বাগেরহাট প্রতিনিধি : রয়েল বেঙ্গল টাইগারের আবাসস্থল ওয়ার্ল্ড হ্যারিটেজ সুন্দরবনে এবার বাঘের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেক কমে আসার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। চলতি বছরের মার্চ মাস শেষে ‘ক্যামেরা ট্র্যাপ’ পদ্ধতিতে বাঘের ছবি সংগ্রহের জরিপ কাজ শেষ হবে। এরপর জুন মাসে এই জরিপের ফলাফল ঘোষণা করা হবে। তখনই সুন্দরবনে বাংলাদেশ অংশে প্রকৃত বাঘের সংখ্যা জানা যাবে। এই আধুনিক পদ্ধতিতে বাঘ গণনা জরিপে অংশে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন বাঘের সংখ্যা আগের তুলনায় অনেকাংশে কমে আসবে। শুধু গণনার পদ্ধতিগত কারণে নয়, প্রতিনিয়িত বাঘ হত্যার কারণেও বাঘের সংখ্যা কমছে বলে তাদের ধারনা।

বণ্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণের খুলনা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. জাহিদুল কবির বলেন,সুন্দরবনে ২০০৪ সালে বাঘের ‘পায়ের ছাপ’ হিসেবে গণনাটিকে কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি না থাকায় ওই জরিপটি পরবর্তীতে বিশ্বব্যাপী গ্রহণযোগ্য মনে করা হয়নি। পরবর্তীতে ভারত ‘ক্যামেরা ট্র্যাপ’ পদ্ধতিতে তাদের সুন্দরবন অংশে বাঘ গননা শুরু করে। ভারতের সুন্দরবন অংশে ‘ক্যামেরা ট্র্যাপ’ পদ্ধতিতে গণনা শেষ হয়েছে। ‘পায়ের ছাপ’ পদ্ধতিতে বাংলাদেশ অংশে যখন বাঘ ছিল ৪৪০ টি, তখন ভারত অংশে দেখা গেছে ২৭০টি। আর ‘ক্যামেরা ট্র্যাপ’ পদ্ধতিতে এখন ৭৬টি পাওয়া গেছে ভারতের সুন্দরবন অংশে। সে হিসেবে বাংলাদেশেও বাঘের সংখ্যা কমে আসা অস্বাভাবিক নয়। তবে বাংলাদেশে বাঘ হত্যার বিষয়টিও এড়িয়ে যাওয়া যায় না বলে তিনি মন্তব্য করেন।

বাঘ শুমারী বাস্তবায়নের অন্যতম বণ্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণের খুলনা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো. জাহিদুল কবির জানান, বাঘ গণনায় ব্যবহার করা হচ্ছে বিশেষ ধরনের ক্যামেরা। যা বাঘের চলাচলে এলাকা সনাক্ত করে গোপনে গাছে লাগিয়ে রাখা হয়। ক্যামেরার সামনে যা কিছুই নড়াচড়া করবে, স্বয়ংক্রিয়ভাবে তারই ছবি ধারণ করবে। ভারতে যে বিশেষজ্ঞরা গণনা করেছেন, বাংলাদেশেও গণনায় তাঁরা সহযোগিতা করছেন।

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও সুন্দরবন রিচার্স সেন্টারের চেয়ারম্যান সরদার সফিউল আলম বলেন, শুমারীর পদ্ধতিগত কারণেই শুধু নয়, প্রতিনিয়ত বাঘ হত্যার কারণেও বাঘের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। তবে ‘পায়ের ছাপ’ পদ্ধতির চেয়ে ‘ক্যামেরা ট্র্যাপ’ প্রদ্ধতির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি অনেক বেশি। তিনি বলেন, বাঘ এখন বিলুপ্ত প্রায় প্রাণী। এখনই বাঘ রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা নেয়া না হলে সুন্দরবনের বাঘ বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

