রেজাউর রহমান পারভেজ : আমি নেপালে গিয়ে হিমালয় পর্বতে আরোহন করি। আজ সেই নেপাল নিষ্ঠুর নির্মম ভূমিকম্পের ছোবলে আক্রান্ত। গত ২৬ শে এপ্রিলে স্মরণকালের ভয়াবহ ভূমিকম্পে লন্ড-ভন্ড হয়ে গেছে। সাম্প্রতিক ভূমিকম্পে নিহত মানুষের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাচ্ছি। সেই সঙ্গে যারা আহত হয়েছেন তাদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করে আমি আমার হিমালয় আরোহণের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরছি।

নেপালের সময় ২.৪০ মিঃ কাঠমান্ডু ত্রিভুবন এয়ার পোর্টে অবতরণ করি বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের ফ্লাইটে। সেখান থেকে এক মাসের অন এরাইভেল ভিসা সংগ্রহ করি। তারপর টেক্সিতে চড়ে কাঠমান্ডুর থামেল এ পৌঁছে হোটেলে উঠি। আমার ট্রেকিং ও এক্সপেডিশন বন্ধু করমা শেরপা ও পেমবা শেরপার সাথে মিলিত হই এবং এভারেষ্ট বেইজ ক্যাম্প ও আইল্যান্ড পিকে যাওয়ার যাবতীয় কাগজপত্র মাউন্টটেইন গিয়ার ও অন্যান্য মালামাল নিয়ে প্রস্তুতি গ্রহণ করিতে ২ দিনের সময় লেগে যায়। এরপর এই বৎসরের এপ্রিল মাসের ভোর ৭ টায় সিমরিক এয়ার লাইন্স এ ১১ জন যাত্রী নিয়ে লুকলার উদ্দেশে কাঠমান্ডু ত্যাগ করি এবং সেখানকার সময় ৭.৪০ মিনিটে লুকলা (৯,৪০০ ফুট) পৌঁছে যাই।

রেষ্টুরেন্টে ভালমত নাস্তা খাওয়ার পর কিছুটা সময় একলিমেটাইজেশন করি। তারপর ঐ দিনই এভারেষ্ট বেইজ ক্যাম্প (১৭,৪০০ ফুট) উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। আমি ২ জন শেরপা ও ২ জন পোর্টারসহ মোট ৫ জনের একটি দল সকাল ১১.০০ টায় রওয়ানা শুরু করি। ট্রেকিং ট্রেইল খুব একটা চওড়া না মাঝারী ধরণের কিন্তু কোন কোন জায়গায় সাংঘাতিক খাড়া এবং অসংখ্য ছোট বড় পাথরে ভর্তি হয়ে আছে ট্রেইলের উপরে। কিছু বিশ্রাম নিয়ে অনবরত ৫/৬ ঘন্টা ডি’কোশি নদীর ধার ধরে হাটার পর পাকডিং (৮,৬০০ ফুট) পৌঁছাই বিকালে। পরের দিন সকাল ১০.০০ টায় সাগর মাথা ন্যাশনাল পার্ক মঞ্জু উদ্দেশে রওয়ানা দেই এবং সেখান থেকে এট্রি ফি দিয়ে রেজিষ্ট্রেশন কার্ড সংগ্রহ করি। জোরসালে পরে ২ টা ২৫০-৩০০ মিটার লম্বা ঝুলন্ত ব্রীজ পার হয়ে অনবরত ৩ ঘন্টা খাঁড়া উচ্চতায় নামচি বাজার (১১,৪০০ ফুট) পৌঁছে যাই। এছাড়া আরও কয়েকটি ঝুলন্ত ব্রীজ আছে লুকলা থেকে এভারেস্ট বেইজ ক্যাম্প পর্যন্ত। ১ দিন নামচি বাজারে একলিমেটাইজেশন করি। কারণ, কম অক্সিজেন শরীরের সাথে যাতে খাপ খাওয়ায়, শ্বাস প্রশ্বাসে সমস্যা না করে ও শরীর দুর্বল না হয়।

