আনিসুর রহমান আলিফ : চটের বস্তা আর কাস্তে নিয়ে সিরু চাচা তার ঘর থেকে বের হবার আয়োজন করছেন। ঘর বলতে পাটকাঠির বেড়ার উপরে পুরোনো টিনের ছাউনি দেওয়া জীর্ণ একটি ঘর। একটাই মাত্র ঘর, তবে এই ঘরের বাসিন্দা তিনি একা নন। বলতে গেলে এই অবেলায় তার জন্যই ঘরের বাইরে বের হওয়া। দরজার আঙটায় দড়ি পেঁচিয়ে রেখে সিরু চাচা রাস্তায় উঠে এলেন।

ভাঙ্গা রাস্তার মাঝে মাঝে তীক্ষ্ন ভাবে ইটের কোনা বেরিয়ে আছে। মাঝে মাঝেই সেই ইটের কোনায় ঠোক্কর খাচ্ছেন সিরু চাচা। ইটের কোনাগুলো সরাসরি তার বুড়ো আঙুলে আঘাত করছে। পায়ে জুতা বা স্যান্ডেল থাকলে হয়তো এর থেকে রক্ষা পাওয়া যেতো কিন্তু তার তো কোনো জুতা সান্ডেল নেই। এই সত্তর বছরের জীবনে তিনি কখনও জুতা স্যান্ডেল পরেন নি। একবার পথে পড়ে থাকা এক জোড়া বুট জুতা পেয়েছিলেন। পাকিস্তানি হানাদাররা তখন দেশ ছেড়ে পালাচ্ছে। রাস্তায় অস্ত্র-বুট হরহামেশাই পড়ে থাকতো। বুটজোড়া বেশ ভালো ছিলো। চকচকে নতুন বুট, পায়ে লেগেছিলোও বেশ।

বুট দেখে কাজেম বলেছিলো,
-চাচা, তোমার তো কপাল খুইলা গেছে। পাকিস্তানি সেপাইদের বুট পাইছো! তোমার তো রাজকপাল। দেখি দেখি, কেমুন বুট। কাজেম বুটটা ভালো করে পরীক্ষা করে বললো,
-দেখছো চাচা, বুটের তলায় রক্ত লাইগা রইছে। হারামির বাচ্চারা এই বুট দিয়া পাড়াইয়া কতো লোকরে যে মাইরা ফেলাইছে তার হিসাব নাই। কাজেমের হাত থেকে বুট জোড়া নিয়ে রক্তের দাগ দেখা মাত্রই ওটাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলো সিরু চাচা।

ইদানিং এমন হয়েছে যে, ক্ষণে ক্ষণেই পুরোনো কথা মনে পড়ে। পুরোনো কথা মনে করতে সিরু চাচার বেশ লাগে। এ যেনো ইচ্ছা স্বপ্ন। মাথার মধ্যে চলা এ-চিন্তা সে-চিন্তা বহন করে এবড়ো-থেবড়ো ইটের রাস্তায় হোঁচট খেতে খেতে সিরু চাচা শহরের একেবারে প্রান্তে এসে পড়লেন। সামনে মাঠ। মাঠ বললে ভুল বলা হবে। এখানে এখন সর্বত্রই ছোট ছোট সিমেন্টের খুঁটি পোঁতা। মাঝে মাঝে হাঁটু সমান ইট দিয়ে দেয়ালের মতো করা হয়েছে। সিরু চাচা একটা দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন। মনে মনে বললেন, একটা সময় ছিলো যখন এই মাঠ থাকতো সবুজ ফসলে ভরা। চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। সবুজ যখন সোনালি রং ধারন করতো তখন মনে হতো সমস্ত মাঠ জুড়ে কে যেন সোনা ঢেলে দিয়ে গেছে।

