শিরিনা আফরোজ,  পিরোজপুর : মানবতা বিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত জাতীয়পর্টি থেকে দুই দুইবার নির্বচিত সাবেক এমপি আব্দুল জব্বার ইঞ্জিনিয়ারের রায়কে ঘিরে তার জন্মস্থান মঠবাড়িয়া উপজেলাসহ পিরোজপুরের সর্বত্র এক ধরনের উত্তেজনা বিরাজ করছে। এলাকার ক্ষত বয়ে বেড়ানো সেই পরিবার গুলো এবং মুক্তিযোদ্ধারা প্রহর গুণছেন সর্বোচ্চ রায় ফাঁসির দন্ডের অপেক্ষায়। আর এদিকে মঠবাড়িয়াসহ পিরোজপুরের সর্বত্র সতর্কতা মূলক ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।

এ ব্যপারে জেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার সমির কুমার বাচ্চু বলেন, আমরা আশা করি এই কুখ্যাত রাজাকারের সর্বোচ্চ শাস্তি হবে। আর এতেই ওই সব পরিবারের যারা বেঁচে আছেন তাদের সস্তি মিলবে।

পিরোজপুরের মঠবাড়িয়ার চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধী আবদুল জব্বার ইঞ্জিনিয়ার দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন গত ত্বত্তাবধায়ক সরকারের আমলে। জানা গেছে আমেরিকার ফ্লোরিডা শহরে আত্মগোপনে রয়েছেন। মহান মুক্তিযুদ্ধে তার নেতৃত্বে মঠবাড়িয়ায় গড়ে উঠেছিল সংঘবদ্ধ রাজাকার বাহিনী। মঠবাড়িয়ার সূর্যমণি গণহত্যা,ভীমনলী গ্রামের বাড়ইবাড়ি গণহত্যা ও মঠবাড়িয়ার আটজন মেধাবী ছাত্র হত্যাসহ ফুলঝুড়ি গ্রামে অগ্নিসংযোগ লুটপাট আর অসংখ্য হিন্দু বাঙালীকে দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য করার মত অপরাধে তিনি অভিযুক্ত।

আগামীকাল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধি জব্বার ইঞ্জিনিয়ারের রায় ঘোষণা করবে আদালত। মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী তিনি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পিরোজপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য দুইবার সংসদ নির্বাচিত হন। তবে ১৯৮৬ সালে তিনি ভোট ডাকাতির দায়ে এলাকার মানুষের কাছে বিতর্কিত হন। তার ভোট ডাকাতির প্রতিবাদের বিক্ষুব্ধ জনতা সেদিন ক্ষোভে উত্তাল হলে আইন শৃংখলা বাহিনীর গুলিতে চার জন নিহত হন। ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত ৯ম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি’র বিদ্রোহী প্রার্থী হিসাবে পিরোজপুর-৩ আসনে নির্বাচনে অংশ নিয়ে পরাজিত হন।


এরশাদ আমলে মূলত তার রাজনৈতিক আবির্ভাব ঘটে। এরপর তিনি এরশাদের আস্থাভাজন হিসেবে জাতীয় পার্টি (এরশাদ) কেন্দ্রীয় কমিটির সহ সভাপতিও নির্বাচিত হন। পরে বিএনপির রাজনীতির সাথে যুক্ত হলেও তিনি বিএনপিতে তেমন সুবিধা করতে পারেননি।।
১৯৭১ সালে সাবেক জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বারের নেতৃত্বে গড়ে উপকুলীয় মঠবাড়িয়া অঞ্চলে গড়ে উঠেছিল বিশাল এক রাজাকার বাহিনী। উপজেলার সাপলেজা ইউনিয়নের বলেশ্বর নদ তীরবর্তী ক্ষেতাছিড়ায় গ্রামে তার পৈত্রিক বাড়ি। তার নির্দেশে সাপলেজার তৎকালীন ইউপি চেয়ারম্যান নূর হোসে জমাদ্দার,টিকিকাটা ইউপি চেয়ারম্যান ইস্কান্দার আলী মৃধা, ইউপি সদস্য চাঁন মিয়া দর্জি,রুহুল আমীন মৃধা,আজিজ মল্লিক,আব্দুল হক,ইউপি সদস্য কাঞ্চন আলী,লালু খাঁ ও খলিল মাওলানা ওরফে হরিণ মাওলানা মিলে সহস্রাাধিক রাজাকার এলাকায় আলবদর ও রাজাকার বাহিনী গড়ে তোলে। এলাকায় হিন্দুদের ঘর বাড়ি লুটতরাজ,গণ হত্যা ও নারী নির্যাতন চালায়।


