শেখর রায় : সম্প্রতি অধ্যাপক জাফর ইকবাল, সজীব জয় ও সরকারি দলের এক সিলেটের সাংসদের কিছু কথাবার্তা ঘিরে ইসলামি মৌলবাদ হঠাৎ সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তারা এই মুক্তিযুদ্ধের ধারক মুক্তমনা যশস্বী সাহিত্যিক ও শিক্ষাব্রতী মুহম্মদ জাফর ইকবালকে কুলাঙ্গার সিলেট ছাড় ইত্যাদি অমর্যাদাকর শ্লোগান প্রদর্শন করছে।

ওই সাংসদ শ্রদ্ধেয় শিক্ষককে চাবুক পেটা করা উচিত বলে হুমকি দেয়ার অভিযোগ এনে বিডি নিউজে জনাব আবেদ খান প্রতিবাদ করেছেন। তিনি বলেছেন যে মুক্তচিন্তার ধারক ব্লগার অনন্তকে যখন মৌলবাদী জঙ্গিরা প্রকাশ্য দিবালোকে কুপিয়ে হত্যা করল তখন তার প্রতিবাদ করেছিলেন জাফর ইকবাল। সজীব ওয়াজেদ জয়কে বিবিসি থেকে ব্লগার খুন নিয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি যে উত্তর দিয়েছিলেন সেটা বাংলাদেশের পরিস্থিতি বিবেচনায় প্রাসঙ্গিক হলেও জাফর ইকবালের প্রতিক্রিয়াটি অসত্য বলা যাবে না ।

আবেদ খানের মতে সেই সাংসদের এটা বোঝার ক্ষমতাও তার নেই যে, এই উক্তির মাধ্যমে এদেশের লক্ষ-কোটি তরুণ প্রজন্ম, যারা জাফর ইকবালের অনুপ্রেরণায় বাংলাদেশ চিনতে শিখেছে, বঙ্গবন্ধুকে অন্তর দিয়ে ভালোবাসতে শিখেছে, বঙ্গবন্ধুকন্যার আন্তরিকতার ওপর আস্থা রাখতে শিখেছে, তারা কী প্রচ- ক্ষুব্ধ হয়েছে। এই জাফর ইকবালই তাদের শিখিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস, জেলায় জেলায় তরুণ প্রজন্মকে উদ্বুদ্ধ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা হৃদয়ে ধারণ করতে, চিনিয়েছেন স্বাধীনতাবিরোধী শক্তির স্বরূপ এবং রূপান্তর। তিনি যাঁকে চাবুক মারতে চেয়েছেন সেই জাফর ইকবাল বিদেশে সর্বোচ্চ ডিগ্রি লাভের পর বিদেশে অর্থসম্পদ বৈভবের প্রলোভন উপেক্ষা করে উচ্চশিক্ষিত স্ত্রীকে সঙ্গী করে দেশে এসেছেন; বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বিত্তের হাতছানি অবলীলায় প্রত্যাখ্যান করে সিলেটের শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষা এবং জ্ঞান বিতরণের আশ্রম হিসেবে গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন; সুস্থ শিক্ষার জন্য, উন্নত শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য, নতুন প্রজন্মকে সত্য ও ন্যায়ের সাধকে পরিণত করার জন্য প্রাণপাত করে চলেছেন।

আমার মনে হয়, সকল বাদী বিবাদীর এই বাংলা ট্রিবিউনে আনিস আলমগীর মহোদয়ের লেখাটিও পাঠ করা দরকার। সেখানে তিনি বলেন যে সজীব এমন কিছু বলেন নি যাতে মনে হতে পারে তিনি কাউকে কোন আক্রমণ করে কিছু বলেছেন যা নিয়ে কারো কোন প্রতিবাদ করার দরকার ছিল। সে অতি সাধারণ কথা বলেছে। তার কথায় মনে হয় না যে সে সাম্প্রদায়িক শক্তির হাত শক্ত করছেন। আর ধর্ম নিরপেক্ষতা মানে কি নাস্তিকতা নাকি। কখনই নয়। কিন্তু যারা নাস্তিক তারা না ধার্মিক না ধর্ম নিরপেক্ষ। আর এটা নিয়ে ভুল বুঝিয়ে লাভ নেই। আর অকারণ বাজার গরম করেও লাভ হবে না। লক্ষ্য করলাম যে শুধু কিছু বামপন্থী প্রতিবাদ ছাড়া অন্য কেউ কিছু তেমন বলছেন না। কারণ হয়ত তারা বুঝেছেন যে এই বাদানুবাদে দেশ দশের কোন মৌলিক সমস্যা সমাধানের কথা আসছে না। উল্টো কিছু অসামাজিক সাম্প্রদায়িক শক্তিকে হাওয়া দেয়া হচ্ছে।

আজ তারা কেন স্বীকার করছেন না যে যেটুকু মুক্ত পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে তাকে কিছু সামাজিক দস্যু দূষিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বহু কাল পর এই প্রতিবেশী দেশে সুস্থিরতা ফিরে এসেছে যদিও পাশাপাশি সামাজিক, ধার্মিক, দুর্নীতি, দুর্বৃত্তের আক্রমণ চলছে। তার মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে শুরু হয়েছে বিশাল উন্নয়নের কাজকর্ম শেখ সাহেবের স্বপ্ন সার্থক করতে। কেন বুদ্ধিমান দেশপ্রেমী মানুষ এই অতি ধৈর্যশীল সাংস্কৃতিক গুণ সম্পন্ন প্রধানমন্ত্রীকে কিছু সময় দেবেন না? তিনি তো মানুষের মঙ্গলের জন্য চেষ্টা কিছু কম করছেন না। তার ভাল ইমেজের জন্য ভারতসহ সারা বিশ্ব সাহায্যের হাত প্রসারিত করেছে।

অন্য দিকে এই পশ্চিম বঙ্গের মানুষ সুদীর্ঘ ৩৪ বছরের বামপন্থী অন্ধকার যুগের অবসান ঘটিয়ে যে সরকার এনেছে তারা সর্বোচ্চ শক্তি দিয়ে বাংলার উন্নয়ন করে যাচ্ছেন যা মানুষ স্বচক্ষে দেখছেন। কিন্তু সেই ভাল ভাল কাজ এই হেরো বিরোধীদের নজরে নেই। নজর আছে কোথায় শুধু ছিদ্র। সে জন্য এই রকম বস্তাপচা রাজনীতি নিয়ে কিছু শুনতে মানুষ খুব ক্লান্ত বোধ করেন। কারণ ঐ টেবিল গরম করা বাদানুবাদে মানুষের কোন উপকারে লাগে না। আর আমরা যারা রাজনীতির লোক নই, কাব্য সাহিত্য নিয়ে থাকি, তারাই এর মধ্যে পা পিছলে পড়ে যাই। যা হোক, আমি এই সব সারবত্তাহীন বিষয় থেকে নিজেকে সরিয়ে নিলাম। ক্ষমা করবেন।

লেখক : পশ্চিমবঙ্গের লেখক-গবেষক