নাটোর প্রতিনিধি : নাটোর সদর উপজেলার দত্তপাড়া এলাকায় ৩টি ইটভাটার নির্গত কালো ও বিষাক্ত ধোঁয়ায় কার্বন মনোক্সাইডের প্রভাবে ভাটা সংলগ্ন প্রায় সাড়ে তিন’শ বিঘা জমির আমবাগানের উঠতি আম পচে নষ্ট হচ্ছে।

এছাড়া বাগানের কাঁঠাল, লিচু নারিকেল গাছের ব্যাপক ক্ষতি ও ফসলী জমি গ্রাসসহ পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটছে। বাগান মালিকের অভিযোগ গত তিন বছর ধরে জেলা প্রশাসন, কৃষি বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে বিষয়টি অবহিত করা হলেও কার্যত কোন পদক্ষেপই নেয়া হয়নি। এতে ক্ষতিগ্রস্ত বাগান মালিকসহ এলাকাবাসীদের মাঝে ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। একই সাথে বিধি লংঘন করে নিষিদ্ধ এলাকাসহ তিন ফসলি জমিতে ভাটা নির্মাণের অনুমতি দেওয়ায় পরিবেশ অধিদপ্তরের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ এনেছে এলাকাবাসী।

স্থানীয়রা জানায়, দত্তপাড়া এলাকায় ৫টি ইট ভাটা গড়ে তোলার শুরু থেকেই এলাকার লোকজন প্রতিবাদ করে আসছে। কিন্তু তারা প্রভাবশালী হওয়ায় এবং প্রশাসনের ছত্রছায়ার কারনে দেদারছে ভাটায় ইট পোড়াচ্ছে। সম্প্রতি পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে এসব ইটভাটা বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হলেও তা এখন বন্ধ করা হয়নি। এমনকি ভাটা স্থানান্তরের ব্যবস্থা নেয়নি কর্তৃপক্ষ। ফলে এসব ইট ভাটার কারনে আশপাশের আম, কাঠাল, লিচু,কলা ও নারিকেল গাছসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে। এমনকি ভাটার নির্গত কালো ধোঁয়ায় বিষাক্ত কার্বন মনোক্সাইড, কার্বন ডাইঅক্সাইডসহ ১৬টি ক্ষতিকর উপাদান থাকায় এলাকার গর্ভবতী মা ও শিশুসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ রোগবালাইয়ের শিকার হচ্ছে।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, নাটোর শহর থেকে অদুরে দত্তপাড়ার গাজীপুর বিলে নাটোর-ঢাকা মহাসড়ক ও গ্রামীণ সড়কের পাশেই জনৈক আবুল কাশেমের সাড়ে তিন’শ বিঘা জমির আম বাগানের পুর্ব পার্শ্বে হাজী আব্দুর রশিদের এপিসি ব্রিকস,পশ্চিমে সুলতান হাজির একেসি ব্রিকস এবং কিছু দুরে লিয়াকত আলীর এবিসি ব্রিকস গড়ে তোলা হয়েছে। এসব ব্রিকসের পাশেই রয়েছে বাগানসহ বিভিন্ন ফসলের জমি। এই অবস্থা শুধু দত্তপাড়ায় নয়, জেলার অন্যত্রেও একই চিত্র লক্ষ্য করা গেছে। খোজঁ নিয়ে দেখা গেছে, বড়াইগ্রাম উপজেলার মাঝগাঁও ইউনিয়নের ছাতিয়ানগাছা গ্রামে ইটভাটা থেকে নির্গত দুষিত বাতাসে ২০ একরের অধিক বাগানের আম, ৩০ একর জমির কাঁঠাল, লিচুসহ সকল ধরনের ফল নষ্টের অভিযোগ পাওয়া গেছে। একই অবস্থা নলডাঙ্গা উপজেলার ত্রিমোহনী এলাকায়। স্থানীয় ইটভাটার কারনে কৃষক জিয়ার ৪৬টি আম গাছের আম পচে নষ্ট হয়েছে।

