহিরাঙ্গণ অনুশীলনে বেসামরিক ব্যক্তিদের চিকিৎসাসেবা দিয়ে সেনাবাহিনীর ভাবমূর্তিকে আরও উজ্জ্বল করেছেন।


(আরকেপি/এসসি/জানুয়ারি ২৯, ২০১৫)