পাহাড়ে উচ্চতা জনিত রোগ যে কোন সময় হতে পারে এজন্য আস্তে আস্তে যাওয়া ও প্রচুর পরিমাণে উচ্চমাত্রার ভাল খাওয়া ও কিছু পরিমাণে ঔষধ কাঠমান্ডু থেকে নিয়ে যেতে হবে। কিছু ট্রেকিং ও এক্সপেডিশন যন্ত্রপাতি যেমন ট্রেকিং পোল, রেইন কোট, সান গ্লাস এবং ক্লাইমবিং এর জন্য এক্সপেডিশন ড্রেস, ডাউন জেকেট, ট্রেকিং ও ক্লাইমবিং জুতা, তাবু, ক্রেমপন, স্কার্ফ, হেড লাম্প, স্লিপিং ব্যাগ ও কিছু মাউন্টেন গিয়ার নিয়ে যেতে হবে। পরবর্তী দিন সকাল ৯.৩০ মিনিটে আবার নামচি বাজার থেকে টেংবোচির দিকে ট্রেকিং শুরু করি। এখানে উল্লেখ্য যে, নামচি বাজার থেকে কিছুটা দুরে কুন্ডে হাসপাতাল ও পেরিচি নামক স্থানে ইমারজেন্সি হাসপাতাল আছে উচ্চতা জনিত রোগের চিকিৎসার জন্য। মেডিকেল ইনসুরেন্স করে নিলে ভাল কারণ অসুস্থ্য অবস্থায় জরুরী কোন উদ্ধার কাজে সাহায্যে পাওয়া যাবে। যাই হোক, ৬/৭ ঘন্টা ট্রেকিং করার পরে টেংবোচি (১২,৬২৮ ফুট) পৌঁছে যাই। সেখানে টেংবোচি মনেসটেরিতে ও পার্শ্ববর্তী গ্রামে যাই দেখার জন্য।

অভূতপূর্ব পাহাড়ের সৌন্দর্য্য চারিদিকে একাকার হয়ে আছে। সেখান থেকে দিন রাত বিশ্রাম শেষে কিছুটা নীচে আবার খাঁড়া উচ্চতায় এভাবে করে অবশেষে পেরিচি (১৪,২৩৫ ফুট) পৌঁছাই এবং সেখানে একলিমেটাইজেশন করার জন্য ১ দিন বিশ্রাম করি এবং সেখান থেকে ৫/৬ ঘন্টা ট্রেকিং করার পর লোবুচি (১৬,০৭২ ফুট) পৌঁছাই এবং পরের দিন সেখান থেকে কিছু এলাকা অনেকটা সমান জায়গার মতো এভাবে ৫ ঘন্টা অতিবাহিত হওয়ার পরে গোরাক শেপ (১৬,৭২৮ ফুট) পৌঁছে যাই। পুরোদিন বিশ্রাম নেওয়ার পর পরের দিন নিজেকে ফাইনাল পুশ ডাউন করি ও কালাপাথর পার হয়ে এভারেস্ট বেইজ ক্যাম্প (১৭,৫৪৮ ফুট) পৌঁছাইতে সময় নিয়েছিল ৪ ঘন্টার মতো। অবশেষে ক্লান্ত শরীরে ২ দিন বিশ্রাম নেওয়ার পর আমার শেরপারা ও পোর্টাররা তাবু সেটআপ করে এবং রান্নাবান্না শেষে খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থা করে।

এখানে তাপমাত্রা তখন -১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর মতো এবং বাতাসে অক্সিজেন পরিমাণ আনুমানিক ৫৫ শতাংশের মতো থাকে সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে। এখানে সাবধানে থাকতে হয় খুম্ভু তুষারপতন ও তুষার ঝড় থেকে। এখানে, আবহাওয়া প্রতি ঘন্টায় অথবা যে কোন সময় দ্রুত পরিবর্তীত হতে পারে। প্রচন্ড ঠান্ডা ও ঘন্টায় ২০/৩০ কিলোমিটার স্পীডে বাতাস বইছে বাইরে এমন অবস্থায় সেদিন রাত কাটাই তাবুর অভ্যন্তরে স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে কিছুটা সময় ঘুমিয়ে। এভারেস্ট বেইজ ক্যাম্পে ২ দিন একলিমেটাইজেশন করেছি ভাল শারীরিক অবস্থার জন্য। পরের দিন ভোর ৪.০০ টায় উঠে ৬.৪৫ মিনিটে এক্সপেডিশন ক্লাইমবিং শুরু করি বেইজ ক্যাম্প-১ উদ্দেশ্যে। খুম্ভু আইস ফল ও পপ কর্ন এরিয়া পার হয়ে আস্তে আস্তে দুপুরের দিকে ক্যাম্প-১ (১৯,৩৫২ ফুট) পৌঁছে যাই এবং সেদিনের জন্য সেখানে তাবু করা হয়। আমার শেরপারা আমাকে অনেক সাহায্যে করে বিভিন্ন ভাবে। সেদিন বিশ্রাম নিয়ে পরের দিন আবার ভোর রাতের দিকে শেরপারা লেডার দিয়ে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়ে গ্লেসিয়ার ও আইস শেল অতিক্রম করে ক্যাম্প-২ (২০,৯৯২ ফুট) পৌঁছে যাই।

