শাহ আলী পিন্টু খান : নারায়ণগঞ্জের বন্দরে আজ কান্নার দিন। একাত্তরের ৪ এপ্রিল বন্দরে ব্যাপক গণহত্যা চালায় পাকিস্তানী সেনা ও তাদের স্থানীয় দোসররা।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের উপর হায়েনার মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে বর্বর পাকিস্তানী বাহিনী। প্রথমে রাজারবাগ পুলিশ লাইনে আক্রমণ করে ঘুমন্ত পুলিশের উপর নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হাজার হাজার পুলিশকে হত্যা করে। একই সময়ে ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা, চট্টগ্রাম, রংপুরসহ বিভাগীয় শহরে অভ্যন্তরীণ বাহিনী ও প্রশাসনের কার্যালয় দখল করে নেয় পাক বাহিনী। এরপর শুরু হয় সাধারণ বাঙ্গালীদের হত্যার তাণ্ডবলীলা।

১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল ভোর বেলায় পাকিস্তানী সেনাবাহিনী নারায়ণগঞ্জ শহর হয়ে বন্দরে প্রবেশ করে। শীতলক্ষা নদী পার হয়ে সোনাকান্দা খেয়াঘাট দিয়ে একদল এবং এক নম্বর খেয়াঘাট দিয়ে আরো একটি দল বন্দরে প্রবেশ করে ভোর পাঁচটায়। নিরীহ মানুষদের পথে পেয়ে তাদের আটক করে। বন্দরের

সিরাজউদ্দৌলা ক্লাব মাঠের আশেপাশের এলাকা থেকে ৫৪ জন মানুষকে বর্বর পাকিস্তানী সেনারা আটক করে ক্লাব মাঠের দক্ষিণ-পশ্চিম কোনে (বর্তমান বন্দর বধ্যভূমি) দাঁড় করিয়ে মেশিনগান দিয়ে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। মৃত্যু নিশ্চিত করতে এরপর পাকিস্তানী সৈন্যরা কাজী ইদ্রিসের বাড়ি ও আশেপাশের বাড়ি থেকে মুলিবাঁশের তৈরি বেড়া খুলে এনে যন্ত্রণাকাতর দেহগুলোর উপর রেখে আগুন ধরিয়ে দেয়। বন্দরের কিছু লোক দূর থেকে লুকিয়ে প্রত্যক্ষ করেন এ বর্বর হত্যাযজ্ঞ। যারা দূর থেকে এগুলো প্রত্যক্ষ করেছিলেন তাদের অন্যতম হলেন মরহুম আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া, দীন মোহাম্মদ হাফেজ, মোহাম্মদ আলী হাফেজ প্রমুখ। স্থানীয় রাজাকার ও পাক বাহিনীর দোসরদের নিয়ে পাকিস্তানী সেনারা সেদিন বন্দরের অনেকের বাড়িঘরও জ্বালিয়ে তন্ডব চালায়।
নিরীহ ৫৪জন মানুষকে ব্রাশফায়ার করার পর আগুনে পুড়িয়ে হত্যা, বিভিন্ন বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়া লোমহর্ষক এই ঘটনাগুলোর জন্য ৪ এপ্রিল বন্দরবাসীদের কাছে অত্যন্ত বেদনা ও শোকের দিন। সেই থেকে প্রতিবছর বন্দরবাসী ৪ এপ্রিল বন্দর গণহত্যা দিবস পালন হয়ে আসছে। প্রতি বছর ৪ এপ্রিল বন্দরের বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রছাত্রী, বন্দর গণহত্যা দিবস উদযাপন কমিটি, একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, শহীদ পরিবার, আওয়ামীলীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ সিরাজউদ্দৌলা ক্লাব মাঠের বধ্যভূমিতে শ্রদ্ধা নিবেদনের মাধ্যমে ৪ এপ্রিল বন্দর গণহত্যা দিবস পালন করে।

৪ এপ্রিল সিরাজদ্দৌলা ক্লাব মাঠে ৫৪ জনসহ ওইদিন বন্দরের বিভিন্নস্থানে আরও শতাধিক নিরস্ত্র মানুষকে গুলি করে হত্যা করে পাক হানাদার বাহিনী। এসব শহীদদের সকলের নাম পরিচয় জানা যায়নি। প্রাক্তন কমিশনার ও আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম আলহাজ্ব জয়নুল আবেদীন খান, আওয়ামীলীগের প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য ও প্রবীন নেতা ইউনুস খান, বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী নাসির, আওয়ামীলীগ নেতা ইউসুফ ভূঁইয়া ননী, আব্বাস আলী এবং বিভিন্ন শহীদ পরিবারের সদস্যদের প্রচেষ্টায় ও সহায়তায় ওইদিনে শহীদ ২৪ জনের নাম পরিচয় জানা সম্ভব হয়েছে। তারা হলেন, শহীদ ছমিরউদ্দিন সরদার, শহীদ মমতাজউদ্দিন মাষ্টার, শহীদ আলী আকবর, শহীদ রেজাউল ইসলাম বাবুল, শহীদ আমির হোসেন, শহীদ নায়েব আলী, শহীদ আলী হোসেন, শহীদ ইউসুফ আলী, শহীদ সরজু চন্দ্র কানু, শহীদ যমুনা চন্দ্র কানু, শহীদ লছমন চন্দ্র কানু, শহীদ কানাই লাল কানু, শহীদ গোপাল চন্দ্র, শহীদ ভগবত চন্দ্র, শহীদ দুর্গা চরন প্রসাদ, শহীদ নারায়ণ চন্দ্র প্রসাদ, শহীদ ইন্দ্র চন্দ্র দাস, শহীদ সুরেশ চন্দ্র দাস, শহীদ দিগন্ত চন্দ্র বর্মণ, শহীদ বনেল চৌধুরী, শহীদ মোবারক, শহীদ হারাধন মাষ্টার, শহীদ নারায়ণ চৌধুরী ও শহীদ পরেশ দাস।

এছাড়া বন্দর খানবাড়ির আবুল বাশার খানসহ অনেকেই সেদিন বন্দরের বিভিন্নস্থানে বর্বর পাকিস্তানী সেনা ও তাদের দোসরদের হাতে শহীদ হন। সেই থেকে ৪ এপ্রিল বন্দরবাসীর জন্য কান্নার দিন। চোখের জল, ভালোবাসা-শ্রদ্ধায় এদিন বন্দরবাসী স্মরণ করেন একাত্তরে হারানো স্বজনদের ।

(এসএপিকে/এসসি/এপ্রিল০৪,২০১৫)