চৌধুরী আ. হান্নান : বিশ্বাস ও আস্থার উপর ভিত্তি করে ব্যাংক ব্যবস্থা আদিকাল থেকে চলে আসছে। এখনও গ্রামে গঞ্জে বিশ্বাসী লোকের কাছে সাধারণ মানুষ টাকা পয়সা, সোনা দানা গচ্ছিত রাখে। আর ধার দেয়ার ক্ষেত্রেও মানুষ বিশ্বাসীদের বেছে নেয়। মূলত টাকা জমা ও ধার দেয়া এ দু’টি প্রধান কাজ দিয়ে আদিকালে ব্যাংকিং শুরু হলেও বর্তমানে ব্যাংক হাজারো রকমের কাজ করে থাকে। এটা ব্যাংক ব্যবস্থার শত শত বছরের রূপান্তরিত রূপ।

ইউরোপে এক সময় একটি কথা ব্যাপক প্রচলিত ছিল। গভীর রাতে রাস্তায় কোন পথচারী দেখা গেলে মনে করা হতো সে হয়ত মাতাল, নয়তো ব্যাংকার। মাতালের তো দিন আর রাত একই। কিন্তু একজন ব্যাংকারের গভীর রাতে রাস্তায় কী কাজ? তাকে হিসেব মিলিয়ে অফিস ত্যাগ করতে হয়। এ কাজ সম্পন্ন করতে প্রায়ই রাত হয়ে যায়। দিনের সব কর্মকাণ্ড শেষে হিসেবের খাতা না মিলিয়ে যে তার অফিস ত্যাগের সুযোগ নেই। জনগণের টাকা বলে কথা।

সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকারদের মধ্যে এক আতংক বিরাজ করছে। তা গ্রাহক-ব্যবসায়ী ও ব্যাংকার উভয়ের জন্যই ব্যবসার স্বাভাবিক গতি ধরে রাখার জন্য অনুকূল নয়।

ব্যাংকে অনেক ক্ষেত্রে সাধারণ জ্ঞান ও উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে কাজ করতে হয়। সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ করতে গিয়েও ভুল হলে, আর্থিক ক্ষতি হলে প্রতিষ্ঠান দায় বহন করবে না, ব্যক্তিকে বহন করতে হবে। অনেক সময় গ্রাহক ব্যাংকার সম্পর্কের উপর ভিত্তি করে কাজ সম্পন্ন করতে হয়। যারা ব্যাংকে বেশি টাকা জমা রাখে তাদের জন্য মুনাফার হার বেশি। আর যারা সমাজে প্রতিষ্ঠিত ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে তাদের সহজ হয়। তেলা মাথায় তেল আর কি!