বাগেরহাটের সুন্দরবন সন্নিহিত শরণখোলার সাউথখালি ইউনিয়নের কয়েকজন বনজীবী বলেন, সুন্দরবনের বিভিন্ন এলাকায় আগে বাঘ দেখা গেলেও এখন তেমন একটা দেখা যায় না। তারা বলেন, বনদস্যুরাও এখন বাঘ হত্যা করছে । বনদস্যুদের সম্পৃক্ত থাকার প্রমাণ পাওয়ার কথা বন কর্মকর্তা জাহিদুল কবিরও স্বীকার করেছেন।

পূর্ব সুন্দরবন বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (ডিএফও) মো: আমীর হোসেন চৌধুরী জানান, ২০০১ সাল থেকে এ পর্যন্ত পূর্ব সুন্দরবন এলাকায় চোরা শিকারীদের হত্যাকৃত ৯টি বাঘের চামড়া উদ্ধার করা হয়েছে। বন থেকে পাচার হয়ে যাওয়া বাঘের হিসেব পাওয়া যাচ্ছে না। চোরাশিকারীদের কাছ থেকে উদ্ধার হওয়া গুলোর হিসেব রাখা হচ্ছে। তবে বাঘ হত্যার ঘটনা যথেষ্ট উদ্বেগের বিষয় বলে মনে করেন তিনি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ৬ টি শিকারী দল বাঘ হত্যায় তৎপর রয়েছে। তারা সুযোগ পেলেই বাঘ হত্যা করে, অঙ্গ-প্রতঙ্গ বিভিন্ন দেশে পাচার করছে। সুন্দরবনের দু’বিভাগে শিকারীরা তৎপর। সম্প্রতি তিন মাসের ব্যবধানে র‌্যাব তিনটি বাঘের চামড়া সহ অঙ্গ-প্রতঙ্গ উদ্ধার করেছে। তবে এ পর্যন্ত শিকারীদের হাতে কতটি বাঘ মারা পড়েছে তার হিসেব সুন্দরবন বিভাগের কাছে নেই। তবে তাদের হিসেব অনুযায়ী, ১৯৮০ থেকে এ পর্যন্ত চোরা শিকারি ও বনদস্যুদের হামলা, গ্রামবাসীর পিটুনি ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে সুন্দরবনের ৭০টি বাঘের মৃত্যু হয়েছে।

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, তিন পরিস্থিতে বাঘ লোকালয়ে এসে হত্যার শিকার হয়। পূর্ব ও পশ্চিম বন বিভাগে বাঘ লোকালয়ে আসার ঘটনা ঘটে। প্রথমত, সে যে এলাকায় থাকে সে এলাকায় খাবারের অভাব। দ্বিতীয়ত, দুই আড়াই বছর বয়সে বাঘ তার মা কে ছেড়ে আলাদা হয়ে যায়। এসময় সে তার টেরিটোরি প্রতিষ্ঠা করার জন্য এলাকা খুঁজতে খুঁজতে বনের বাইরে আসতে পারে। তৃতীয়ত, বৃদ্ধ হয়ে গেলে বা অসুস্থ হলে বাঘ তার টেরিটোরি হারিয়ে ফেলে। আরেকটি বাঘ তার স্থান দখল করে নেয়। তখন সে সহজে খাবারের সন্ধানে লোকালয়ে চলে আসে।

বনবিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ প্রকল্প বিষয়ক আঞ্চলিক সহযোগিতায় ও বিশ্ব ব্যাংকের অর্থায়নে ২০১৩ সালে এ গণনা শুরু হয়। চলবে ২০১৫ সালের জুন পর্যন্ত। এ প্রকল্পে ব্যয় হবে প্রায় দুই কোটি ২৫ লাখ টাকা। বাঘ গণনার প্রথম ধাপ শেষ হয় ২০১৪ সালের এপ্রিলে। এসময় বাঘের ছবি ধারণের জন্য সুন্দরবনের বিভিন্ন স্থানে ৮৯টি স্বয়ংক্রিয় ক্যামেরা বসানো হয়েছিল। দ্বিতীয় ধাপে বাঘ গণনার জন্য ২০১৪ সালের ১১ নভেম্বর থেকে ৩০ জন মাঠকর্মী ৩৫টি স্পটে দুটি করে মোট ৭০টি ক্যামেরা বসানোর কাজ করেন।