সোনা ঢালা সেই দৃশ্য একবার দেখলেই জীবনের সকল সুখ যেন বুকের মধ্যে এই খানে ধরা দেয়। সিরু চাচার সত্তর বছরের এই লম্বা জীবনের গন্ডি খুবই সংকীর্ণ। থাকবার জন্য ঐ একটি মাত্র ঘর, ভাঙ্গাচোরা পথ আর পথের শেষে এই মাঠ। এইটুকুই তার জগত। কিন্তু সেই মাঠ আর এই মাঠের মধ্যে এখন বিরাট তফাৎ। এখন যে মাঠটি সিরু চাচার সামনে শুয়ে আছে তাকে আর মাঠ বলা চলে না। চারিদিক থেকে অপরিকল্পিত ভাবে বাড়ি-ঘর হতে হতে জায়গাটা খুবই সংকীর্ণ হয়ে পড়েছে। হিন্দুদের ফেলে যাওয়া সম্পত্তি আর সরকারি হালটগুলো পেটমোটা দালালদের স্থায়ী দখলে চলে গেছে। সিরু চাচা হাঁটু সমান একটা ইটের দেয়াল পেরিয়ে আরো একটু সামনে এগিয়ে গেলেন। তার এখন বয়স হয়েছে, আগের মতো আর চলাফেরা করতে পারেন না। হাঁটু সমান ইটের একটা দেয়াল পার হতে তার বেশ বেগ পোহাতে হলো। এদিক-সেদিক যত্রতত্র ভাবে ছোট-বড় সিমেন্টের খুঁটিগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। সিরু চাচা চারিদিকটা ভালো মতো পর্যবেক্ষণ করার চেষ্টা করলেন। স্বল্প দৃষ্টিতে যতদূর দেখা যায় কোথাও কোনো সবুজ দৃশ্যমান হলো না।

বছরের অন্য সময়গুলোতে এদিকটায় একটু-আধটু সবুজ শষ্য-ঘাস-লতাপাতা চোখে পড়ে, কিন্তু এখন চৈত্র মাস। চারিদিকে খটখটে শুকনো মাটি। চৈত্রের প্রচন্ড খরতাপে ঘাস-লতাপাতা শুকিয়ে একেবারে জঞ্জাল হয়ে গেছে। রোদের তেজ এতো বেশি যে, বেশিক্ষণ তাকিয়েও থাকা যায় না। দূরে দৃষ্টি মেললে চোখ জ্বালা করে। সিরু চাচার এখন চোখ জ্বালা করছে। তাঁতালো রোদের মরীচিকায় চোখের কোণ দিয়ে ক্ষাণিক পানি গড়িয়ে পড়েছে। গামছার এক অংশ দিয়ে চোখ মুছে সিরু চাচা আবার তার দৃষ্টি মেললেন। দূরে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন। কিন্তু না, তার বৃদ্ধ দৃষ্টিতে কোথাও এতটুকু ঘাস বা লতাপাতা নজরে এলো না। সিরু চাচা লক্ষ করেছেন ইদানিং তার কী যেন হয়েছে, ক্ষণে ক্ষণেই চোখ জ্বালা করে। শুধু দুপুরের রোদে নয়, রাতের অন্ধকারেও চোখ জ্বালা করে। হঠাৎ কাঁ কাঁ শব্দে সামনের দিকে তাকাতেই কংক্রিটের খুঁটির উপর একটি কাক নজরে এলো।

একটু পরে আরো একটা, এরপর আরো দুইটা তারপর আট-দশটা। সিরু চাচা দেখলেন, কাকগুলো হা করে শ্বাস নিচ্ছে। তাদের শ্বাস নেওয়ার ভাব দেখেই বোঝা যায় চৈত্রের খরতাপে তারা ভীষণ তৃষ্ণার্ত। তারা কি পানি খুজছে? কিন্তু এখানে আশেপাশে তো কোনো পুকুর নেই। দু-একটা যা ছিলো সব ভরাট করে বিল্ডিং তোলা হয়েছে। নদী আছে একটা, কিন্তু সেটাও তো বেশ দূরে। কাকগুলো এখানে কী চায় ? সিরু চাচা কাকগুলোর দিকে তাকিয়ে ব্যাপারটা বোঝার চেষ্টা করলেন। একদৃষ্টে বেশিক্ষণ তিনি তাকিয়ে থাকতে পারেন না। চোখ জ্বালা করে। হাতের কাস্তেটা মাটিতে নামিয়ে রেখে চোখ দুটোকে একটু রগড়ে নিয়ে ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন কাকগুলোর দিকে। রোদের আলোয় কাকের কালো পালকগুলো চকচক করছে।

