ঝিনাইদহ প্রতিনিধি : ‘জিন্দা দেহে মুরদার বসন, থাকতে কেন পরনা, মন তুমি মরার ভাব জান না, মরার আগে না মরিলে পরে কিছুই হবে না, আমি মরে দেখেছি, মরার বসন পরেছি, কয়েকদিন বেঁচে আছি, তোরা দেখবি যদি আয় পাগলা কানাই বলতেছি।’ এমন শত শত গানের শ্রষ্টা মরমী কবি পাগলা কানাই। মরমী এ কবি ঝিনাইদহের বেড়বাড়ি গ্রামে বাংলা ১২১৬ সালের ২৫ ফাল্গুন জন্মগ্রহণ করেন। আর ১২৯৬ সালের ২৮ আষাঢ় তিনি পরলোক গমন করেন।

ছোটবেলা থেকেই তিনি দূরন্ত স্বভাবের ছিলেন। বাল্যকালে পিতৃহারা পাগলা কানাইয়ের ঘরে মন না টেকাতে অর্থের অভাবে পড়ালেখা হয়নি। তিনি মানুষের বাড়ি রাখালের কাজ করেছেন। গরু চরাতে গিয়ে ধুয়ো জারি গান গাইতেন। নিরক্ষর হলেও তার স্মৃতি ও মেধা ছিল প্রখর। তিনি উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে গান রচনা করে নিজ কণ্ঠে পরিবেশন করতেন। তার মধ্যে বাউল ও কবিয়াল এ দু’য়ের যথার্থ মিলন ঘটেছে। পাগলাকানাইয়ের গান আজও গ্রামগঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। গ্রাম বাংলার এক অবিস্মরণীয় চারন কবির নাম কবি পাগলা কানাই। যাঁর নামানুসারে ঝিনাইদহ জেলা এক অসাধারণ পরিচিতি লাভ করেছে সমগ্র বাংলাদেশ জুড়ে।

কবি পাগলা কানাই এর সমাধিস্থল ঝিনাইদহ জেলা শহর থেকে সামান্য দূরে বেড়বাড়ী গ্রামে।আর বেড়বাড়ী গ্রাম থেকে জেলা শহর পর্যন্ত যে সড়ক সেই সড়কটি কবির সামানুসারে পরিচিতি পেয়েছে পাগলা কানাই সড়ক হিসাবে।হাজারো কবি সাধকের জন্ম যে বাংলাদেশে সেই বাংলাদেশের গর্ব লালন সাঁঈ-হাসন রাজা।তাঁদের রচনাসমগ্রের চেয়ে কোনো অংশেই কম নয় কবি পাগলা কানাই এর সৃষ্টি।কিন্তু উপযুক্ত পরিচর্যা সংরক্ষন এবং পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে সেভাবে কখনোই প্রচারে আসেনি এই অসাধারণ প্রতিভা।দিনে দিনে কবির স্মৃতিবিজড়িত বেড়বাড়ী গ্রামে একটা অডিটরিয়াম-একটা সংগ্রহশালা এবং কবির মাজার নির্মিত হলেও অযত্ন অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে তাঁর লেখা গানের ভান্ডারের একটা বড় অংশ। শুধুমাত্র প্রতিবছর বাংলা ২৫শে ফাল্গুন তারিখে কবির জন্মদিন উপলক্ষে নাম মাত্র কিছু কর্মসূচীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ মরমী কবি পাগলা কানাই এর স্মৃতি রক্ষার কাজ। সেই জন্ম বার্ষিকী উজ্জাপনেও রয়েছে একধরনের রাজনৈতিক প্রভাব ও প্রচারের কৌশল। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তখন সেই দলের লোকেরাই মূলত কবির স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদের হর্তাকর্তা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত থাকেন।

