মারুনা রাহী রিমি : কণ্ঠশীলন প্রযোজিত নতুন নাটক (মঞ্চনাটক-৭) ‘যা নেই ভারতে’-এর দ্বিতীয় মঞ্চায়ন হবে আগামী ১লা জ্যৈষ্ঠ ১৪২১/ ১৫ই মে ২০১৪, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৭টায় বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির এক্সপেরিমেন্টাল থিয়েটার হলে। মহাভারতের কাহিনী অবলম্বনে বর্তমান সময়কে ধারণ করে নাটকটি রচনা করেন প্রখ্যাত নাট্যকার, নির্দেশক, অভিনেতা মনোজ মিত্র এবং নির্দেশনার দায়িত্ব পালন করছেন কণ্ঠশীলন প্রশিক্ষক ও নির্দেশক মীর বরকত।

কাহিনী সংক্ষেপ

সংস্কৃত ভাষায় রচিত প্রাচীন ভারতের অন্যতম দুটি মহাকাব্য 'রামায়ণ' ও 'মহাভারত'। পরবর্তী সময়ে এ কাব্যদুটি নিয়ে রচিত হয়েছে আরও অনেক সাহিত্যকর্ম। বিশেষ করে মহাভারতকে উপজীব্য করে বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ভাষার শিল্পী সৃষ্টি করেছেন অনন্যসাধারণ সব শিল্পকর্ম।

প্রচলিত বিশ্বাস অনুযায়ী 'মহাভারত'-এর রচয়িতা কৃষ্ণদ্বৈপায়ন বেদব্যাস তথা ব্যাসদেব। তিনি এই আখ্যানকাব্যের অন্যতম রচয়িতাও বটে। বর্তমানে 'কাশীদাসী মহাভারত' নামে যে বাংলা মহাভারত পরিচিত, তা রচনা করেন সপ্তদশ শতকের কবি কাশীরাম দাস। হস্তিনাপুরের রাজ্যসংকট ও করুক্ষেত্রের যুদ্ধকে কেন্দ্র করে আবর্তিত এ আখ্যানকাব্যের মূলমন্ত্রটি হলো—ধর্মের জয় ও অধর্মের নাশ। মহামতি ভীষ্মের সত্যরক্ষা, বংশরক্ষা ও সাম্রাজ্য রক্ষার আমৃত্যু সংগ্রাম, পঞ্চপাণ্ডবের বীরত্ব এবং কৌরবদের অন্যায় ও অনাচারের চিত্র অঙ্কিত হয়েছে মহাভারতে। কিন্তু এই কিংবদন্তি সৃষ্টির গল্প ও ঘটনাপ্রবাহকে প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ও বিশ্বাসের বাইরে এসে বিখ্যাত লেখক বুদ্ধদেব বসু ও প্রতিভা বসুর মতো গুণীজনেরা 'মহাভারত'কে বিশ্লেষণ করেছেন বহুমুখী দৃষ্টিকোণ থেকে। তাদের দৃষ্টিতে 'মহাভারত' ধরা পড়েছে ভিন্ন আঙ্গিকে। সেই ধারাবাহিকতায় পশ্চিমবঙ্গের প্রখ্যাত নাট্যকার মনোজ মিত্র রচনা করেছেন নাটক—'যা নেই ভারতে'। এ নাটকে তিনি তুলে ধরেছেন মুদ্রার অপর পিঠ। যদিও কলেবর বিবেচনায় নাটকের ঘটনাপ্রবাহ অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। অবশ্য ১৮ খণ্ডে রচিত মূল 'মহাভারত' এতটাই দীর্ঘ ও বিস্তৃত যে একটিমাত্র নাটকে তাকে সম্পূর্ণরূপে ধারণ করা অসম্ভব। তাই 'যা নেই ভারতে' নাটকের প্লট হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে প্রথম ২টি খণ্ডে। রাজা বিচিত্রবীর্যের মৃত্যুসময় থেকে শুরু করে রাজপুত্র ধৃতরাষ্ট্রের একশত পুত্রের আবির্ভাব পর্যন্ত সময় ও ঘটনাসমূহ ফুটে উঠেছে নাটকটিতে। নাটকের ঘটনা ও তত্ত্বের প্রয়োজনে মূল মহাভারত থেকে কিছু সংযোজন বিয়োজন করা হয়েছে। নির্মিত হয়েছে কয়েকটি কাল্পনিক চরিত্রও। যেমন—অন্তঃপুরের প্রবীণতম অধিকর্তা কঞ্চুকী, জঙ্গলের রাক্ষসী পাতকিনী ও ধৃতরাষ্ট্রের বাল্যকালের সখী ইরা। শুধু চরিত্র নির্মাণই নয়, ঘটনার বিশ্লেষণেও নাট্যকার মনোজ মিত্র নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গির প্রকাশ ঘটিয়েছেন। বলা বাহুল্য, তার ব্যাখ্যা নিজস্বতার গণ্ডি ছাড়িয়ে হয়ে উঠেছে সার্বজনীন। কারণ প্রাচীন ভারতের আখ্যানকে তিনি স্থাপন করেছেন অতি সমসাময়িক আধুনিক বিশ্ব ও রাষ্ট্রের ছাঁচে। ভীষ্মের মতো রথী-মহারথী ক্ষমতাধর ব্যক্তি ও শাসকদের যাবতীয় কর্মকাণ্ড ও মঞ্চের সামনে পরিবেশিত কাহিনীর আড়ালেও যে থাকতে পারে ভিন্ন কোনো চিত্র, তাই তুলে ধরেছেন নাট্যকার। পৌরণিকতা রূপায়িত হয়েছে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে। ক্ষমতাধর ও ক্ষমতালোভী রাষ্ট্রগুলোর আরও ক্ষমতার লোভ, সার্বভৌমত্বের নামে সাম্রাজ্যবাদ, একের পর এক রাষ্ট্র দখল, লুণ্ঠন, ক্ষুদ্র স্বার্থ ছাড়ের ইন্দ্রজাল সৃষ্টি করে বৃহত্তর স্বার্থ দখলের নিপুণ কারিগরি ধরা পড়েছে নাটকটিতে।