সিরু চাচা ভালো মতো খেয়াল করে দেখলেন কাকগুলো তারই দিকে তাকিয়ে আছে। ভীষণ তীক্ষ্ন তাদের দৃষ্টি। কাকগুলো ওভাবে তাকিয়ে আছে কেন? সিরু চাচার একটু ভয় ভয় করলো। কাক যে শকুনের মামাতো ভাই এটা সে কার কাছে যেন শুনেছেন, কিন্তু ঠিক মনে করতে পারছেন না। ইদানিং মনটা হয়ে গেছে নদীর মতো। নদীর স্রোত যেমন আপন গতিতে চলে, সিরু চাচার স্মৃতি শক্তিও আপন গতিতে, আপন ইচ্ছায় চলে। সহসা ইচ্ছা করে কোনো কিছু মনে করা যায় না। আবার কা কা শব্দে সিরু চাচার চিন্তায় ভাঁটা পড়লো। কাকগুলোর দিকে তাকিয়ে বুঝলেন, তারা যেন তার দিকে একটু এগিয়ে এসেছে। ব্যাপার কী? এরা এগিয়ে আসছে কেন?

সিরু চাচা শুকনো ইটের একটা দলা ছুঁড়ে মারলেন কাকগুলোর দিকে। ভয় পেয়ে কাকগুলো উড়ে পাশে থাকা অপর একটি খুঁটির উপর বসলো। নাহ্ আর বসে থাকা চলে না। মঙ্গলের জন্য খাবার জোগাড় করতে হবে। কিন্তু খাবার কোথায়? হঠাৎ দেখলেন, ইটের দেয়াল ঘেঁসে লতাপাতার মতো দু-চারটি ঘাস গজিয়েছে। সিরু চাচা কাস্তে দিয়ে খুব কায়দা করে লতাগুলো কাটলেন। এমন ভাবে কাটলেন যেন লতাগুলো আবার নতুন করে ডগা ছাড়তে পারে। ইটের দেয়াল ঘেঁসে যেটুকু ঘাস পাওয়া গেলো তা এক মুঠোরও কম। দেয়াল পেরিয়ে তিনি সামনে এগিয়ে চল্লেন। মঙ্গলের জন্য কিছু তাজা দূর্বাঘাস কাটতে পারলে ভালো হতো। কতোদিন বেচারা পেট পুরে খেতে পায় না। সিরু চাচা দ্রুত নজর চালাতে থাকেন।

নাহ, কোথাও এতটুকুও ঘাস নজরে আসছে না। খুব বিপদে পড়া গেলো তো। ঘাস না পেলে মঙ্গলকে কী খাওয়াবেন তিনি। তার তো জমানো অর্থও নেই যে, বাজার থেকে কেনা ঘাস বা ভুসি এনে খাওয়াবেন। ভারি মুশকিলে পড়া গেলো তো। সিরু চাচা সামনে এগিয়ে চল্লেন। সামনেই নতুন একটা বিল্ডিং হয়েছে কিন্তু ওখানে কেউ থাকে না। বিল্ডিং যে একেবারে নতুন তাও না। বছর পাঁচেক হলো ওটা ওভাবেই পড়ে আছে। সিরু চাচা দেখলেন, বিল্ডিং এর সামনে পড়ে থাকা ছায়ায় কিছু ঘাস গজিয়েছে। আর দেরি না করে কাস্তে দিয়ে ঘাসগুলো কাটতে শুরু করলেন তিনি। ঘাস কাটতে কাটতে তিনি হারিয়ে গেলেন ইচ্ছে স্বপ্নে...

