অরবিন্দ পাল অখিল : দেশটা উত্তপ্ত।আরও উত্তাপ বাড়ানোর চেষ্টা চলছে। রাজনীতির নামে কি ভ-ামিই না চলছে বাংলাদেশে। অবিবেচক রাজনীতিবিদদের কূটচালে সাধারণ মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। প্রতিদিনই কোন না কোন জায়গায় যানবাহনে পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দেয়া হচ্ছে, তাতে দগ্ধ হচ্ছে নিরীহ সাধারণ মানুষ। শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সী মানুষকে পুড়িয়ে ছারখার করছে নামধারী মানুষেরা। একটি প-িত সমাজ, আরো একটু বেশী করে বলা যায় সুশীল নামধারীরা এ ধ্বংসযজ্ঞকে অবিরাম সমর্থন দিয়ে যাচ্ছেন। হায়রে মানবতা, এ দেশের সবচেয়ে অহংকারী মানুষগুলোও যে একচোখা হয়ে গেছেন।  লক্ষ্য করলে স্পষ্ট বুঝা যায়, এ হত্যাযজ্ঞের প্রক্রিয়া ও প্রয়োগ আমদানী করা হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি অশান্ত দেশ ও তাদের লাগোয়া ইউরোপীয় দেশগুলো থেকে।

এ ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডে নিয়োজিত মানুষ নামধারীরা একটি রাজনৈতিক দলের সমর্থন নিয়ে তাদের কর্মকা-কে বৈধ করার অপপ্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। আবারও বলতে হয়, বাংলাদেশের সুশীল ধ্বজাধারীরা প্রগতি আর উন্নয়নের ধারাকে অস্বচ্ছ রেখে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় সরকারের সমালোচনায় মুখে ফেনা তুলে ফেলছে। অবাক করা ব্যাপার, তারা একবারও পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে মানুষ যারা মারছে তাদের কোন সমালোচনা করছে না। এতে তারা কোন অন্যায়ও দেখছেন না। যা প্রকারান্তরে পেট্রোল বোমাবাজদের সহায়তা করছে।

যেনো ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ । তারা কখনই সন্ত্রাসীদের কর্মকা-ের বিপক্ষে কথা বলছেন না।পরোক্ষভাবে তারা সন্ত্রাসীদের পক্ষাবলম্বন করছেন। ‘গণতন্ত্র গণতন্ত্র’ বলে মুখে ফেনা তোলা লোকগুলো কি একবারও ভাবছেন, যদি বর্তমান সরকারকে এভাবে টেনে হিচড়ে নামানো হয়(যদিও সম্ভব নয়) তবে জামায়াতী সরকারের আমলে (মূলত বিএনপি তার সৃষ্টি থেকে জামায়াতের ভাবধারাই বাস্তবায়ন করছে) কি এভাবে কথা বলার সাহস পাবেন? কিংবা মাহমুদুর রহমান মান্না, ড. কামাল হোসেনদের মত ব্যক্তিবর্গ কি কখনো আশা করেন, জামায়াতীরা তাদের সামনের সারিতে রাখবেন? তাদের সমালোচনা বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের শক্তিকে দুর্বল থেকে দুর্বলতর করবে।

হাসপাতালগুলোতে দগ্ধ মানুষের আহাজারিতে প্রতিদিনই পরিবেশ ভারি হয়ে উঠছে। গত ৮ ফেব্রুয়ারী পর্যন্ত পত্রিকার হিসেব অনুযায়ী (জনকন্ঠ, সকালের খবর, মানব কন্ঠ) ৭০ জনেরও বেশি মানুষের নির্মম মৃত্যু হয়েছে, শত শত লোককে পুড়িয়ে বার্ণ ইউনিটে রাখা হয়েছে। মৃত্যুর মিছিল হচ্ছে আরও লম্বা। ৯ শতাধিক যানবাহনে পেট্রোল বোমা দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে, রেলে চলছে নাশকতা।

কোন সংজ্ঞাতেই একে রাজনীতি বলা যাবে না। সহিংসতা দিয়ে আর কিছু না হোক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যায় না। কিন্তু আমাদের তথাকথিত রাজনীতিবিদদের কর্ণকুহরে তা প্রবেশ করছে না। ‘তথাকথিত’ বলা হল এজন্য যে জনমানুষের জন্য যে রাজনীতি তা কি তারা করছেন? আমাদের জেদি একগুয়ে আপোষহীন নেত্রী যেভাবে একটি ঘরে থেকে আর একটি মোবাইল ফোনের কল্যাণে একের পর এক মনুষ্যজীবন বিনষ্টকারী আন্দোলন করে যাচ্ছেন তা ইতিহাসে একটি কলংকজনক অধ্যায় হিসেবেই বিবেচিত হবে তা নিঃসন্দেহে বলা যায়।