অপাত্রে ঋণ দিয়ে এবং বেনামি ঋণের মাধ্যমে সরকারি ব্যাংকের কোটি কোটি টাকা ভাগ-বাটোয়ারার খবর আমরা কিছুটা জানতে পারছি। জালিয়াতি দুর্নীতির ঘটনা জনগণ অল্পই জানতে পারে কারণ এ সকল ঘটনা গোপন রাখার চেষ্টা প্রবল। অনিয়ম- দুর্নীতি যখন সীমা লংঘন করে তখনই তা খবর হয়-পত্রিকায় আসে। সাম্প্রতিক উদাহরণ-বেসিক ব্যাংক। রাষ্ট্র মালিকানাধীন বেসিক ব্যাংক থেকে একের পর এক ঋণ অনিয়মের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা লুটপাটের কাহিনী জন সম্মুখে আসছে। প্রায় সকল ক্ষেত্রেই সর্বোচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনায় আর্থিক দুর্নীতি হয়েছে। বিশ্বাস করতে অসুবিধা হয় না যে –যারা নির্দেশদাতা তারাই উপকার ভোগী। সরকারি ব্যাংক যেন মামা ভাগ্নের দখলে চলে যাচ্ছে। অর্থমন্ত্রী বলেছেন- এসব জালিয়াতির বিরুদ্ধে অচিরেই ব্যবস্থা নেয়া হবে। ব্যবস্থা-বিচার শাস্তি কার বিরুদ্ধে? নির্দেশদাতা-মদদদাতা নাকি পরিচালনা পরিষদের বিরুদ্ধে? তা কখনো হতে দেখা যায় না। সোনালী ব্যাংকে দেশ কাঁপানো ‘হলমার্ক কেলেংকারীর’ ব্যাপারে ও ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদকে দায়ী করা হয়নি। যদিও তাদের মধ্যে কেউ কেউ ব্যাংক থেকে বের করে নেয়া টাকার সুবিধাভোগী বলে জনমনে বিশ্বাস রয়েছে। কিন্তু তারা দায়ী হয় না কারণ যাদের টাকা আছে, ক্ষমতা আছে, আইন তাদের পক্ষে কথা বলে। ব্যাংকের শাখা পর্যায়ে যারা কাজ করে, উপরের নির্দেশ যারা পরিপালন করে তাদের শাস্তি দেয়া খুবই সহজ। তারা নন্দঘোষ।

পরিচালনা পরিষদের একজন সদস্য এ.কে.এম. রেজাউর রহমান বিবেকের তাড়নায় সাহসিকাতার সাথে বেসিক ব্যাংকের অনিয়মের কিছুটা চিত্র গত বছর সরকারকে জানিয়েছিলেন। এ জন্য তাঁকে পুরস্কৃত করা হয়েছে কিনা তা জানা যায়নি। তবে সময় মতো সতর্ক হলে, প্রতিকারের ব্যবস্থা নিলে বেসিক ব্যাংকে ‘পুকুর চুরি’ ঠেকানো যেত।

পরিচালনা পরিষদ, বাংলাদেশ ব্যাংক ও অর্থমন্ত্রনালয়ের নির্দেশে ব্যাংক কাজ করে থাকে। তারা নিয়ন্ত্রনকারী কর্তৃপকক্ষ। কিন্তু সরকারী ব্যাংকের অভিভাবকের শেষ নেই। মন্ত্রী, আমলা, এমপি, সমাজের প্রভাবশালী ব্যাক্ত সকলকেই তার সন্তষ্ট করে চলতে হয়। কাউকেই যেন সে ‘না’ বলতে পারে না। সরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তারা ধীরে ধীরে যেন মেরুদণ্ডহীন এক বিপন্ন প্রাণীতে পরিণত হচ্ছে। ফলে দুর্বল ব্যবস্থাপণার কারণে শত শত কোটি টাকা প্রকৃত ব্যবসায়ীর পরিবর্তে কেবল অপাত্রেই চলে যাচ্ছে না, জালিয়াতি ও সংঘটিত হচ্ছে ব্যাপক।

সরকারি ব্যাংক বহু কেলেংকারীতে জর্জরিত, দুর্বৃত্ত দ্বারা আক্রান্ত। নানা ফন্দি ফিকিরের মাধ্যমে শত শত কোটি টাকা ব্যাংক থেকে বের হয়ে মুদ্রা বাজারে প্রবেশ করছে। দ্রব্যমুল্যে চাপ পড়ছে। অস্ত্র, মাদক ইত্যাদি অবৈধ ব্যবসা গতিশীল হচ্ছে। সামাজিক অস্থিরতা বৃদ্ধিতে এ অর্থ প্রভাব ফেলছে। তারা অবৈধ ব্যবসায় বিনিয়োগকারী কিন্তু ধরা ছোঁয়ার বাইরে। এ অতিরিক্ত অর্থে সৃষ্ট সামাজিক অস্থিরতার জ্বালা নিত্য ভোগ করছে প্রতিটি নাগরিক।

লেখক: সাবেক ব্যাংকার