প্রত্যেকটা এসেন্ট সকাল থেকে শুরু হওয়া উচিত। কারণ, সকালে আবহাওয়া ভাল ও বাতাসের গতি তুলনা মূলক ভাবে কম থাকার সম্ভাবনা থাকে। তাবুতে থাকা অবস্থায় উচ্চ মাত্রার খাওয়ার ও বেশি পানি খেতে হবে ও ঘুমের বড়ি খাওয়া যাবে না। অনেক বেশি ওজনের রাকসাক পিঠে বহন করতে হয়েছে। মারাত্মক উচ্চতা জনিত (অপঁঃব গড়ঁহঃধরহ ঝরপশহবংং) রোগ এমনকি ফুসফুস ও ব্রেইনে ইডেমাও হতে পারে যে কোন সময়। মনে পড়ে, তুষার আবৃত পর্বত শৃঙ্গের অপরূপ মনোলোভা ও শ্বাসরুদ্ধকার সৌন্দর্য্যের কথা। যা কোন দিনও ভূলা যাবে না। খুম্ভু ভ্যালিতে (এভারেস্ট অঞ্চল) আমাডাবলাম, চোওয়্যু, লোতছি, নুপছি, পমরি ইত্যাদি অতি উচ্চতার মাউন্টেইন পরিদর্শন করতে পারেন। ঠান্ডার মাত্রা আগের চাইতে আরও বেড়ে গেল তা প্রায় -২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এবার ক্যাম্প-২ তে ১ দিন পুরাদস্তুর একলিমেটাইজেশন করি। এখানে ক্লাইমবিং এর জন্য কড, আইস এক্স ইত্যাদি মাউন্টেইন গিয়ার, ব্ল্যাক ডায়মন্ড কোম্পানীর ও আমেরিকান তাবু হলে সবচেয়ে ভাল হবে। ১ দিন বিশ্রাম করে তারপরের দিন ক্লাইমবিং করে এবং লেডার দিয়ে ক্রিভাসি (খোলা ফাঁকা স্থান) পার হয়ে প্রায় পুরো দিন লেগে যায় ক্যাম্প-৩ (২৩,২৮০ ফুট) এর কাছাকাছি পৌঁছাতে। এখানে আসার পরে অক্সিজেন মাস্কের মাধ্যমে ৪ লিটার ক্যাপাসিটি অক্সিজেন সিলিন্ডার বহন করতে হয় এবং অক্সিজেন নিতে হয় দ্রুত ও গভীর নিঃশ্বাসের জন্য অথবা নিঃশ্বাসের সমস্যা দেখা দিলে।

সেখানে অর্থাৎ ক্যাম্প-৩ এর কাছাকাছি জায়গায় আবার বিশ্রাম নিই। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত ঠিক সেই দিন থেকেই প্রচন্ড তুষারপাত ও এভালাঞ্চ সহ বৈরী আবহাওয়া শুরু হয়। এভাবে ৩ দিন অনবরত চলতে থাকে। অনেক পর্বতারোহী অসুস্থ্য হয়ে পড়ে। যদিও আমার সামিট বা শিখর বিজয় সম্ভব হয়ে উঠে নাই। তবে সৌখিনতার ও এভারেষ্ট বরফের সৌন্দর্য্য উপভোগ করার জন্য ঋতু ও আবহাওয়া বুঝে যে কোন সৌখিন ও আর্থিক স্বচ্ছল ব্যক্তি আসতে পারেন এভারেস্ট বেইজ ক্যাম্প অথবা উপরের দিকে যে কোন উচ্চতা পর্যন্ত। তবে পূর্ব অভিজ্ঞতা ও ট্রেনিং এ ক্ষেত্রে বিশেষ প্রয়োজন। যদিও এই ধরনের অভিযান ব্যয় বহুল। বৈরী আবহাওয়া না থামার কারণে আমি ও শেরপারা সবাই মিলে ক্যাম্প-২, ক্যাম্প-১ হয়ে এভারেস্ট বেইজ ক্যাম্পে ফিরে আসতে বাধ্য হই। পরবর্তীতে আমি আবার এভারেস্ট বিজয়ের জন্য চেষ্টা করবো। যদিও এভারেস্ট বিজয় করা সবচেয়ে বড় কথা নয়, সৌন্দর্য্য দেখাটাই বরঞ্চ বড় ব্যাপার। পরে এভারেস্ট বেইজ ক্যাম্পে ১ দিন বিশ্রাম নিয়ে গোরাক শেপ, লোবুচি হয়ে ডিংবোচি (১৪,৪৩২ ফুট) ফিরে আসি। ডিংবোচিতে ফিরে এসে ভাবলাম এবং আইল্যান্ড পিক (২০,৯৮৫ ফুট) এক্সপেডিশন করার সিদ্ধান্ত নিলাম শেরপাদের সঙ্গে আলোচনা করে।

