মেহেরপুর থেকে তোজাম্মেল আযম : স্বাধীনতা পূর্ব পশ্চাদপদ একটি সীমান্ত গ্রাম মেহেরপুরের বাগোয়ান ইউনিয়নের বৈদ্যনাথতলা। ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রথম সরকার বৈদ্যনাথতলা গ্রামের আম্রকাননে শপথ গ্রহণ করার পর বিখ্যাত হয়ে পড়ে গ্রামটি।

বাংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ গ্রহণের দিনটি বৈদ্যনাথতলাকে মুজিবনগর নামকরণ করা হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুজিবনগরকে মূল্যায়ন করার লিখিত নির্দেশ দেন। সেই শুরু গ্রামের সামগ্রিক চিত্র অবস্থা বদলে যাবার। এখন ওই গ্রামে দেশী বিদেশী পর্যটকের ভিড়ে মুখরিত। গ্রামটিতে হয়েছে একটি হাসপাতাল, আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় পুলিশ ক্যাম্প ও থানা। হয়েছে মুজিবনগর থেকে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলার সাথে পিচঢালা সড়ক যোগাযোগ। যে স্থানে বংলাদেশের প্রথম সরকার শপথ নিয়েছিল সেখানে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ ও পাশেই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রকল্প। যেখানে এক নজরে বাংলাদেশটাকে দেখা যায় মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ মানচিত্রে। বর্তমানে বদলে গেছে গ্রামের মানুষের আর্থ সামাজিক অবস্থা। বাংলাদেশের প্রথম সরকারকে সেদিন গার্ড অব অনার দিয়ে ইতিহাসের প্রত্যক্ষ সাক্ষি হয়ে যাওয়া সেই ১২ আনসার সদস্য পেয়েছে রাষ্ট্রিয় স্বীকৃতি, পেয়েছে বসবাসের জমি ও পাচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা মাসিক ভাতা।
স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মুজিবনগরকে মূল্যায়নের লিখিত নির্দেশ দেবার পর সেখানে নির্মিত হয়েছে মুজিবনগর স্মৃতিসৌধ, পরবর্তীতে ৪৩ একর জমি অধিগ্রহণ করে সেখানে নির্মিত হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বাংলাদেশ মানচিত্র। মুজিবনগরকে করা হয়েছে উপজেলা। সেখানে আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় ২০১০ সালে একটি থানা ও একটি পুলিশ ক্যাম্প করা হয়েছে। এছাড়া মুজিবনগর ডিগ্রী কলেজকে করা হয়েছে সরকারি করণ, যোগাযোগ ব্যবস্থায় হয়েছে পিচঢালা প্রসস্থ সড়ক। গোপালনগর, রতনপুর ও মোনাখালী গ্রামে ভৈরব নদের ওপর ব্রিজ। ঢাকাসহ সারাদেশের সাথে সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থায় কারণে এলাকার মানুষের আর্থ সামাজিক উন্নতি হয়েছে। মুজিবনগরকে ঘিরে জেলাবাসীর এখন একটাই দাবি মুজিবনগর প্রকল্পের আওতায় স্থল বন্দর। যা মেহেরপুরকে বানিজ্যিক জেলাতে রূপান্তর করা যাবে।
মেহেরপুরের জেলা প্রশাসক মাহমুদ হোসেন জানান মুজিবনগর উপজেলার উন্নয়নে সরকার বদ্ধ পরিকর। এপর্যন্ত থানা ভবন, উপজেলা ভবন, সড়কের উন্নয়ন, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। জেলাবাসীর দাবীর কারণে মুজিবনগর কেন্দ্রিক স্থলবন্দর দাবিটি বাস্তবায়নে ভারতের সাথে রাষ্ট্রিয় পর্যায়ে কুটনৈতিক আলোচনা চলছে।
মেহেরপুর গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আহসান উল্লাহ জানান শতকোটি টাকা ব্যয়ে মুক্তিযুদ্ধের সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে মুজিবনগরে। এই মুজিবনগরের কারণেই মেহেরপুরের মানুষ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধের সুফল পাচ্ছে।
মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রী, আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন বাংলাদেশের প্রথম সরকারের শপথ গ্রহণের স্থান, ঐতিহাসিক ঘটনা প্রবাহের স্মৃতি, মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনা সমৃদ্ধ তথ্য নিদর্শন দেশবাসী তথা ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এবং বিদেশীদের কাছে মূর্ত করে তোলা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ মানচিত্র গড়ে ও ভাস্কর্যে। এছাড়া মুজিবনগরের উন্নয়নে এই সরকার কাজ করছে। আগামী দিনে মুজিবনগরকে বাংলাদেশের একটি মডেল জেলায় রূপান্তর করার পরিকল্পনা আছে।