এইখানে এক সময় নন্দীরা থাকতো। সে অনেক কাল আগের কথা। তখন বৃটিশ আমলের মহেন্দ্রক্ষণ। মহাত্মা গান্ধীর অসহিংস আন্দোলন চলছে। শুনতাম আন্দোলন নাকি বিরাট আকার ধারণ করেছে। কাজ কর্ম ফেলে দলে দলে মানুষ মৌন মিছিল করে বেড়াচ্ছে। আমার বয়স তখন বারো তেরো, তাই আন্দোলনের মানে কী তাই জানতাম না। এইখানেই তখন বিশাল একটা আম গাছ ছিলো। প্রতিদিন একবারের জন্য হলেও এইখানে এই আমগাছের নিচে এসে বসে থাকতাম। পাশেই নন্দীদের বাড়ি। জগেস নন্দী ছিলো আমার খেলার সাথী। স্পষ্ট মনে আছে, আমি তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। সেবার পরীক্ষার ফি না দিতে পেরে ঠিক এইখানেই আম গাছটির নিচে এসে বসে ছিলাম। পরীক্ষা দিতে পারবো না তাই পড়াশোনাও বুঝি আর হবে না এই সব ভাবছি। হঠাৎ পেছন থেকে মনিকা চাচির গলা শুনতে পেলাম।
-কিরে সিরু, এখানে এভাবে বসে আছিস যে, তোর না আজ পরীক্ষা? আমি কোনো কথা বলতে পারলাম না। তিনি আবার বললেন,

-তোর দেরি দেখে জগেস সেই কখন চলে গেছে। শিগ্গিরি যা, পরীক্ষা তো এতক্ষণে শুরু হয়ে গেছে মনে হয়। আমি কোনো কথা বলছি না দেখে চাচি আমার আরো কাছে এসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন,
-কী হয়েছে বলতো? আমি তখনও চুপ। আমার নীরবতায় তিনি কী বুঝলেন জানি না। আমাকে বললেন,
-এখানেই থাকিস, আমি এক্ষুণি আসছি। ক্ষাণিক বাদে চাচি ফিরে এসে আমার হাতে একটা সিকি ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
-এটা স্যারকে দিয়ে আমার কথা বলবি। যা যা, শিগ্গির যা, পরীক্ষা এতোক্ষণে শুরু হলো কিনা কে জানে। মনিকা চাচির দেওয়া সিকিটা মুঠোবন্দী করে স্কুলের দিকে দিলাম দৌড়। ফসলি মাঠের উপর দিয়ে এক নিশ্বাসের দৌড়ে শষ্য-লতাপাতার প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে স্কুলে যখন পৌঁছলাম তখন পরীক্ষা পনের মিনিট হয়ে গেছে। মনিকা চাচির দেওয়া সিকিটা স্যারের হাতে দিয়ে চাচির কথা বলতেই তিনি খাতা আর প্রশ্ন দিয়ে আমাকে পরীক্ষার হলে বসতে দিলেন।

মনিকা চাচির কাছে আমার ঋণ অনেক। শুনেছি আমার জন্মের সময় আমার মা মারা যান। মায়ের চেহারা আমি দেখিনি কখনও কিন্তু মায়ের কথা মনে পড়লেই আমার সামনে মনিকা চাচির আদর মাখা মুখটি ভেসে ওঠে।