ঠিক পরের দিন যাত্রা শুরু হলো আইল্যান্ড পিক সাকসেস ফুল সামিট বিজয় করার উদ্দেশ্যে। ডিংবোচি থেকে ৪ ঘন্টা ট্রেকিং করে চুখুং (১৫,৫১৪ ফুট) পৌঁছালাম এবং সেখান থেকে কয়েক ঘন্টা ট্রেকিং করে কালভার্ট পার হয়ে ডান পাশ দিয়ে এবং তারপর তুষার ও গ্লেসিয়ারের অতিক্রম করে আইল্যান্ড পিক বেইজ ক্যাম্পে (১৬,৮৯২ ফুট) পৌঁছালাম। সেখান থকে ১ দিন বিশ্রাম নিয়ে পরের দিন তুষার, গ্লেসিয়ারের ও আইস শেল অতিক্রম করে খাড়া উচ্চতায় আইল্যান্ড পিক হাই ক্যাম্প (১৯,০২৪ ফুট) এসে পৌঁছাই। সেখানে তাবুতে এবং রান্না হওয়ার পরে খাওয়া দাওয়া করে আধা দিন তাবুতে বিশ্রাম নিলাম। সেই দিনই রাত ৩ টায় থেকে প্রস্তুতি শুরু হয় এবং অক্সিজেন ব্যবহার করে প্রায় ভোরের দিকে ৬ ঘন্টা ধরে গ্লেসিয়ার ও ক্রিভাসি পার হয়ে এবং খাড়া উপরের দিকে রিজ লাইন বরাবর সরু গর্গ দিয়ে ক্লাইমবিং করে আইল্যান্ড পিক সামিট (২০,৪০০ ফুট) জয় করিলাম। সামিট জয়ের আনন্দ যেটা ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়। পরের দিন সামিট থেকে নেমে আইল্যান্ড পিক বেইজ ক্যাম্পে ফিরে আসি। তারপর পথে পথে বিশ্রাম নিয়ে ডিংবোচি, নামচি বাজার, পাকডিং, চাপলুং হয়ে ৩ দিন পর প্রথমে লুকলা এবং পরে কাঠমান্ডু এসে পৌঁছাই ছোট এয়ার প্লেনে করে।

শেরপা ও পোর্টারদের পারিশ্রমিক দেওয়া হয়। অবশেষে তাদের পক্ষ থেকে আমার জন্য নৈশ্য ভোজের মাধ্যমে তিব্বতের আদলে ফেয়ারওয়েল সিল্কের ওড়না গলায় দিয়ে শেষ হয় এই নেপাল দুঃসাহসিক খুম্ভু ভ্যালি অভিযান। নামচি বাজার, খুমজুং এবং সানাসা হয়ে কেউ চাইলে বেশ কিছুটা দূরে গোকিয়ো ভ্যালি ও তুষার আবৃত রেনজো পাস (১৭,৩৮৪ ফুট) ট্রেকিং করে ভ্রমণ করতে পারেন। সুযোগ পেলে ও ভিসা সংক্রান্ত বাধা না থাকলে অমেরিকার ডেনালী পর্বত (আলাস্কা) ও রকি মাউন্টেইনের (কোলোরাডো) কিুছু লেক ও হাই পাস এবং হ্যালেট পিক সামিট জয় করার তীব্র ইচ্ছা অবশ্যই রইল।