দত্তপাড়ার আম বাগানের মালিক আবুল কাশেম অভিযোগ করেন, এসব ইট ভাটার কালো নির্গত ধোঁয়ার কারনে তার বাগানের ১২’শ গাছে মাত্র ৬০ ভাগ আম এসেছে। কিন্তু পাকার আগেই অধিকাংশ আম পচে নষ্ট হয়ে গেছে। গাছের আমগুলো কালো আকার ধারন করে ঝরে পড়ছে। এই বাগান থেকে তাকে প্রতি বছরে কোটি টাকা লোকসান গুনতে হচ্ছে। অথচ মাত্র দুই কিলোমিটার দুরে অন্য তিনটি বাগানে আমের অবস্থা খুবই ভাল। ইট ভাটার কারনে গত কয়েক বছর ধরে এই বাগানে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বিষয়টি গত তিন বছর ধরে জেলা প্রশাসন, কৃষি বিভাগ ও পরিবেশ অধিদপ্তরকে অবহিত করেও কোন কাজ হয়নি। তিনি অভিযোগ করেন, এসব ইটভাটায় সরকারী কোন নিয়ম অনুসরণ করা হচ্ছে না। ২০১৪ সালে জুলাই মাসে সরকার এসব ইট ভাটা বন্ধ করে দিলেও মালিকরা প্রশাসনের নাকের ডোগায় ইট প্রস্তুত অব্যাহত রেখেছে।

দত্তপাড়ার দক্ষিণপুর এলাকার আব্দুর রাজ্জাক জানান, ইট ভাটার ধোঁয়ার কারনে শুধু এই বাগানই নয়, এলাকার অধিকাংশ ব্যক্তির বাগানে আমের পচন ধরেছে। পচন ধরা আম ঝড়ে পড়ছে। একই সাথে লিচু, কাঁঠাল, কলাসহ অন্যান্য ফলেও পচন ধরেছে। সেগুলো যথা নিয়মে ঝড়ে যাচ্ছে। শুধুমাত্র তাকিয়ে দেখা ছাড়া আর কোন উপায় নেই বলে জানান। গাজিপুর এলাকার আব্দুল মোত্তালিব জানান, তাদের গাছের অধিকাংশ আম পচে গেছে ইটভাটার দুষিত বাতাসে। এবারও ছেলে-মেয়েদের আম খাওয়াতে পারবেন না। আম বিক্রি করে তাদের সংসারের খরচ চলে অথচ এবার তাদের পথে বসতে হবে।

আম ব্যবসায়ী ওসমান আলী জানান, এক একর বাগানের আম ৪ লাখ টাকায় ক্রয় করেছিলাম। ওই বাগানে ৩০ হাজার টাকার আমও অবশিষ্ট নাই।

সংশ্লিষ্ট সুত্র জানায়, কোন ফসলি জমি, মসজিদ, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও সরকারি বা ব্যাক্তি মালিকানাধীন কোন ফল বাগান বা বনের পাশে কোন ইটভাটা করা যাবে না এমন নির্দেশনা থাকলেও নাটোরে এসব নিয়মনীতির তোয়াক্কা করছেন না ইটভাটা মালিকরা। উপরোন্ত কেউ প্রতিবাদ করতে গেলে ভাটা মালিক ও প্রশাসনের কতিপয় কর্মকর্তার কাছে নাজেহাল হতে হয়। সুত্রমতে জেলায় অন্তত ১১২ইট ভাটা রয়েছে। হাতে গোনা দু’একটি ইটভাটা পরিবেশ বান্ধব হলেও প্রায় সবগুলোই পরিবেশের অনুকলে নয়। কেউ কেউ ফসলী জমিতে সস্তাদামে কৃষকের কাছ থেকে মাটি কিনে ইট প্রস্তুত করছে। বিধি মোতাবেক চিমনি ব্যবহার করছে না। ফসলী জমিতে ইট ভাটা করে শুধু জমিই নষ্ট আর উর্বরতা কমছে না, তারা পরিবেশের বারটা বাজিয়ে দিচ্ছে। ফলে মানুষ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর রাজশাহী আঞ্চলিক অফিসের ভারপ্রাপ্ত উপ-পরিচালক নুর আলম জানান, নাটোর জেলায় প্রায় ১১২টি ইট ভাটা আছে। এসব ভাটা মালিককে পরিবেশ বান্ধব করতে বলা হয়েছে। সরকার পরিবেশ বান্ধব পদ্ধতিতে ইট প্রস্তুতের জন্য গ্রীন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মাত্র ৫ শতকরা সুদে ব্যাংক ঋণ সুবিধা দিচ্ছে। অথচ ভাটা মালিকদের সেদিকে ভ্রক্ষেপ নেই।