আর সেই কর্তাদের ইচ্ছানুযায়ীই পালিত হয় পাগলাকানাই জন্মজয়ন্তি। দিনে দিনে কমে যাচ্ছে বিভিন্ন শ্রেণীর শিল্পীদের আনাগোনা, কমে যাচ্ছে কবির লেখা গানের চর্চা। স্থানীয় কিছু তরুণ শিল্পীদের কন্ঠেই এখনো টিকে আছে কবি পাগলা কানাই এর অমর সৃষ্টির সামান্য কিছু গান। প্রকৃত বাউল ঘরানার শিল্পীদের দ্বারা যদি কবির গানের স্বরলিপি তৈরি করে ব্যাপকভাবে প্রচারের ব্যাবস্থা করা না হয়-তাহলে হয়ত একদিন অজানায় হারিয়ে যাবে কবি পাগলা কানাই এর অমর রচনাসমগ্র! অথচ-কবির স্মৃতি সংরক্ষণ পরিষদ শুধুমাত্র তাঁর জন্মবার্ষিকী পালনের মাধ্যেই সীমাবদ্ধ। অনেকের ধারনা- চারন কবি পাগলাকানাই যতদিন শুধুমাত্র বেড়বাড়ী গ্রামের গন্ডিতে বন্দি থাকবেন ততদিন পর্যন্ত কবির প্রতিভা সমগ্র বাংলাদেশের আনাচে কানাচে প্রচারিত হবার কোনো সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না!!কবি পাগলা কানাই এখন আওয়ামীলীগের দখলে আছেন-কয়েকবছর আগে ছিলেন বি এন পির দখলে হয়ত আগামীতে আবারও ঊনার দল বদল হবে! আফসোস-বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে কবি বেচারার জন্ম বার্ষিকির মঞ্চেও নেতার পরিবর্তন ঘটে!

বছরের ৩৬৫দিনের মধ্যে মাত্র ৩দিন আলোচনা সভা-লাঠিখেলা আর স্থানীয় শিল্পীদের গাওয়া পাগলাকানাই এর গান ও কবি গানের মধ্যেই সকল কর্মকান্ড সীমাবদ্ধ। বাকি ৩৬২দিন কবির মাজার সহ অডিটরিয়াম ও পাঠাগার থাকে তালাবদ্ধ-তাঁর লেখা গান ও কীর্তি প্রচার ও প্রসারের কোনো উদ্যোগ আছে বলে মনে হয় না। ব্যাপারটা এমন যে-উনার জন্মবার্ষিকী পালন একটা দ্বায়বদ্ধতার অংশ হিসাবেই পালিত হয়-কোনোমতে ২৫শে ফাল্গুন পার করতে পারলেই সকল দ্বায় দ্বায়িত্ব শেষ। তাই-উচিত কবি পাগলাকানাই কে মুক্তি দেয়া-সাধারনের মাঝে তাঁকে ছড়িয়ে দিয়ে অন্তত রাজনীতির প্যাঁচাপেচি থেকে দূরে রেখে প্রকৃত কানাইভক্ত বাউল ও শিল্পী শ্রেনীর হাতে তাঁর কর্মকান্ডকে তুলে দেয়া।তাহলে অন্তত কবি পাগলাকানাই এর অনুসারীগন তাদের হৃদয়ের আবেগ আর ভালবাসা দিয়ে কবির জন্মতিথী উদযাপন করতে পারবেন। সেখানে জৌলুস কম থাকলেও আন্তরিকতার অভাব থাকবে না। চর দখলের ন্যায় কবি পাগলাকানাইকে দলীয় আবরনে আবদ্ধ করে- এখন পর্যন্ত স্মৃতি সংরক্ষন পরিষদ গড়ে বড় বড় পদ আঁকড়ে থেকে শুধুই ব্যাক্তি ইমেজ বাড়ানো ছাড়া কবির স্মৃতিকে সংরক্ষনের কোনো প্রচেষ্টা সাধারনের নজরে আসেনি।

যে কারণে-২৫শে ফাল্গুন কবি পাগলা কানাই এর জন্মবার্ষিকী উজ্জাপন এখন অনেকটাই নিয়মরক্ষার কর্মসুচী হয়ে উঠেছে।মাত্র কয়েক বছর আগেও কবির জন্মতিথীতে হাজার হাজার নারী পুরুষ কবির মাজার প্রাঙ্গনে উপস্থিত হতো-যা এখন দুঃখজনক ভাবে কয়েকশোতে নেমে এসেছে। জেলা প্রশাসন এবং কবি ভক্তদের সেটা খেয়াল রেখে অতি দ্রুত কার্যকর ব্যাবস্থা নেয়া দরকার-তা না হলে হয়ত একদিন কবি পাগলা কানাইও রাজনীতির বলি হয়ে মানুষের মন থেকে হারিয়ে যাবে! যা আমাদের কারোরই কাম্য নয়!

(জেআরটি/এএস/মার্চ ১১, ২০১৫)