নির্মিত গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ও তার অবস্থা
শত কোটি টাকা ব্যয়ে এখানে নানা অবকাঠামো উন্নয়নসহ মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক স্মৃতি মানচিত্র ও জাদুঘর নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়াও এখানে কিছু বহুতল আধুনিক ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। যেমন, পর্যটন মন্ত্রনালয়ের অর্থায়নে পর্যটন মটেল ও শপিং মল, সমাজসেবা মন্ত্রনালয়ের অর্থায়নে শিশু পল্লী, ধর্ম মন্ত্রানালয়ের অর্থায়নে মসজিদ, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রনালয়ের অর্থায়নে পোস্ট অফিস ও টেলিফোন অফিস, স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়ের অর্থায়নে আভ্যন্তরীন রাস্তা ও হেলিপ্যাড, এবং বনও পরিবেশ মন্ত্রনালয়ের অর্থায়নে ৬ দফা ভিত্তিক গোলাপ বাগান নির্মাণ করা হয়েছে। টেলিফোন একচেঞ্জ ও শিশুপল্লী। কোটি টাকা ব্যয়ে ৬ দফা ভিত্তিক মনোরম গোলাপ বাগান।
নির্মিত মানচিত্র ও জাদুঘরে যা কিছু আছে
এখানে নির্মিত সবুজ বুকের উপর উঠে এসেছে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক বাংলাদেশের স্মৃতি মানচিত্র। মানচিত্রের বুকে মুক্তিযুদ্ধের ১১ টি সেক্টরকে দেখানো হয়েছে। তার মধ্যে তুলে ধরা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে দেশের বেনাপোল, বনগাঁও, বিরল, নেত্রকোনা সহ বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে ভারতের উদ্দেশ্যে শরণার্থী গমন, হার্ডিঞ্জ ব্রীজ ধ্বংস, আসম আব্দুর রবের পতাকা উত্তোলন, শাহজাহান সিরাজের ইশতেহার পাঠ, শালদাহ নদীতে পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের সন্মুখ যুদ্ধ, কাদেরীয়া বাহিনীর জাহাজ দখল ও যুদ্ধ, পাক বাহিনীর সাথে কামালপুর, কুষ্টিয়া ও মীরপুরের সন্মুখ যুদ্ধ, শুভপুর ব্রীজের দুপাড়ের মুখোমুখি যুদ্ধ, চালনা ও চট্টগ্রাম বন্দর ধ্বংস, পাহাড়তলী ও রাজশাহীতে পাক বাহিনীর হত্যাযঞ্জ, জাতীয় শহীদ মিনার ধ্বংস, জাতীয় প্রেসক্লাবে হামলা, সচিবালয়ে আক্রমন, রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও জগন্নাথ হলের ধ্বংসযজ্ঞ, তৎকালীন ইপিআর পিলখানায় আক্রমন, রায়ের বাজার বধ্যভূমি, বুদ্ধিজীবী হত্যা।
মানচিত্রের চর্তুদিকে স্বাধীনতা যুদ্ধে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ব্যাক্তিদের সাহসী নের্তৃত্ব এবং ভূমিকার ছবিসহ ৪০ টি ভাস্কর্য্য শিল্প কর্ম নির্মাণ করা হয়েছে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের মধ্যে তৎকালীন সেনাপ্রধান, উপপ্রধান, বীর উত্তমদের, জাতীয় চার নেতার, তারামন বিবি, সেতারা বেগমের মূর্তমান ছবিসহ ব্রঞ্চের তৈরি ২৯ টি অবক্ষ ভাস্কর, জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ৩০ নেতার তৈলচিত্র রয়েছে। যা কিছু দেখলে বুঝা যাবে মুক্তিযুদ্ধে পাক বাহিনীর বর্বরতা, মুক্তিযোদ্ধাদের সাহসী অবদান ও জীবনবাজি এবং মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন নেতাদের দেশপ্রেম।
বর্হিরাংশে যা আছে
মানচিত্রের বাইরে বড় ম্যুরালে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, ২৫ মার্চের কালো রাত্রির হত্যাযজ্ঞ, পাক বাহিনীর হাতে নারী নির্যাতন ও সম্ভ্রমহানী, মুক্তিযোদ্ধাদের বাড়িতে অগ্নি সংযোগ, ৭১ এর ১৭ এপ্রিল এই মুজিব নগরে দেশের প্রথম সরকারের শপথ ও সালাম গ্রহণ, মেহেরপুরের স্থানীয় ১২ আনসার সদস্য কর্তৃক প্রথম সরকার প্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ সরকার প্রধানদের গার্ড অব অনার প্রদান, সিলেটের তেলিয়াপাড়ায় ১১ জন সেক্টর কমান্ডারদের গোপন বৈঠক, মুক্তিযুদ্ধে সেক্টর কমান্ডারদের সেক্টর বন্টন সভা ছাড়াও অরোরা নিয়াজী ও একে খন্দকারের উপস্থিতিতে পাক বাহিনীর আত্মসর্মপণের চিত্র নির্মিত ভাস্কর্যে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।
(টিএ/এএস/মে ১২, ২০১৪)