কুষ্টিয়া প্রতিনিধি : কুষ্টিয়ার ছেঁউড়িয়ায় উদ্বোধন হলো ৫ দিনব্যাপী লালন স্মরণোৎসব। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন খুলনা বিভাগীয় কমিশনার আবদুস সামাদ। তিনি বলেছেন, বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ সকল ধর্মের সীমাবদ্ধতা ছাড়িয়ে সদা সত্য পথে চলতে মানুষকে মানবতাবাদীর পথে ডাক দিয়ে ছিলেন। তিনি অহিংস মানবতার ব্রত নিয়ে দেহতত্ব, ভাবতত্ব, গুরুত্বসহ অসংখ্য গান সৃষ্টি করে গেছেন। তাঁর এই অমর সৃষ্টি সঙ্গীত কোন ধর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না।

সকল ধর্মের উর্ধে থেকে সম্প্রীতির বাধনে আবদ্ধ করতে মরমী সাধক বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ মানব মুক্তির জন্য সৃষ্টি করেছিলেন ফকিরী মতবাদ। তাঁর মানব দর্শন আজ আর কুষ্টিয়ার কুমারখালির ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়ীর মধ্যে আবদ্ধ নেই। বুধবার রাতে বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহের ছেঁউড়িয়ার আখড়া বাড়িতে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসন ও লালন একাডেমির আয়োজনে বাউল সম্রাট লালন স্মরণোৎসব-২০১৫ অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী দিনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি আরো বলেন, লালন ফকিরের জাতহীন মানব দর্শন ও সঙ্গীত সার্বজনিন বিদিত বিশ্বাঙ্গনে। মানবতার ভাবধারাকে প্রতিষ্ঠিত করতে একটি অসাম্প্রদায়ীক সাম্যের সমাজ চেয়ে ছিলেন তিনি। লালন মানুষকে শিখিয়েছিলেন কোন ধর্মের মধ্যে আবদ্ধ থেকে সম্প্রীতি বজায় রাখা যায় না। সকল ধর্মের উপর মানব ধর্ম।

এই মরমী সাধকের প্রাতিষ্ঠানিক কোন শিক্ষা না থাকলেও তিনি ছিলেন আধুনিক সমাজ বিন্যাসে স্ব-শিক্ষিত। ধর্ম আর জাতি ভেদাভেদ ভুলে মানুষের কল্যাণে কি অসীম মর্মকথা বলেছেন তিনি। অনুষ্ঠানের শুরুতেই আগত অতিথিদের লালন একাডেমীর পক্ষ থেকে ফুলের তোড়া, ক্রেষ্ট উপহার দিয়ে বরণ করে নেওয়া হয়। এরপর অতিথিবৃন্দ লালন স্মরণোৎসবের স্মরণিকার মোড়ক উন্মোচন করেন। লালন একাডেমীর সভাপতি ও কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসক সৈয়দ বেলাল হোসেনের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন যশোর বিজিবির বিগ্রেডিয়ার জেনারেল দেওয়ান মো. শহীদুল ইসলাম, কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার প্রলয় চিসিম, জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা কে. এম রাহাতুল ইসলাম, অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. মুজিব-উল ফেরদৌস, রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদ কুষ্টিয়া জেলা শাখার সভাপতি আলম আরা জুঁই প্রমুখ।

অনুষ্ঠানে আলোচক হিসেবে লালনের জীবনাদর্শণ নিয়ে আলোচনা করেন, ঢাকা আইডিয়াল কলেজের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক অধ্যাপক রবীন্দ্র নাথ বিশ্বাস ও ফকির লালন শাহের মাজারের প্রধান খাদেম মহম্মদ আলী।

শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন কুমারখালী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শাহেলা আক্তার। স্বাগত বক্তব্য রাখেন লালন একাডেমীর ভারপ্রাপ্ত সাধারন সম্পাদক সেলিম হক। ৫ দিনব্যাপী এ অনুষ্ঠানের উদ্বোধনী দিনে লালন একাডেমী চত্বরে তিল ধারনের ঠাঁই ছিল না। বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ তাঁর জীবদ্দশায় দোল পূর্ণিমার তিথিতে স্মরণোৎসব পালন করতেন। আয়োজিত অনুষ্ঠানের মধ্যে রয়েছে কালী নদীর তীরে অবস্থিত উন্মুক্ত মঞ্চে প্রতিদিন লালন বিষয়ক আলোচনা, বিভিন্ন শিল্পী ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমন্বয়ে লালনগীতি পরিবেশন এবং আখড়া বাড়ির বিশাল এলাকা জুড়ে বসেছে লালন মেলা। মাজারের অভ্যন্তরে আয়না মহলে চলছে সাধু-ভক্তদের লালনগীতি পরিবেশন।

আলোচনা শেষে দ্বিতীয় পর্বে লালন মঞ্চে বিভিন্ন শিল্পি ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সমন্বয়ে পরিবেশিত হয় লালন সংগীত। এতে উদ্বোধনী প্রার্থনা সংগীত পরিবেশন শেষে দলীয় লালন সঙ্গীত পরিবেশন করেন লালন একাডেমীর শিল্পিরা। যেখানে সাঁইর বারামখানা,তিন পাগলে হলো হলো মেলা, সময় গেলে সাধন হবে না, মিলন হবে কতোদিনে এমনো বেশ কিছু লালনগীতি গেড়য়ে দর্শকদের আনন্দে মাতিয়ে রাখেন। গভীর রাত পর্যন্ত চলে এই সংগীত পরিবেশন। উৎসবকে ঘিরে পুরো একাডেমি চত্বরে খন্ড-খন্ড স্থানে গান পরিবেশনের সময় দর্শক-শ্রোতারাও নেচে-গেয়ে গানের সাথে সাথে তাল দেয়। দর্শক-শ্রোতারা কখনো পিন-পতন নীরবতায় গান শুনছেন আবার কখনো গানের তালের সাথে সাথে করতালি দিয়ে মুখর করে তুলছেন বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ’র আখড়াবাড়ির আঙ্গীনা। স্মরণোৎসব অনুষ্ঠানটি সার্বিক উপস্থাপনা খন্দকার লুৎফর রহমান।

(কেকে/এএস/মার্চ ০৫, ২০১৫)