আহমেদ জাকির : এক.পৃথিবীর শুরু থেকে নানা ভাষায় বিভিন্ন ধরনের ছড়া, কবিতা, গল্প, উপন্যাস ইত্যাদি লেখা হয়েছে। কিন্তু শুধুই আমার জন্য, শুধুই আমার মনের কল্পনা, স্বপ্ন, আশা-আকাঙ্খা, ইচ্ছে নিয়ে একটিও লেখা হয়নি।

কারণ, কোন লেখকই যে আমার মনের সব কথা জানেন না। আর আমি কাউকে এসব কথা বলিও নি। আর তাই এবার আমি ঠিক করেছি যে, আমি নিজেই, নিজেকে নিয়ে একটু কিছু লিখব। মানে আমার ইচ্ছেরা কেমন, আমার কল্পনা কেমন, আমার স্বপ্ন কি, আশা-আকাঙ্খা কি এই সব।

তো প্রথমেই আমি আমার নাম বলে নেই। আমার নাম নিরব। আমি পঞ্চম শ্রেণীতে পড়ি। আমার বয়স নয় বছর তিন মাস...।

অনেকেই বলে আমার নামটা অনেক সুন্দর। আমি এসব নিয়ে কখনও ভাবিনি। ভাবার প্রয়োজনও মনে করিনি। আর কেউ হয়ত এসব নিয়ে ভাবেও না। হঠাৎ সেদিন একটি ছেলের সাথে পরিচয় হল। নাম বর্ণ। আর ওর নামটা শুনেই আমার প্রথমবারের মত মনে হল, আমার নামটাও যদি অমন সুন্দর হত! যদিও আমার নাম অনেক অনেক সুন্দর না হলেও খারাপ নয়। খারাপ বলতে দুষ্টু ছেলে মেয়েরা আমার নাম নিয়ে বাজে কথা বলবে সে রকম নয়। যেমন, আমাদের সাথে একটি মেয়ে পড়ে ওর নাম, কদু। উফ্ কি বিচ্ছিরি একটা নাম। আমি ভাবতেই অবাক হই যে, ওর বাবা মা ওর অমন একটা নাম কেন রাখল। আর এদিকে মেয়েটির হয়েছে জ্বালা। প্রতিদিন কেউ না কেউ তার নাম নিয়ে তাকে বাজে কথা বলে। আর রোজ রোজ এসব বাজে কথা শুনতে কারই বা ভাল লাগে।

দুই
আমি যে স্কুলটায় পড়ি সে স্কুলের নাম ‘দক্ষিণ চাঁদপুর প্রাথমিক বিদ্যালয়’। খুব সুন্দর একটা স্কুল। স্কুলের সব শিক্ষক অনেক ভাল। ছাত্র-ছাত্রীরাও ভাল। অনেক মেধাবী। কেবল আমিই একটু... কিন্তু আমার মনের মাঝে বিখ্যাত হয়ে ওঠার প্রবল বাসনা। আর তাই সারাক্ষণ বিখ্যাতদের কথা ভাবি। তাদের বিখ্যাত হয়ে ওঠার কারণগুলোর কথা ভাবি। তাদের বিখ্যাত কাজগুলোর কথা ভাবি। তাদের সাহস, ইচ্ছাশক্তি, আর আত্মবিশ্বাসের কথা ভাবি। আর এই ভেবে পুলকিত হই যে আমিও একদিন তাদের মত বিখ্যাত হব। কারণ, আমার আত্মবিশ্বাস, আমার ইচ্ছাশক্তি, আমার ভাবনা, আর আমার শক্তি-সাহস বলে যে আমি তা পারব। এবং আমাকে তা পারতেই হবে। মাঝে মাঝে যখন শুনি যে, কেউ একজন খুব ভাল একটা কাজ করল। দেশের জন্য সুনাম বয়ে আনল। তখন ভাবি আহ্, আমিও যদি এমন একটা কাজ করতে পারতাম। তবু আমি এই ভেবে পুলকিত হই যে, আমার এই আকাঙ্ক্ষাই একদিন আমাকে নিয়ে যাবে আমার স্বপ্নের বাড়ি। সেখানে আমাকে অভিনন্দন জানাতে আসবে পৃথিবীর সমস্ত বিখ্যাত ব্যক্তিরা। তারা আমাকে দেখে অবাক চোখে তাকাবে। আমার সুন্দর কাজের প্রশংসা করবে। আর তাদের এই প্রশংসা আমাকে আরও একটি ভাল কাজের উৎসাহ যোগাবে।