সেবার পরীক্ষা বেশ ভালই হয়েছিলো। পঞ্চম শ্রেণি উত্তীর্ণ হয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে পা রাখলাম। পড়াশোনাও বেশ চলছিলো। হঠাৎ একদিন গ্রামের বয়োজ্যেষ্ঠদের মুখে শুনলাম দেশ নাকি স্বাধীন হয়েছে। বৃটিশ সরকার দেশ ভাগ করে দিয়েছে। এখন থেকে হিন্দুরা হিন্দুস্থানে আর মুসলমানরা থাকবে পাকিস্তানে। দেশ স্বাধীনের দু-একদিন পরে হঠাৎ এক সকালে প্রচন্ড চিৎকার চেচামেচিতে আমার ঘুম ভাঙলো। বাবা বললেন, গ্রামের সব হিন্দুরা নাকি হিন্দুস্তান তথা কোলকাতায় পালিয়ে যাচ্ছে। কথাটা শুনে বুকের মধ্যে কেমন যেন ছ্যাৎ করে উঠলো। দৌড় দিলাম নন্দীদের বাড়ির দিকে। ওদের বাড়ির উঠানে যখন পৌঁছলাম তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। গ্রামের কয়েকজন মুরুব্বিকে দেখলাম জটলা করে কী যেন বলাবলি করছে। একজন বললো,

-শয়তানগুলার ভয়ে নন্দীরা রাতের অন্ধকারেই পালায়ে গেছে। আহারে, কতো ভালো মানুষ ছিলো, সুখে-দুঃখে সবসময় আমাগারে খোঁজ খবর নিতো। এ কিসের স্বাধীনতা? এই স্বাধীনতার মানে কী? তাদের কথার অর্থ তখন কিছুই বুঝতে পারিনি, শুধু এটুকু বুঝেছি, আমার মনিকা চাচি এ বাড়িতে আর নেই। সে চলে গেছে।

আলো আর আঁধার যে সবসময় সমান্তরাল চলে তখন তা বুঝিনি। গান্ধিজির অহিংস আন্দোলনে বৃটিশ হটলো বটে কিন্তু হিন্দু-মুসলমানে কিসের হিংসা যে জন্ম দিলো তার খবর কে রাখে। পাকিস্তানে মুসলমানরা হিন্দুদের ধরে ধরে নিধন করছে আর ওদিকে হিন্দুস্তানে চলছে মুসলমানদের উপর ঢালাও ভাবে উচ্ছেদ কার্যক্রম। এ কীসের স্বাধীনতা? কেমন স্বাধীনতা ? স্বাধীনতা লাভ হলে বুঝি ঘর ছাড়তে হয়।

একজন মুরব্বি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
-কান্দিসনা, কাইন্দা কী হইবো? যা হওয়ার তা তো হইয়াই গেছে। যা বাড়িত যা গিয়া। আমি এগিয়ে গেলাম মনিকা চাচির ঘরের দরজার সামনে। দেখলাম মস্ত একটা তালা ঝুলছে কিন্তু সে তালা বন্ধ অবস্থায় নেই, ভাঙ্গা অবস্থায় দরজার কড়ার সাথে ঈষৎ দুলছে। শয়তানরা নাকি তালা ভেঙ্গে বাড়িটিতে লুটপাট চালিয়েছে। দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকে চাচি চাচি বলে কয়েকবার ডাকলাম। কোনো সাড়া এলো না, জানি আসবেও না। তবুও আমি ডাকতে থাকলাম, চাচি চাচি। সিরু বলে সেই ডাক, আদর মাখা সেই মুখখানি আর কোনোদিন দেখেতে পাবো না ! কথাগুলো মনে হতেই কষ্টের একটা ঠেউ এসে বুকের ভেতরটা ভেঙ্গে চুরে একেবারে খান খান করে দিলো। মানিকা চাচিদের সেই আমগাছটির নিচে বসে আমি কাঁদছি। ক্ষাণিক পরে নন্দীদের পাশের বাড়ির মজিরন দাদি আমার কাছে এগিয়ে এলেন। আমাকে কাঁদতে দেখে তিনিও কেঁদে ফেললেন, কান্না মেশানো গলায় বললেন, -কান্দিস না ভাই, কান্দিস না। শয়তান-মানুষদের জ্বালায় থাকতো পারলো না। তোর কথা তোর চাচি ভুলে নাই। যাওয়ার সময়ে তোর কথা খুব কইতেছিলো। সে তোর জন্য একটা জিনিস দিয়া গেছে। মজিরন দাদির দিকে তাকিয়ে বললাম, কী জিনিস?
-খারা আমি আইতাছি। বলে দাদি তার বাড়িতে ফিরে গেলেন। ক্ষাণিক বাদে একটা বাছুর নিয়ে ফেরত এলেন। বাছুরের গলার দড়িটা আমার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন,
-তোর চাচি যাওয়ার সময় এই বাছুরডা আমার হাতে দিয়া কইলো,
-সিরুর জন্য খুব খারাপ লাগতেছে। মা মরা ছেলেটা আমার কাছে আসতো, খুব ভালো লাগতো। আর হয়তো কোনো দিন ওর সাথে দেখা হবে না। এই বাছুরটা ওর জন্য দিয়ে গেলাম।