পৃথিবীর মানচিত্রে শাসক নামধারী আধিপত্যবাদী শোষকেরা যে অন্যায় প্রভাব ও প্রতিপত্তি বিস্তার করে তার সুস্পষ্ট প্রমাণ মেলে নাটকটিতে। যুগে যুগে নারীর প্রতি লাঞ্ছনা আর অপমানও প্রকটভাবে দৃশ্যায়মান এতে। শুধু তাই নয়, রাষ্ট্রব্যবস্থায় ধর্মীয় ইমেজধারী ব্যক্তিবর্গের অনুপ্রবেশ ও অযাচিত হস্তক্ষেপ যে দেশ ও সমাজের ভারসাম্য নষ্ট করে তার সচিত্র দৃশ্যপট রচিত হয়েছে এ নাটকে।

পরিণামে ধেয়ে আসে যুদ্ধের ভয়াবহতা। সবল ও দুর্বলের, শোষক ও শোষিতের, অত্যাচারী ও নির্যাতিতের চিরপ্রবাহমান দ্বন্দ্ব পরিণত হয় প্রকাশ্য লড়াইয়ে। বিশ্বের ইতিহাসে বঞ্চিত ও লাঞ্ছিতের প্রতিবাদের সংগ্রামে সৃষ্ট এমন অজস্র যুদ্ধের নজির মেলে।

১ ঘন্টা ৩৫ মিনিটের নাটকটির মঞ্চসজ্জা ও আলোক নির্দেশনা দিয়েছেন জুনায়েদ ইউসুফ। সংগীত পরিচালনা করেছেন অসীম কুমার নট্ট। কোরিওগ্রাফী করেছেন লিনা দিলরুবা শারমিন। পোষাক পরিকল্পনা করেছেন আইরিন পারভীন লোপা। নাটকের জন্য দুটি গানের কথা লিখেছেন এ.এফ. আকরাম হোসেন এবং কণ্ঠ দিয়েছেন হানিফ মোহাম্মদ রতন। এছাড়াও নেপথ্যে কণ্ঠ দিয়েছেন গোলাম সারোয়ার।

নাটকটির বিভিন্ন চরিত্রে রূপদান করেছেন আব্দুর রাজ্জাক, একেএম শহীদুল্লাহ কায়সার, সোহেল রানা, সালাম খোকন, অনন্যা গোস্বামী, জেএম মারুফ সিদ্দিকী, নিবিড় রহমান, তনুশ্রী গোস্বামী, নাজনীন আক্তার শীলা, তাসাউফ-ই-বাকি বিল্লাহ রিবিন, সুমন কুমার দে, তৃপ্তি রানী মণ্ডল, শামীম রিমু, মিজানুর রহমান, মাহমুদুল হাসান, শাহানা রহমান, মেহেরুন্নেছা অনীক, শরীফ আব্দুল ওয়াহাব, রুহুন ওয়াসাতা, অমিতাভ রায়, অনুপমা আলম, প্লাবন রাব্বানী ও ফারিয়া আক্তার সোমা।

(পিএস/অ/মে ১৩, ২০১৪)