বান্দরবান প্রতিনিধি : পাহাড় কন্যা বান্দরবানে ৪ দিনব্যাপী আয়োজিত মারমা সম্প্রদায়ের প্রধান সামাজিক উৎসব মাহাসাংগ্রাই পোয়ে জলকেলীর মধ্যদিয়ে উদযাপন করা হয়েছে। গত সোমবার বর্ণাঢ্য র‌্যালীর মধ্য দিয়ে শুরু হওয়া উৎসব বৃহস্পতিবার ঐতিহ্যবাহী জলকেলী ও মারমা শিল্পী গোষ্ঠির আয়োজনে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মধ্যদিয়ে সম্পন্ন করা হয়। মাহাসাংগ্রাই পোয়ে উৎসবের প্রথম ইভেন্ট বর্ণাঢ্য র‌্যালীর উদ্বোধন করেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি।

এ সময় অন্যান্যের মধ্যে বান্দরবান সেনা রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল নকিব আহমদ চৌধুরী, জেলা প্রশাসক মিজানুল হক চৌধুরী, পুলিশ সুপার দেবদাস ভট্টাচার্য্যসহ বিভিন্ন দপ্তরের পদস্থ কর্মকর্তারাসহ ১১টি ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠির নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতীরা তাদের নিজস্ব স্বত্তার ব্যানার, ফেষ্টুন ও প্লেকার্ড নিয়ে অংশ নেয়। এ সময় পুরাতন রাজবাড়ী মাঠে আয়োজন করা হয় বয়স্ক পুজা ও চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগীতার। বাংলা নববর্ষের পাশাপাশি মারমা সম্প্রদায়ের বর্ষপঞ্জি হিসেবে আজ থেকে তাদের নব বর্ষের সুচনা। তাদের বর্ষপঞ্জি হিসেবে ১৩৭৫ (সাক্রয়) সালকে বিদায় জানিয়ে ১৩৭৬ (সাক্রয়) সালকে বরণ করে নিচ্ছেন।

মারমাদের পাশাপাশি তংচংঙ্গ্যা সম্প্রদায়ও নানা আয়োজনের মধ্যদিয়ে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান পালন করছে। রেইচা সিনিয়র পাড়ায় তাদের ঐতিহ্যবাহী ঘিলা খেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এতে রাঙ্গামাটি ও বান্দরবানের বিভিন্ন এলাকার ২৪টি দলের প্রায় ৩ শতাধিক যুবক-যুবতী ও নারী-পুরুষ অংশ নিয়েছে। ঘিলা খেলা প্রতিযোগিতায় প্রধান অতিথি ছিলেন পার্বত্য বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি। উক্ত অনুষ্ঠানে সরকারি বেসরকারি কর্মকর্তাদের পাশাপাশি তংচংঙ্গ্যা কল্যাণ সংস্থার সভাপতি প্রসন্ন কান্তি তংচংঙ্গ্যা উপস্থিত ছিলেন।

অনুষ্ঠানের ২য়দিন মারমা সম্প্রদায় তাদের ধর্মীয় রীতি অনুযায়ী বৌদ্ধ ধর্মীয় প্রবক্তা গৌতম বুদ্ধের মূর্তি স্নান অনুষ্ঠানের আয়োজন করেন। সাঙ্গু নদীর পাড়ে সহশ্রাধিক নারী-পুরুর আবাল বৃদ্ধ বনিতা সকলেই বুদ্ধ মূর্তি স্নান অনুষ্ঠানে অংশ নেন। একইদিন সন্ধ্যায় রাজগুরু বৌদ্ধ বিহারে ধর্মদেশনা এবং হাজার বাতি প্রজ্জলন অনুষ্ঠান উদযাপিত হয়। পাশাপাশি রাত ১০টায় পিঠা তৈরির আসর বসে জাদিপাড়া এলাকায়। সারারাত ভর যুবক-যুবতীরা ঐক্যবদ্ধ ভাবে দলগত হয়ে পিঠা তৈরি উৎসবে যোগ দেয়। ৩য় দিন বিকেল ৩টা থেকে পুরাতন রাজবাড়ী মাঠে ২দিনব্যাপী আয়োজিত জলকেলী (মৈত্রী পানি বর্ষণ) ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উদযাপন করা হয়। ১৫ ও ১৬ এপ্রিল পুরাতন রাজার মাঠে মৈত্রী পানি খেলা জেলা সদরের বিভিন্ন পাড়ার ২০টি দল অংশ নিয়েছে।