কথাটা শুনে আমার বুকের ভেতরটা ফেটে যেতে চাইছিলো। আমি চিৎকার করে চাচি বলে কেঁদে উঠলাম। মজিরন দাদিও আমাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদলেন। দুপুরের একটু আগে বাছুরটা নিয়ে আমি বাড়ি ফিরলাম। আমার হাতে গরুর দড়ি দেখেই বাবা বললেন, তোর চাচি তোরে দিয়া গেছে না? আমি বললাম,
-হ্যাঁ। আফসোস করে বাবা বললেন,
-আহারে, খুব ভালো মানুষ আছিলো। শয়তানগুলার জ্বালায় ভিটা-মাটি ছাইড়া চইলা যাইতে হইলো। আল্লাহ তুমি ওই শয়তানগুলারে কোনোদিন মাফ কইরো না, কোনোদিন মাফ কইরো না।

চাচি চলে যাওয়ার পরে আমার পড়াশোনা আর হয়নি। কী করে হবে? অসুস্থ বাবা কোনো রোজগার করতে পারে না দু-বেলা পেট ভরে খাবারই জোটে না, তার উপর আবার পড়াশোনা। স্কুল নাই, পড়াশোনা নাই, সারাদিন বাছুরটা নিয়ে মাঠে চড়াতাম। বাছুরটা দেখতে ভারি সুন্দর। সারা গায়ে লাল রং শুধু মাথার উপরে টুপির মতো সাদা একটা ছোপ। বাছুরটাকে একবার দেখেই অন্য সকল বাছুর থেকে আলাদা করা যায়। সারাদিন আমি ওর সাথে সাথে থাকতাম। ওর সাথে কথা বলতাম, খেলা করতাম। মনে হতো মনিকা চাচি সব সময় আমার সাথেই আছেন। বাছুর বড় হলো বাচ্চা দিলো। দুধ বিক্রি করে আমাদের বাপ-বেটার সংসার বেশ চলছিলো। গরিবের কপালে সুখ সয় না তাই বুঝি বার্ধক্যের কারণে বাবাও একদিন আমাকে ছেড়ে চলে গেলেন। দেশে তখন পাকিস্তানি আমল তাই কেনো কিছুর কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। আজ এ বাড়ি ডাকাতি তো কাল ও বাড়িতে লুটপাট।

আমার গোয়ালে তখন তিনটা গরু। হঠাৎ একদিন উচুঁ লম্বা কয়েকজন অস্ত্রধারী লোক এসে আমার বৃদ্ধ গরুটা রেখে বাকি গরু দুইটা জোর করে নিয়ে গেলো। আমার প্রতিবেশি দু’চার জন যা আছে তারা সকলে ব্যাপারটা দেখলো কিন্তু কেউ কোনো কিছু বললো না। বলবেই বা কীভাবে, তাদের হাতে অস্ত্র। এই দেশে তখন মানুষ হত্যার কোনো বিচার নাই। মানুষ মারা আর কুকুর মারা সমান কথা। ধীরে ধীরে মানুষ তিক্ত হয়ে উঠলো। একদিন শুনলাম শেখ সাহেব নাকি রেডকোর্স ময়দানে ভাষণ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।” শোষণে নিপিড়নে জর্জরিত মানুষ তাঁর ভাষণ শুনে স্বাধীনতার নেশায় পাগল হয়ে উঠলো। ভাবলাম আবার স্বাধীনতা! এক স্বাধীনতায় যা হারিয়েছি তার মাশুল কোনোদিন শেষ হবে না। আবার স্বাধীনতার কথা শুনে মনে বড় ভয় হলো। খুব দ্রুতই দেশে যুদ্ধ বেঁধে গেলো। দিকে দিকে মুক্তিকামি নওজোয়ানদের দুঃসাহসিক যুদ্ধের কাহিনী আর জাগরণের গান শোনা গায়।