বনবিভাগ সূত্রে আরো জানা যায়, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে সোয়া ছয় হাজার বর্গকিলোমিটারের মধ্যে ১৩ শ ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা নমুনা অংশ ধরে তিনটি ব্লকে ভাগ করে ‘ক্যামেরা ট্র্যাপ’ পদ্ধতিতে বাঘের ছবি সংগ্রহ করা হচ্ছে। প্রথম ধাপে ২০১৩ থেকে ২০১৪ সালের এপ্রিল পর্যন্ত দক্ষিণ-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পূর্ব ব্লকে সাতশো বর্গকিলোমিটার এলাকায় ‘ক্যামেরা ট্র্যাপে’র মাধ্যমে গণনা করা হয়। একই পদ্ধতিতে দ্বিতীয় ধাপে দক্ষিণ ব্লকে ৬৪০ বর্গকিলোমিটারে ছবি তোলা চলছে। মার্চের শেষে বন থেকে ক্যামেরা তুলে আনা হবে। জুন মাসে আনুষ্ঠানিক ভাবে ফলাফলা জানানো হবে।

সুন্দরবনে বাঘের জীবনচক্র :
চার বছর বয়স থেকে বাচ্চা দেয়া শুরু করে বাঘিনী। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার বছর বছর বাচ্চা দেয় না। দুই থেকে তিন বছরে একবার বাচ্চা দেয়। বাঘিণী তার জীবন চক্রে দুই থেকে তিন বার বাচ্চা দিতে পারে। গর্ভধারনের পর বাঘিণী ১০০ থেকে ১১০ দিনের মধ্যে দুই থেকে চারটি বাচ্চা দেয়। তবে গড় হিসাবে ধরা হয় ১০৩ দিন। বাচ্চা একাধারে ২ মাস মায়ের দুধ পান করে। দুই মাসের পর অন্যান্য খাবার খেতে শুরু করে এবং অল্প দুরত্বে মায়ের সাথে যাতায়াত করে। সাধারনত এক বছর পর্যন্ত— মায়ের সাথে বেশি দূরে বা শিকারে যায় না। এক বছরের পর মায়ের সাথে শিকারে যেতে শুরু করে এবং বিভিন্ন কলা কৌশল শেখে। দুই থেকে আড়াই বছরে মায়ের কাছ থেকে আলাদা হয়ে যায়। নিজরে টেরিটোরি প্রতিষ্ঠা করতে শুরু করে। টেরিটোরি প্রতিষ্ঠা করে জুটি খুজঁতে শুরু করে। সাড়ে তিন বছর বয়সের মধ্যে জুটি খুজেঁ নেয় বাঘ।

সুন্দরবনে বাঘের গড় আয়ু ১৫ থেকে ১৮ বছর। তবে চিড়িয়াখানায় বাঘ আরো বেশি দিন বাঁচতে পারে। ১২ বছর বয়স হলে সেই বাঘকে বৃদ্ধ বলে ধরা হয়। এরপর ধীরে ধীরে তার সক্ষমতা কমতে থাকে। তবে ১০ বছর বয়সের পর বাচ্চা দেয়ার ক্ষমতা থাকে না।

সুন্দরবনের বাঘের প্রিয় খাবার হরিণ। সম্প্রতি এক গবেষনায় দেখা গেছে, আগে আশি ভাগ ক্ষেত্রে হরিণ খেতো। এখন কোথাও কোথাও শুকোর খাওয়ার পরিমাণ বেশি। যেখানে পর্যাপ্ত খাবার আছে। যেখানে কেউ তাকে বিরক্ত করবে না অর্থাৎ নিরাপদ এলাকা বাঘ বসবাসের জন্য বেছে নেয়।

(একে/এএস/মার্চ ০৬, ২০১৫)