টিকিকটা ইউনিয়নের সূর্যমণি গ্রামের ২৪ হিন্দু বাঙালীকে গণহত্যার দায়ে ২০১১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর রাজাকার জব্বার ইঞ্জিনিয়ারসহ সাতজনকে অভিযুক্ত করে আদালতে একটি মামলা দায়ের করা হয়। ওই সময়ে সূর্যমণিতে রাজাকারদের গুলি খেয়ে বেঁচে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধা জ্ঞানেন্দ্র মিত্র (৬২) বাদী হয়ে মঠবাড়িয়া সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিষ্ট্রেট আদালতে মামলাটি দায়ের করেছিলেন। মামলায় জাতীয় পার্টির কেন্দ্রীয় ভাইস চেয়ারম্যান ও পিরোজপুর জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান মামলায় জাতীয়পার্টির কেন্দ্রীয় নেতা সাবেক সংসদ সদস্য এম, এ জব্বার ইঞ্জিনিয়ারকে প্রধান আসামী করে সাত জনের নামে মামলা করা হয়। এছাড়া মামলায় আরও ৬০/৬৫ জনকে অজ্ঞাত নামা আসামী করা হয়। ওই বছর বছর ২১ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুানালে মামলা স্থানান্তরিত হয়।
আদালতের তৎকালীন বিচারিক হাকিম মো. কবির উদ্দিন প্রামানিক মামলাটি গ্রহন করে ফৌজদারী কার্যবিধির ১৫৬ (৩) ধারায় তদন্ত পূর্ববক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহনের জন্য মঠবাড়িয়া থানার অফিসার ইনচার্জকে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহনের নির্দেশ দেন । পরে পুলিশ মামলাটি মানবতা বিরোধি অপরাধের বিচারের লক্ষে গঠিত ট্রাইব্যুনালের এখতিয়ারভূক্ত করতে সুপারীশ করে। এ কারনে মামলাটি ট্রাইব্যুনালে অন্তর্ভূক্ত হয়। পরে ট্রাইব্যুনালের তদন্তদল এ মামলার চার দফা তদন্ত সম্পন্ন করে।


খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে স্থানীয় শান্তি কমিটির (পিচ কমিটি অব পাকিস্তান) চেয়ারম্যান আবদুল জব্বার ইঞ্জিনিয়ারের নির্দেশে রাজাকার বাহিনীর কমান্ডার ইসকান্দার মৃধার নেতৃত্বে একদল রাজাকার বাহিনী দু’টি গণহত্যাসহ ৮ মেধাবী ছাত্র হত্যা, হিন্দু বাড়িতে লুটপাট, নারী নির্যাতন ও অগ্নি সংযোগ করে।


মামলার বাদী জ্ঞানেন্দ্র মিত্র জানান, জব্বার ইঞ্জিনিয়ারের নির্দেশে ইসকান্দার মৃধা (সাবেক টিকিকাটা ইউপি চেয়ারম্যান), মুকুল আহম্মেদ বাদশা, আনসার খলিফা, হাবিব হাওলাদার ও আলম মৃধার নেতৃত্বে ৬০/৬৫ জনের একটি রাজাকার বাহিনী ৭১’এর ৬ অক্টোবর রাত ১১ টার দিকে উপজেলার আঙ্গুলকাটা গ্রামের মিত্র বাড়ীতে চড়াও হয়ে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ব্যাপক লুটপাট চালায়। রাজাকার বাহিনী এ সময় এ বাড়ি থেকে ৩০ জনকে ধরে উপজেলার সূর্যমণি বেড়িবাঁধে নিয়ে হাত পেছনে বেঁধে দাড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। তখন ভাগ্যক্রমে ৬জন বেঁচে গেলেও শহীদ হন জিতেন্দ্র মিত্র, সুরেন্দ্র মিত্র, মুকুন্দ মিত্র, ফনিভূষন, পরিমল মিত্র, অরুন মিত্র, শৈলান মিত্র, ঝন্টু মিত্র, নিহার মিত্র, সুধীর মাস্টার, সুধাংশু হালদার, বিরাংশু হালদার, মধুসূদন, প্রিনাথ, অন্যধা হালদার, অনীল হালদার, নগেন কির্ত্তনিয়া, সত্যেন্দ্র রায়, হরেন মাঝি, হিমান্ত হালদার, সিতানাথ হালদার, জিতেন মৃধা, নিহার মিত্র, জিতেন মাঝিসহ ২৪ জন।

আঙ্গুলকাটা গ্রামের মুক্তিযোদ্ধা সন্তোষ মিত্র জানান, রাজাকার জব্বারের নেতৃত্বে পরিকল্পিতভাবে ১৯৭১ সালের মে মাসে উপজেলার সাপলেজা বাড়ই বাড়িতে আক্রমন চালায় সশস্ত্র রাজাকার বাহিনী । মুক্তিযোদ্ধারও সেদিন রাজাকারদের পাল্টা আক্রমণ করে তাদের প্রতিহত করার চেষ্টা করেন। সেদিনের সেই সম্মূখ যুদ্ধে রাজাকার লালু খাঁ মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হন। আর রাজাকারদের গুলিতে শহীদ হন ১৫ জন মুক্তিকামী বীর বাঙালী।