জাগরণের গান শুনতে বেশ লাগে। এদিকে মনিকা চাচির দেওয়া সেই গরুটা থেকে আরো একটা বাছুর জন্মেছে। এই যুদ্ধের মধ্যেও বাছুরটা তরতর করে বেড়ে উঠছে। খুব দ্রুতই সে একটি ষাঁড়ে পরিণত হচ্ছে। এমনিতেই আমাদের শহরটা খুব ছোট তার উপর যুদ্ধের কারণে শহরটা আরও ছোট হতে শুরু করেছে। দেখলাম শহরের হিন্দু-মুসলমান একসাথে পালাচ্ছে। এবার নাকী হিন্দু-মুসলমান কারো রেহাই নেই। জীবন আর মৃত্যুর ভয়ে মানুষ গ্রাম থেকে আরো গ্রামের দিকে পালাতে পালিয়ে যাচ্ছে। আমি থেকে গেলাম। একলা মানুষ পালানো সহজ কিন্তু গরু নিয়ে পালানো মুশকিল। মনিকা চাচির দেওয়া এই শেষ চি‎হ্ন ছেড়ে আমার পক্ষে কোথাও পালানো সম্ভব না।

ষাঁড় বাছুরটা বেশ বড় হয়েছে। সারাদিন সে খোলা মাঠে মনের সুখে চরে বেড়ায়। হঠাৎ একদিন চারিদিক থেকে গুলির শব্দ শুরু হলো। ষাঁড় বাছুরটা তখন মাঠেই চরে বেড়াচ্ছিলো। মনের মধ্যে অজানা এক আশঙ্কা নিয়ে দ্রুত গাভিটা ঘরে বেঁধে রেখে ষাঁড়টা খুঁজতে গেলাম। মাঠের কাছে আসতেই দেখলাম পাকিস্তানি সেনাদের দুই তিনজন আমার ষাঁড়টাকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে যাচ্ছে। জানি, ওদের হিংস্র হাত থেকে ষাঁড়টাকে বাঁচানো যাবে না। শূন্য হাত অথচ কোথায় যেন কষ্ট বয়ে বাড়ি ফিরে এলাম। এবার শুরু হলো ঘরে ঘরে মানুষ তল্লাশি। এক একবার ভাবতাম পাকিস্তানি সেনারা বোধ হয় মানুষ না। মানুষ হয়ে কীভাবে নিরপরাধ মানুষকে মারা সম্ভব! আমার বাড়িটা ছিলো শহরের একেবারে প্রান্তে। জীর্ণশীর্ণ ঘর, সাধারণ ভাবে দেখলে ওটাকে কোনো ঘর বলে মনে হয় না বলেই হয়তো আমি বেঁচে গেলাম। ধীরে ধীরে শয়তানরা শহরের বাড়ি-ঘর, দোকান-পাট সব জ্বালিয়ে দিলো।