অতীতের সকল জরা-গ্লানি, দঃখ কষ্ট মুছে দিয়ে মহাসমারোহে পালন করা হয় যুবক-যুবতীদের ঐতিহাসিক মৈত্রী পানি বর্ষণের এই মহাউৎসব। মারমা সম্প্রদায়ের এই মৈত্রীময় পানি বর্ষন উৎসব দেখার জন্য দেশ-বিদেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে হাজার হাজার লোকের সমাগম ঘটে রাজার মাঠে। এ সময় একদিকে যুবক-যুবতীদের পানি বর্ষণ অন্যদিকে নানা ধরনের বিনোদন মুলক খেলাধুলা পরিবেশিত হয়। পাশাপাশি গভীর রাত পর্যন্ত চলে পাহাড়ী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যগত সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।

এদিকে রাঙ্গামাটি জেলার রাজস্থলী উপজেলার বাঙ্গালহালিয়া উচ্চবিদ্যালয় মাঠে বিশাল আয়োজনে জলকেলী উৎসবের আয়োজন করে। উক্ত অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং এমপি। উক্ত অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন সাবেক পার্বত্য প্রতিমন্ত্রী দিপংকর তালুকদার, সংসদ সদস্য ফিরোজা বেগম চিনু, রাঙ্গামাটি রিজিয়ন কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল সানাউল হক, বান্দরবান পার্বত্য জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ক্য শৈ হ্লা, রাঙ্গামাটি জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বিশ্বজ্যোতি চাকমা, রাঙ্গামটি জেলা প্রশাসক শামসুল আরেফিন, পুলিশ সুপার সাইফ তরিকুল হাসান।

উক্ত অনুষ্ঠানে প্রথান অতিথি বলেন, সরকার পার্বত্য এলাকার বহুমুখি উন্নয়নে অত্যন্ত উদার এবং আন্তরিক। ধীরে ধীরে পার্বত্য শান্তি চুক্তির সকল শর্তগুলো পুরণ করা হচ্ছে। ভুমি কমিশনের মাধ্যমে ভুমি সংক্রান্ত বিরোধ মিমাংসা করা হবে উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, যে কোন সমস্যার সমাধান আছে। বিরোধীতা করে, হত্যা ও সন্ত্রাসের মাধ্যমে সমাধান আশা করা যায় না। মানুষের প্রতি ভালবাসা, একে অপরের প্রতি আস্থা স্থাপন এবং ধর্য্য ধারণ করে মৈত্রীর বন্ধনে নিজেদের আবদ্ধ করতে পারলে যে কোন জঠিল সমস্যার সমাধান সম্ভব।

এ সময় তিনি আরো বলেন, একদিনের ছুটিতে সরকারি কর্মকর্তারা পাহাড়ে ৪দিনব্যাপী মাহা সাংগ্রাই পোয়েসহ বৈসাবী উৎসব পালন করতে পারে না। তাই সামাজিক এই গুরুত্বপূর্ণ উৎসব পরিবার পরিজন নিয়ে পালন করার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে পার্বত্য এলাকায় ৪দিনের ছুটি মঞ্জুরের আবেদন করলে তিনি পার্বত্য মানুষের কথা বিবেচনা করে মন্ত্রীসভার এক বৈঠকে এই ছুটি মঞ্জুর করেন। এটি পার্বত্যবাসীর জন্য বড় একটি পাওয়া। পাহাড়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অটুট রেখে সকলকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার আহবান জানান। উক্ত অনুষ্ঠানে দিনভর পানি খেলা এবং মারমাদের বিভিন্ন সাংস্কৃতিক দল তাদের নাচ গান পরিবেশন করে। এসময় পুরো বাঙ্গালহালিয়া এলাকা হাজার হাজার মানুষের পদচারনায় মুখরিত হয়ে উঠে। পাহাড়ী বাঙ্গালী নারী পুরুষ সকলেই একে অপরের গায়ে পানি ছিটিয়ে নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানান।

মারমা সম্প্রদায়ের প্রধান এই সামাজিক উৎসব পাহাড়ের প্রতিটি পাড়া ও মহল্লায় প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে মাহা সাংগ্রাই পোয়ে। বান্দরবান জেলা সদরে এই উৎসব মহাসমারোহে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দিপনায় সম্পন্ন হলেও মারমা অধ্যূষিত পাড়া গুলোতে নতুন বছরের ১৫দিন পর্যন্ত মৈত্রীময় পানি বর্ষণসহ নানা আয়োজনে এই উৎসবটি উদযাপন করা হয়।

মারমা ছাড়াও পাহাড়ে চাকমা, তংচংঙ্গ্যা, ত্রিপুরা সম্প্রদায় নিজস্ব স্বকীয়তায় তাদের আদি ঐতিহ্য ধারণ করে বর্ষবরণ অনুষ্ঠান পালন করে আসছে। যার পরনায় পাহাড়ে বর্ষবরণ অনুষ্ঠানটি বৈসাবী নামে ব্যাপক পরিচিত।

(এএফবি/এএস/এপ্রিল ১৬, ২০১৫)