স্বাধীনতার পর শহীদ নিরেন্দ্র বিহারী বিশ্বাসের ছেলে জজ্ঞেস বিশ্বাস বাদী হয়ে ১৯৭২ সালে জব্বার ইঞ্জিনিয়ার, মুকুল বাদশা ও ইসকান্দার মৃধা সহ স্থানীয় দু’শতাধিক স্বাধীনতা বিরোধীর বিরুদ্ধে হত্যা, লুট, অগ্নিসংযোগ ও নির্যাতনের অভিযোগ মামলা করেন। একই সময় মেধাবী ছাত্র জিয়াউজ্জামানকে হত্যার অভিযোগে তার বাবা মতিউর রহমান বাদী হয়ে ওই অপরাধীদের বিরুদ্ধে আরও একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। কিন্তু ৭৫ পট পরিবর্তনের পর স্বাধীনতা বিরোধীদের উত্থানের মামলা দুটি ধামাচাপাসহ সকল নথিপত্র গায়েব হয়ে যায়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়,পিরোজপুর-৩ (মঠবাড়িয়া) আসনের সাবেক সংসদ সদস্য জাপার কেন্দ্রীয় নেতা ইঞ্জিনিয়ার আব্দুল জব্বার দেশ থেকে পালিয়ে আমেরিকায় অত্মগোপন করে আছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে উপজেলা জাতীয় পার্টির এক নেতা জানান, জব্বার ইঞ্জিনিয়ার বর্তমানে আমেরিকার ফ্লোরিডায় তার বড় মেয়ের বাসায় অবস্থান করছেন। সেখানে তার বড় ছেলে নাসিরউদ্দিনও থাকেন।


স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধা সুভাষ দেবনাথ বলেন, সেক্টর কমান্ডারস ঘোষিত ৫০ যুদ্ধাপরাধীর অন্যমত হলেন জব্বার ইঞ্জিনিয়ার। মঠবাড়িয়া জনপদের কলংক জব্বার রাজাকারের ফাসি হবে এমন আশা করছি।


জব্বারের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ :
জাতীয় র্পাটরি সাবকে ভাইস-চয়োরম্যান জব্বার ইঞ্জনিয়িাররে বিরুদ্ধে হত্যা, গণহত্যা, র্ধষণ, লুটপাট ও অগ্নসিংযোগসহ পাঁচটি মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচার হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েেছ স্বাধীনতা যুদ্ধরে সময় ৩ হাজার ৬০০ জনকে হত্যা, ২০০ হিন্দুকে জোরর্পূবক র্ধমান্তকরণসহ ৫৫৭টি বাড়ঘির লুট ও অগ্নসিংযোগ করার অপরাধ। তিনি একাত্তরে তৎকালীন পেিরাজপুর মহকুমার মঠবাড়য়িা থানা শান্তি কমটিরি ছিলেন।

প্রথম অভিযোগ : ইঞ্জনিয়িার জব্বার ১৯৭১ সালে মুক্তিযদ্ধের সময় পিরোজপুরের মঠবাড়য়িার ফুলঝুড়িতে দুইজন মুক্তেিযাদ্ধাকে হত্যা করেন। এছাড়া নাথপাড়া ও কুলুপাড়ার শতাধিক বাড়িতে লুট করেন এবং অগ্নসিংযোগ কর।

দ্বিতীয় অভিযোগ : মুক্তযিুদ্ধরে সময় জব্বার ফুলঝুড়িতে একজনকে হত্যা করেন এবং ৩৬০টি বাড়িঘরে লুটপাট চালান ও অগ্নসিংযোগ করনে।


তৃতীয় অভিযোগ : নলীতে ১১ জনকে হত্যা ছাড়াও ৬০টি বাড়রি মালামাল লুণ্ঠন করেন এবং অগ্নসিংযোগ করেন জব্বার।


চর্তুথ অভিযোগ : ফুলঝুড়িতে প্রায় দুইশ’ হিন্দু সম্প্রদায়ের লোককে জোরর্পূবক ধর্মান্তরিত করা।


পঞ্চম অভিযোগ : আঙ্গুলকাটা এবং মঠবাড়িয়া থেেক ৩৭ জনকে আটক, মালামাল লুণ্ঠন, অপহরণ, নির্যাতন, ১৫ জনকে গুরুতর জখম এবং ২২ জনকে হত্যা করেন জব্বার।

এদিকে এই রায়কে ঘিরে জব্বার ইঞ্জিনিয়ারে পক্ষে এলাকায় কোন ধরনের কার্যক্রম চোখে পড়েনি। এ বিষয়ে মঠবাড়িয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন মল্লিক বলেন, উপজেলার কেথাও কোন অপ্রীতিকর পরিস্থিতির খবর পাওয়া যায়নি। তার পরও এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনী সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে।

(এএস/ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৫)