আন্তর্জাতিক ডেস্ক : অপরাধ নয়, অসুখ। শাস্তির নামে অত্যাচার নয়, দরকার চিকিৎসা। মাদকাসক্তি প্রসঙ্গে এখন এমন ভাবেই ভাবতে চেষ্টা করছে রক্ষণশীল ইরান।

শুধু তা-ই নয়, এই মারণ নেশা যে পর্দানসীন মহিলাদের মধ্যেও তীব্র ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে, সে কথা মেনে নিয়েছে সে দেশের সরকার। আর তাই খুব সীমিত ভাবে হলেও মাদকাসক্ত মহিলাদের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্রের ব্যবস্থা শুরু হয়েছে। সবটাই অবশ্য অতি গোপনে, প্রায় লোকচক্ষুর আড়ালে।

তেহরানের পশ্চিম দিকের শহরতলির পুনর্বাসন কেন্দ্রটির কথাই ধরা যাক। অসংখ্য কারখানা আর রাস্তার উপর ডাঁই করে রাখা কাঁচামালের স্তূপের ভিতরে কোথাও যেন হারিয়েই যায় ধাতব দেওয়ালের তৈরি বহুতলটি। কিন্তু গোপন নথি বলছে, ওখানেই কোনো ঘরে একা দিন কাটাচ্ছেন মিনা। বছর চব্বিশের ওই তরুণীর বাবা-মাও মাদকাসক্ত ছিলেন। মিনা মাদক নিতে শুরু করেন ১৯ বছর বয়স থেকে। কিন্তু এখন তিনি বদলাতে চান, কাটিয়ে উঠতে চান এই মারণ আসক্তি। লোকচক্ষুর আড়ালেই তাই চলছে চিকিৎসা।

কিন্তু এভাবে কত দিন? বিশেষত ইরানে যে হারে মাদকসক্তের সংখ্যা বাড়ছে, তাতে এই গোপনীয়তা বেশি দিন বজায় রাখা সম্ভব নয় বলেই একাংশের ধারণা। সে দেশের মাদক নিয়ন্ত্রণ সংস্থা যে তথ্য দিয়েছে তাতেই দেখা যাচ্ছে ইরানের তিরিশ লক্ষ বাসিন্দা মাদকাসক্ত। আর তার মধ্যে প্রায় সাত লক্ষই মহিলা। হঠাৎ করে মাদকাসক্তির এমন বাড়বৃদ্ধির কারণ অবশ্য এখনও পরিষ্কার নয়। তবে যা জানা গিয়েছে তা হলো, আফগানিস্তানে তৈরি আফিমের সিংহভাগ ইরান হয়েই বাকি দেশগুলিতে ছড়িয়ে পড়ে। সে দিক থেকে দেখতে গেলে ইরানে আফিম বেশ সহজলভ্য। নাহিদের বয়ানে, “কয়েক মিনিটের মধ্যেই নিজের পছন্দমাফিক মাদক জোগাড় করে ফেলা যায় এখানে।” বছর সাতাশের এই তরুণী নিজেও হেরোইন এবং নানা ধরনের মাদকে আসক্ত।

কিন্তু ইরানের মতো দেশে মহিলারা কী ভাবে এমন নিষিদ্ধ নেশা করার সুযোগ পেলেন? উত্তর খুঁজতে গেলে যে ছবিটা উঠে আসবে, তা এক কথায় অবিশ্বাস্য। কিছু স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার দেওয়া তথ্য বলছে, ইরানের মহিলাদের উৎসব অনুষ্ঠানের এখন অন্যতম অংশ মাদক-সেবন। শুধু তা-ই নয়, ‘বিউটি পার্লারগুলো’ও এখন মহিলাদের নেশার অন্যতম ‘ঠেক’। আসলে মহিলারা বিলক্ষণ জানেন যে ইরানের বৃহত্তর সমাজ মাদকাসক্তিকে শুধু হীন-চোখেই নয়, অপরাধের চোখে দেখে। পর্দার আড়ালেই দেদার চলে মারণ নেশা।

ইরানি প্রশাসনের এক পদস্থ কর্তা রাজিয়ে খোদাদউস্ত অবশ্য গোটা বিষয়টিকে ইসলামের উপর বিদেশি শক্তির আক্রমণ বলেই মনে করেন। কিন্তু কারণ যা-ই হোক না কেন, সত্যিটা যে তাতে পাল্টে যায় না তা রাজিয়েও জানেন। সত্যিটা মানছেন ইরানের অভ্যন্তরীণ মন্ত্রী রহমানি ফজলিও। চলতি বছরের গোড়ার দিকে এক রিপোর্টে তিনি বলেন, “আমাদের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো নেশার গোটা চক্রটাই অসম্ভব গোপনে চলে।” তিনি এ-ও জানান, মাদক পাচারকারীদের রোখার চেষ্টা শুরু করেছে সরকার। কিন্তু এভাবে যে মহিলাদের মধ্যে মাদকাসক্তি কমানো যাবে না, তা মানেন রহমানি। অগত্যা তাই স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার খোঁজ।

তবে এ খোঁজ শুরু হওয়ার আগে থেকেই মাদকাসক্তদের পুনর্বাসনের কাজ চালাচ্ছেন মাসৌমে এবং তার দল। শুরুর দিকে অবশ্য কোনো সরকারি তৎপরতা ছিল না। জঙ্গলে তাঁবু খাটিয়ে থাকতেন তারা। কাউকে জানাতে পারতেন না কী কাজ করছেন, এমনকী পুরো নামটাও প্রকাশে বাধা ছিল। সে ছবিটা আজও বদলায়নি। এখনও নিজের পরিচয় পুরো বলতে পারেন না। জানাতে পারেন না কী কাজ করছেন। নেই প্রচারও। “ নেশায় আক্রান্ত মানুষদের কাছে আমরা পরিচিত। তারা আমাদের ঠিকই খুঁজে নেন।’’ শুধু চিকিৎসার ব্যবস্থাই নয়, কী ভাবে নেশাসক্তদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়েও আনা যায়, সেটাও খেয়াল রাখেন মাসৌমে-রা।

তাদের তৈরি সেই কেন্দ্রেই নতুন জীবন খোঁজ শুরু করছেন মিনা, নাহিদ, সেপিদে-র মতো মাদকাসক্ত মহিলারা। খুব সহজে যে সাফল্য মিলছে তেমন নয়। যেমন সেপিদে জানালেন, বহু বার হেরোইন ছাড়ার চেষ্টা করেও পারেননি। কিন্তু তার আশা রয়েছে, খুব শীঘ্রই পারবেন। “আমি চাই আমার বাবা-মা আমায় নিয়ে গর্ববোধ করুন।” বললেন সেপিদে। কিন্তু মা-বাবা যে তাকে ত্যাগ করেছেন?

তাতে অবশ্য কিছু যায় আসে না। কারণ সেপিদে জানেন, তিনি বদলাচ্ছেন। সমাজ বদলাচ্ছে। পরিবর্তন আসছে ইরানে। হয়তো ধীর লয়ে। কিন্তু পুনর্বাসন কেন্দ্রের চার দেওয়ালের মধ্যে সে পরিবর্তনকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছেন সেপিদে।

(ওএস/এস/মে ১২, ২০১৪)