তিন
মাঝে মাঝে খুব ইচ্ছে করে মাকে জড়িয়ে ধরে বলি, ‘মা তোমাকে ভালবাসি’। কিন্তু কথাটা কখনোই বলা হয় না। সত্যি বলতে, আমি ঠিক সেভাবে বলতে পারি না। অথচ অনেকেই যে যার মাকে এসব কথাগুলো খুব সহজেই বলে। কেবল আমার বেলায় হয় না।
একবার আমাদের এক শিক্ষিকা জিজ্ঞেসই করলেন যে, তুমি তোমার মা-বাবাকে ভালবাসো? আমি উত্তর দিলাম, না! আমার উত্তর শুনে শিক্ষিকার কি মনে হয়েছিল কে জানে। তবে আমার কিন্তু ভারি রাগ হয়েছিল শিক্ষিকার উপর। এটা কেমন প্রশ্ন! আচ্ছা এমন কেউ কি আছে যে, সে তার মাকে ভালবাসে না?

এই ঘটনার পর মাথায় এক অদ্ভুত বুদ্ধি এল। চিঠি লিখব। চিঠি লিখে খামে ভরে ডাকঘরে দিয়ে আসব। চিঠির ওপর প্রেরকের ওখানটায় থাকবে আমার নাম আর প্রাপকের ওখানটায় থাকবে মা ও বাবার নাম। এবং চিঠির ভেতর রঙিন কাগজে, রঙিন কালিতে লিখা থাকবে ‘মা তোমাকে ভালবাসি। বাবা তোমাকে ভালবাসি’।


তো একদিন এসব লিখে-টিখে খামে ভরে চিঠিটা টেবিলের ওপর রেখে পাশের বাড়ির বন্ধুর কাছে গিয়েছি আঠা আনতে। আর ঠিক তখনই চিঠিটা বড় আপু দেখে ফেলে। এবং চিঠির প্রেরকের ওখানটায় আমার নাম এবং প্রাপকের ওখানটায় মা ও বাবার নাম দেখে আগ্রহী হয়ে চিঠিটা খুলে পড়ে ফেলে। আর সাথে সাথেই সারা বাড়ি জানাজানি। আমি আঠা নিয়ে এসে দরজার সামনে দাঁড়াতেই সকলের ফিসফাস শুনে বুঝতে পারলাম যা হবার হয়ে গেছে। ব্যস আমিও উধাও।

সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরলাম। চুপিচুপি। কেউ দেখার আগেই নিজে নিজে, একা একাই খেয়ে দেয়ে চুপচাপ কাঁথামুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়লাম। একটু পরেই কাঁথাটা একটু একটু করে উঁচু হতে হতে আরও একজন কাঁথার নিচে ঢুকল। শরীরের গন্ধটা বড্ড পরিচিত। একটুপর দুটি হাত এসে আমাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল। আমিও ঘুমের ভান করে আমার দু হাত দিয়ে আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলাম। আর রাতে অবিশ্বাস্য এক স্বপ্ন দেখলাম। দেখলাম আমিও সবার মত বলছি, মা তোমাকে ভালবাসি।

গল্পটা আজকের মত এখানেই শেষ করছি। তাই বলে ভেবো না যে, গল্পটা এখানেই শেষ হয়েছে। আরও অনেক কথা আছে...