একদিন দক্ষিণ পাড়ার বছির ভাইয়ের সাথে দেখা। তিনি বললেন,
-এইবার আর পার পাইবো না, ভারতীয় সেনারা মিত্র হইয়া একসাথে আক্রমণ চালাইবো। এইবার শয়তানগুলারে হার মানতেই হইবো।
তার কথা শেষ হলো কিন্তু যুদ্ধ অত সহজে শেষ হলো না। মরা মানুষ, মরা গরু ছাগল একসাথে পানিতে ভেসে চললো দিনের পর দিন তারপর একদিন শুনলাম দেশ নাকি স্বাধীন হয়েছে। হায়রে স্বাধীনতা! শহরের দুই তৃতীয়াংশ মানুষকে হারিয়ে তবে পেলাম স্বাধীনতা!
বছর দুই-তিন যাওয়ার পরে আমার গাভিটা আবার বাচ্চা দিলো। কিন্তু দুঃখের বিষয় বাচ্চা দেবার কিছু দিন পরে অজানা এক কারণে সে মরে গেলো। নতুন যে বাছুরটা হয়েছে এটা একটা মাদি বাছুর। সারাদিন বাছুরটার যত্ন করে সময় চলছিলো দ্রুত গতিতে। হঠাৎ একদিন শুনলাম শেখ সাহেবকে কারা নাকি হত্যা করেছে। মনের মধ্যে থেকে বলে উঠলো, এই ছিলো তাঁর স্বাধীনতা আদায়ের পুরস্কার! হায়রে স্বাধীনতা! তোমার নাগাল কোথায়? আর কতো মানুষ মরলে তোমার ছোঁয়া পাওয়া যাবে?

হঠাৎ বা হাতে কেটে যাওয়ার মতো একটা যন্ত্রণা সিরু চাচাকে তার স্বপ্ন থেকে বের করে আনলো। কাস্তের আঘাতে বুড়ো আঙুলের নিচের ক্ষাণিকটা জায়গা কেঁটে গেছে। একটা লতা ছিড়ে হাতের তালুতে চটকে নিলেন সিরু চাচা। ঘাস যা কাটা হয়েছে তা অতি সামান্যই। কাটা হাত নিয়ে আজ আর ঘাস কাটা যাবে না। কাস্তে আর বস্তা নিয়ে সিরু চাচা বাড়ির দিকে পা বাড়ালেন। কাঁকগুলো এখনও সেই খুঁটির উপর বসে আছে। তীক্ষ্ন দৃষ্টিতে তারা সিরু চাচার দিকে তাকিয়ে আছে। হাট হাট শব্দ করে কাঁকগুলোকে তাড়াতে চেষ্টা করলেন। কিন্তু না, কাঁকগুলো একটুও নড়ল না। যেভাবে বসে ছিলো সেভাবেই বসে রইলো। সিরু চাচার কেমন যেন ভয়-ভয় করছে। মনে সাহস সঞ্চয় করার চেষ্টা করলেন তিনি।

মনকে বোঝালেন, কাঁক দেখে ভয় কিসের। তবুও ভীত পায়ে ধীরে ধীরে তিনি সামনের দিকে এগিয়ে চললেন। হাতের কেটে যাওয়া অংশ দিয়ে ক্রমাগত রক্ত পড়ছে। সকাল থেকে কিছু খাওয়াও হয় নি। শরীরটা খুব দুর্বল লাগছে। বাড়ি ফিরে হাতটা ধুয়ে পুরোনো একটা কাপড় কাটা অংশে বেঁধে মঙ্গলকে ঘর থেকে বের করলেন। ঘরের চালের উপর থাকা জামগাছটার দিকে তাকিয়ে দেখলেন, কতোগুলো কাঁক গাছটার উপরে বসে আছে। ব্যাপার কী? ভাবতে থাকে সিরু চাচা। কাঁকগুলো কী চায়? মঙ্গলের সামনে ঘাসগুলো রেখে গতকালের পান্তা নিয়ে বসলেন তিনি। কব্জি সমান পানির নিচে অল্প কিছু ভাত। মঙ্গলের দিকে তাকিয়ে সিরু চাচা ভাত চটকাচ্ছেন। মঙ্গলের জন্য বুকের মধ্যে খুব মমতা হয়। এই মমতাই তো তাকে বাঁচিয়ে রেখেছে। মনিকা চাচির দেওয়া শেষ চি‎হ্নটা আর কতদিন তিনি আগলে রাখতে পারবেন তা তার জানা নেই।