প্রতিবারেই শীতকালটাই বেছে নেন আমাদের রাজনীতিবিদরা। এর কারণ স্যুট কোট, চাদর কেডস পড়ে মিটিং মিছিল করা যায়। অবশ্য এখন রাজনীতিবিদদের রাজনীতির ধরণ পাল্টেছে। এবার কোন রাজনৈতিক মিছিল মিটিং নেই, নেতা নেই কর্মী নেই এ আন্দোলনে। এ আন্দোলনে জনসম্পৃক্ততার কথা কেউ জোর গলায় বলতে পারবে না। কিছু সন্ত্রাসী আর দুর্বৃত্তরা যানবাহন আর মানুষ পুড়িয়ে আতংক সৃষ্টি করছে মাত্র।
জনগণের লাভ-লোকসানের তোয়াক্কা না করে তাদের ঘুটি হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। তাদের জিম্মি করে তারা তাদের ক্ষমতা দখলের সিঁড়ি খুঁজেন।যেনতেন ভাবে নির্বাচন করে কোন রকমে জয়লাভ করেই ব্যস্ত থাকেন লুটপাটে। আগে অবশ্য ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আর মেম্বারদের ‘গম চোর’ হিসেবে প্রচলিত একটি শব্দ ছিল। এখন আমাদের দেশে সংবিধান প্রনেতাদের বেলায়ও এমন কথাটি প্রচলিত হতে চলেছে। কেননা তারা যতটুকু না সংবিধান পড়েন, সংবিধান সম্পর্কে জানেন, ততটুকুই খবর রাখেন স্থানীয় সরকারের প্রতি খবরদারি করতে। এজন্য রাজনৈতিক দলগুলো রাজনৈতিক কর্মীদের চাইতে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা পোষা ক্যাডার রাখেন। টিআর, চল্লিশ দিনের কাবিখা কর্মসূচীর উপর বেশী দৃষ্টি রাখেন। বাংলাদেশের সর্বত্রই স্থানীয় সরকারের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের পার্সেন্টিজ নিয়ে রফা হয়।সেখানেও খবরদারি করেন তারা। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক নিয়োগের নামে ‘নিয়োগ বানিজ্য’ করে ব্যাংক একাউন্ট এর স্বাস্থ্যটাও বাড়িয়ে নেন এমন বিস্তর অভিযোগ রয়েছে। বস্তুত যে বিষয়টা এস্টাব্লিস্ট হচ্ছে, তারাও তাদের নামের পাশে চ্যায়ারম্যন মেম্বারদের মত নতুন বিশেষণের তকমা লাগিয়ে নিচ্ছেন। তাদের নামের শেষে বিশেষণটা লাগা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।

আমাদের আপোষহীন নেত্রী গো ধরে বসে আছেন তার রাজনৈতিক অফিসে। বাসায় থাকলে তাকে অবরোধ করা হলে তা রাজনীতিকরণের সুবিধা হবে না, তাই তিনি অবস্থান নিয়েছেন অফিসে । উদ্যোগ ভালো। ডিজিটাল দেশে ‘ডিজিটাল আন্দোলন’ এদেশবাসী দেখেছে, এখনও দেখছে। তার এক সিপাহশালার অফিস হাসপাতাল থেকে পালিয়ে পালিয়ে সাংবাদিক ডেকে বয়ান দিয়ে যাচ্ছিলেন। জনতার জন্য আন্দোলন করার তাগিদ দিয়েও কোন নেতা কর্মীকে জনতার সাথে দেখা যাচ্ছে না। যদি জনতাই তাদের আন্দোলনকে সমর্থন করতো তাহলে পলায়নপর নেতাদের ধরে এনে জনতাই সরকারের অবৈধ নির্বাচনের বিরুদ্ধে মধ্যবর্তী নির্বাচনের দাবি আদায় করে ছাড়তো।

জনগণ অশান্তিতে নেই। তারা ভালো ছিল এখন, অন্তত ২০১৩ সালের চেয়েও। এই ভালো থাকাটা আপনার কাছে ভালো লাগেনি, ভালো লাগলো না, তাই নিজে অবরুদ্ধ থেকে ডিজিটাল আদেশ দিয়ে নেতাকর্মীদের ১২টা বাজাচ্ছেন। আপনার নেতা কর্মীরা এক সময় বুঝতে পারবে আপনার এবং আপনার গুণধর ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসীদের বন্ধু জনগণের চাওয়াটাকে গুরুত্ব না দিয়ে ব্যক্তি স্বার্থে দেশে গোলযোগ করিয়ে যাচ্ছেন।তার ফসল- শতশত আগুনে পোড়া লাশ, অগ্নিদগ্ধ হাজারো মানুষের আর্তচিৎকার, যানবাহন ধ্বংস করে, পর্যটন খাতে কোটি টাকার ক্ষতি, রপ্তানী খাতে কোটি কোটি টাকা লোকসান। সবচেয়ে যে বিষয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তা হলো মানুষের ভেতর আতংক। একদিকে দুর্বৃত্ত আর অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর গুলির ভয়। মানুষ এখন শাঁখের করাতের উপর বসে আছে। এটা সত্য যে একটি বাংলাদেশবিরোধী দল ও তাদের পৃষ্টপোষক একটি বড় দল যতই তৃপ্তির ঢেকুর তুলুন না কেন এ আন্দোলনে জনতার সায় নেই। আর আন্দোলনে যদি জনতার সমর্থন না থাকে ওই আন্দোলন কোনদিন সফল হয় না।


লেখক:শিক্ষক ও সাংবাদিক।