এদিকে দত্তপাড়া এলাকার আবু হানিফ অভিযোগ করেন, ভাটা মালিকরা সরকারি নীতিমালা তোয়াক্কা না করে তাদের খেয়াল খুশি মত এবং প্রশাসনের যোগসাজসে ইটভাটায় ইট প্রস্তুত অব্যাহত রেখেছে। নিয়মানুসারে ১২০ ফুট উঁচু চিমনি তৈরির কথা থাকলেও এসব ইটভাটার মালিকরা মাত্র ৬০ ফুট উঁচু চিমনি ব্যবহার করছেন। জ্বালানী হিসাবে কাঠ ব্যবহার করা হচ্ছে। কৃষি জমি থেকে মাটি এনে জমির উর্বরতা বিনষ্ট করা হচ্ছে। এই বিলে ৫টি ইটভাটা কৃষি জমি গিলে খাচ্ছে।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক ডঃ আলহাজ্ব উদ্দিন জানান, ইটভাটার দুষিত বাতাসের কারনে অনেক সময় ফলের ক্ষতি হয়ে থাকে। গাজিপুর বিলের আমবাগানে কেন আমসহ অন্যান্য ফল নষ্ট হচ্ছে তা ক্ষতিয়ে দেখতে ইতিমধ্যে লোকজন পাঠানো হয়। খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে এসব ভাটার নির্গত ধোঁয়ায় কার্বন মনোক্সাইড ও কার্বন ডাইঅক্সাইডের প্রভাবেই ওই বাগানের আমের এমন ক্ষতি হয়েছে। কেমিকেল টেষ্টের জন্য আম পরীক্ষাগারে পাঠানো হয়েছে। বিষয়টি উর্ধতন কর্তৃপক্ষসহ আগামী জেলা উন্নয়ন সমন্বয় সভায় জেলা প্রশাসনকে অবহিত করা হবে। তবে তিনি আক্ষেপ করে বলেন, যে দপ্তরের এই বিষয়টি দেখা উচিৎ তারাই রহস্যজনক নিরবতা পালন করছে। তিনি জানান, ইটভাটার কারনে জেলায় ২৬২ হেক্টর কৃষি জমি নষ্ট হয়েছে।

এদিকে ইটভাটার মালিক আব্দুর রশিদ, সুলতান হাজী ও লিয়াকত হোসেন এসব অভিযোগ অস্বীকার করে জানান, প্রায় ১৫ থেকে ২০ বছর আগে থেকে তাদের ইটভাটা চলছে। ভাটা করার পরে ওই বাগান তৈরি করা হয়েছে। ইটভাটার কারণে কোন ক্ষতি হয়নি, হয়তো শিলা-বৃষ্টি বা আবহাওয়া জনিত কারণে আমসহ অন্যান্য ফলে পচন ধরেছে। তারা বিধি সম্মত আধুনিক পদ্ধতিতে ইট প্রস্তুত করছেন।

নাটোরের জেলা প্রশাসক মশিউর রহমান জানান, এ বিষয়ে তার কিছুই জানা নেই। কেউ অভিযোগ করেনি। এছাড়া ইট ভাটার কারনে এত বিপুল পরিমানের আম নষ্ট হয়ে যাওয়ার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই তার কাছে। বিষয়টি পরীক্ষা নিরিক্ষার পর বলা সম্ভব হবে।

রাজশাহী বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক একেএম মাসুদুজ্জামান জানান, নাটোরে অধিকাংশ ইটভাটা মালিকের পরিবেশগত ছাড়পত্র ছিল না। আধুনিক এবং পরিবেশ সম্মত ইটভাটা প্রস্তত না করা পর্যন্ত এই সকল ইট ভাটা মালিককে ভাটা বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে যেসমস্ত ইটভাটা পুর্বের করা এবং তাদের ভাটার পার্শ্বে ফসলী জমি কিংবা বন, ফলজ বাগান আছে। সে সমস্ত ইটভাটার মালিকরা আধুনিক পন্থায় অবলম্বন করে থাকে, তাহলে আগামী ২০১৬ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময় পাবে। দত্তপাড়ার আম বাগান মালিকের পক্ষ থেকে লিখিত কোন অভিযোগ পাওয়া যায়নি। অভিযোগ পেলে তা প্রমাণিত হলে ওই ইট ভাটা তৈরির কাজ বন্ধ করা সহ মালিকের বিরুদ্ধে আইন অনুসারে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

(এমআর/এএস/মে ১৪, ২০১৫)