মামুনুর রশীদ, নাটোর : নাটোরের গুরুদাসপুর ৫০ শয্যা হাসপাতালে টানা পাঁচ বছর ধরে জরুরী প্রসুতিসেবা বন্ধ রয়েছে। ফলে সিজারিয়ান অপারেশনসহ জটিল সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এই অঞ্চলের গর্ভবতী মায়েরা। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, প্রয়োজনীয় সকল সুবিধা থাকার পরও শুধুমাত্র গাইনী ও শিশু বিশেষজ্ঞ না থাকায় ওই সেবাটি চালু করা যাচ্ছে না।

এদিকে সরকারি হাসপাতালের ওই সেবাটি বন্ধ থাকায় শহরের প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতে বেশি টাকায় সেবা নিতে বাধ্য হচ্ছে ভুক্তভোগি রোগিরা। উচ্চবিত্ত পরিবারের মেয়েদের ক্লিনিকগুলোতে সেবা নেওয়া সম্ভব হলেও গরিব মানুষের পক্ষে তা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।
হাসপাতাল সুত্র জানায়,- ডাক্তার থাকার ফলে ইওসি কার্যক্রম চালুর এক বছরে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ১০০ জন গর্ভবতী মা সেবা পেত। কিন্তু ২০১০ সালের ৩ মে থেকে ডাক্তার না থাকার ফলে গর্ভবতী মায়েদের সিজারিয়ান অপারেশনসহ জটিল সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে এসব মায়েরা। তবে প্রশিক্ষিত দু’জন নার্সের তত্ত্বাবধানে গর্ভবতী মায়েদের সাধারণ ও প্রাথমিক সেবাগুলো দেওয়া গেলেও সিজারিয়ান অপারেশনসহ জটিল রোগিদের চিকিৎসা সেবা দেওয়া যাচ্ছে না।

প্রসূতি সেবা বিভাগের সিনিয়র নার্স আনজুমান আরা জানান, গর্ভবতী মায়েদের সিজারিয়ান অপারেশন বন্ধ থাকলেও হাসপাতাল থেকেই গড়ে প্রতিমাসে ৬০ জন গর্ভবতী মাকে এনটিনেটাল কেয়ার (এএনসি),ডায়লোটেশান এন্ড কেয়ার (ডিএন্ডসি) সহ প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দেওয়া হচ্ছে। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে- হাসপাতালের এ ধরনের সেবা পেতে ভুক্তভোগিদের নামমাত্র কিছু টাকা খরচ হলেও প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতে প্রতিটি সিজারিয়ান অপারেশন করতে খরচ হয় ছয় হাজার থেকে আট হাজার টাকা পর্যন্ত। গরিব মানুষের জন্য এতটাকা যোগান দেওয়া কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ে।

গুরুদাসপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজের শিক্ষক মাজেম আলী জানান, হাসপাতালে গর্ভবতী মায়েদের প্রজনন ও স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম চালু না থাকায় শহরের ছয়টি প্রাইভেট ক্লিনিকে সিজারিয়ান অপারেশন হচ্ছে। হাসপাতালের চিকিৎসকরাই সেখানে অপারেশন করছে।
স্থানীয় সাংবাদিক আবুল কালাম আজাদ জানান,গত ৩১ জানুয়ারী উপজেলার উত্তরনারী বাড়ি গ্রামের আয়ুব আলীর স্ত্রী বানেছা বিবি (৩৫) তৃতীয় সন্তান জন্ম দিতে হাসপাতলে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু সরকারি হাসপাতালে ভর্তি হয়েও সেবাবঞ্চিত হন। পরে শহরের একটি প্রাইভেট ক্লিনিকে সিজারিয়ান অপারেশন করতে গিয়ে তার মৃত্যু হয়। নবজাতককে মুমুর্ষাবস্থায় রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সরকারি হাসপাতালে সেবাটি চালু থাকলে এমন অকাল মৃত্যু হতো না।

এদিকে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আইয়ুব হোসেন জানান, শুরুতে গাইনী বিশেষজ্ঞ ডা. আফরোজা বেগমের তত্ত্বাবধানে প্রসূতি বিভাগের কার্যক্রম চালু ছিল। তিনিসহ এনেসথেসিয়া ডাক্তার বদলি নিয়ে যাওয়ার পর সেবাটি বন্ধ হয়ে যায়। অনেক চেস্টা তদবীরের পর গাইনী বিশেষজ্ঞ পদে ডা. জয়নব আক্তার ২০১৩ সালের ১৫ জুন যোগদান করেন। সেসময় এনেসথেসিয়া পদে ডাক্তার না থাকায় হাসপাতালটিতে প্রসুতি সেবা চালু করা যায়নি।। একারনে ২০১৪ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর গাইনী বিশেষজ্ঞ পদে ডা. জয়নব আক্তার বদলি নিয়ে চলে যাওয়ায় সেবাটি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। বর্তমানে ওই সেবার আওতায় গাইনী বিশেষজ্ঞ পদটি শূণ্য রয়েছে। শিশু বিশেষজ্ঞ পদে ডা. রবিউল হক যোগদান করলেও বর্তমানে নাটোর আধুনিক সদর হাসপাতালে ডেপুটেশনে রয়েছেন। এনেসথেসিয়া পদে ডা. আব্দুস সালাম যোগদান করলেও গাইনী বিশেষজ্ঞ না থাকায় তিনিও অলস বেতন নিচ্ছেন। আব্দুস সালামের দাবী, কাজ নেই, অলস বসে থাকা ছাড়া উপায় কি!

উপজেলা স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে আরো বলেন- পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিভিল সার্জনসহ, সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও উপজেলা স্বাস্থ্য সেবা উন্নয়ন কমিটিতে স্থানীয় সাংসদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়েছে। কিন্তু কাজ হচ্ছে না।
নাটোরের সিভিল সার্জন ডা. ফেরদৌস নীলুফা জানান, বছরের পর বছর ধরে চিঠি চলাচল হচ্ছে। তার পরও সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। বিষয়টি পুনরায় উর্ধ্বতন কর্তপক্ষকে অবহিত করা হবে।

স্থানীয় সংসদ সদস্য অধ্যাপক আবদুল কুদ্দুস জানান,- চলনবিলের মানুষের অবস্থা বিবেচনা করে হাসপাতালটি ৩১ থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়েছিল। কিন্তু ডাক্তার সংকটের কারণে সুফল পাচ্ছে না মানুষ। এটা দুঃখজনক। তিনি ব্যক্তিগতভাবে ডাক্তার সংকটের বিষয়টি সুরাহ করার উদ্যোগ নিয়েছেন বলে জানিয়েছেন।

উল্লেখ্য, গুরুদাসপুর হাসপাতালটি নাটোর-পাবনা ও সিরাজগঞ্জ জেলার সীমান্তে অবস্থিত। ভৌগলিক কারনে নাটোরের গুরুদাসপুর উপজেলা ছাড়াও বড়াইগ্রাম, সিংড়া, পাবনার চাটমোহর ও সিরাজগঞ্জের তাড়াশ উপজেলার (অংশ বিশেষ) মানুষ এই হাসপাতালের ওপর নির্ভরশীল। এসব উপজেলার গ্রামীণ গর্ভবতী মায়েদের প্রজনন ও স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার জন্য ২০০৯ সালের ২২ মে উপজেলা স্বাস্থ্যকমপ্লেক্সকে ৩০ শয্যা থেকে ৫০ শয্যায় উন্নীত করা হয়। সেই সাথে চালু করা হয় গর্ভবতী মায়েদের জন্য প্রজনন ও স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম। এজন্য সোয়া কোটি টাকা ব্যয় বরাদ্দে আধুনিক সুবিধার দ্বিতল ভবনের ইওসি ভবনও নির্মাণ করা হয়। সেবা নিশ্চিত করার জন্য গাইনী সার্জন ও এ্যানাসথেসিয়া ডাক্তার নিয়োগ দেওয়া হয়।

(এমআর/এএস/ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৫)