শোভন সাহা : বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশন (বিআরটিসি) জনসাধারণের প্রয়োজনে বিদেশ থেকে কোটি কোটি টাকার বিনিময়ে কিনে আনা বাসের অধিকাংশ বাসই অত্যন্ত অবহেলা ও অযত্নের সাথে ব্যবহার করছে। যার ফলে অধিকাংশ বাসই আস্তে আস্তে ধ্বংসের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।

বাস কিনেই দায়িত্ব শেষ, নেই রক্ষণাবক্ষেণ। ফলে ক্রমে বিকল হচ্ছে বাংলাদশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) বাস।

গত এক বছরে সংস্থাটির কোরিয়া থেকে কিনে আনা ৪০টি বাস অচল অবস্থায় রয়েছে। আর ভারত থেকে কেনা ডাবল ডেকার, আর্টিকুলেটেড ও এসি বাস বিকল হয়েছে ২২টি। এর বাইরে কোরিয়া ও ভারত থেকে কিনে আনা ৮৯টি বাস বিভিন্ন ত্রুটি নিয়ে রাস্তায় চলছে। এর আগে ২০১০ সালে চীন থেকে আনা ২৭৫টি বাসের মধ্যে ১১৫টি অচল হয়ে পড়ে রয়েছে।

পরিবেশের দূষণ কমানোর লক্ষ্যে কোরিয়া সরকারের ঋণে ২০১১ সালে ২৫৫টি বাস আনে বিআরটিসি। এর মধ্যে ১০০টি এসি ও ১৫৫টি নন-এসি। এতে ব্যয় হয় প্রায় ২৪৩ কোটি টাকা। ২ টি নন-এসি বাস শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপহার হিসাবে দেওয়া হয়। বাকি ২৫৩টি বাস রয়েছে বিআরটিসি বহরে। এর মধ্যে সচল ২১৩টা।

কোরিয়া থেকে কিনে আনা বাসগুলোর রক্ষণাবেক্ষণে গত তিন বছরে কোনো অর্থ ব্যয় করেনি বিআরটিসি। ইতোমধ্যে রাজধানীর মতিঝিল ডিপোয় পড়ে আছে ১৪টি, মনিপুরে ৩টি ও জোয়ারসাহারা ডিপোয় আছে ২টি অচল বাস।

আর ঢাকার বাইরে চট্টগ্রাম ডিপোয় আছে ৮টি, নারায়ণগঞ্জে ৪টি, সিলেটে ২টি, কুমিল্লায় ২টি, নোয়াখালীর সোনাপুরে ২টি এবং নরসিংদী, বগুড়া ও রংপুরে ১টি করে বাস অচল হয়ে পড়েছে যা থেকে বোঝা যায় বিআরটিসির বাস গুলো শুধু অযত্নে ও অবহেলায় অচল হয়ে পড়ে আছে।

ডিপো ম্যানেজাররা জানান, প্রায় এক বছর ধরে অচল অবস্থায় পড়ে আছে বাসগুলো। অচল বাসগুলোর ২১টিতে বড় ধরনের মেরামতের কাজ করতে হবে, ১১টি হালকা মেরামত করলইে চালানো সম্ভব। দুর্ঘটনা কবলিত ৮টি বাসের ভারী মেরামত প্রয়োজন। তবে প্রয়োজনীয় খুচরা যন্ত্রাংশ না থাকায় মেরামত করা যাচ্ছে না এসব বাস।

মতিঝিল ডিপোর র্ঊধ্বতন এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার র্শতে বলেন, বাস মেরামতের দায়িত্ব বিআরটিসির মেকানিক্যাল বিভাগের। প্রয়োজন অনুযায়ী যন্ত্রাংশ না পেলে বাস মেরামত করা যায় না।

এই অবস্থায় চলমান বাসগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি এসি বাসের অবস্থা তুলনামূলক খুবই খারাপ। অতিরিক্ত যাত্রী পরিবহন করায় দ্রুত এই সব বাসের র্কাযক্ষমতা কমে যাচ্ছে। ফলে বাসের ভেতরটা ঠিকমতো ঠাণ্ডা হয় না।

এছাড়া ২০টি বাসের এসির সেন্সর নষ্ট হয়েছে। ইঞ্জিনের ক্ষমতাও কমেছে কয়েকটি বাসের। পিস্টন ও পিস্টনের রিং ক্ষয়ে যাওয়ায় দূরপাল্লার রুটে চলা বাসগুলো মহাসড়কে দ্রুত গতি তুলতে পারে না। সব কিছু মিলিয়ে ৮৯টি বাস নানা ধরনের ত্রুটি নিয়ে যাত্রী বহন করছে।

কোরিয় বাসগুলো মেরামতে প্রায় ২ কোটি টাকা প্রয়োজন। ছয় মাস আগে কারিগরি বিভাগ এর চাহিদাপত্র দিলেও এখনো কোনো বরাদ্দ পাওয়া যায়নি।

বিআরটিসিরি পরিচালক কর্নেল মো. আব্দুল্লাহ করিম বলেন, কোরিয় বাসগুলো নিয়ে নানা ধরনের অভিযোগ আছে। এসি বাসগুলো নিয়েই অভিযোগ বেশি।

দীর্ঘমেয়াদে সার্ভিস দিতে এখনই বাসগুলো মেরামত করা প্রয়োজন। তবে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ না পাওয়ায় তা করা যাচ্ছে না।

ভারতের রাষ্ট্রীয় ঋণে (এলওসি) ২০১৩ সালে কেনা হয় ২৯০টি দ্বিতল, ৫০টি আর্টিকুলেটেড (দুই বগির জোড়া লাগানো) ও ৮৮টি এসি বাস। এতে ব্যয় হয় প্রায় ৩০৪ কোটি টাকা। গত বছর বাসগুলোর ওয়ারেন্টি মেয়াদ শেষ হয়। তবে এখনই দেখা যাচ্ছে নানা ধরনের সমস্যা। অচল হয়ে পড়েছে ২২টি বাস, এর মধ্যে ডাবল ডেকার বিকল হয়েছে ১৪টি, এসি বাস ৫টি ও আর্টিকুলেটেড ৩টি।

দ্বিতল বাসগুলোর মধ্যে জোয়ারসাহারা ডিপোয় ৫টি, মানিকগঞ্জের উথলীতে ৪টি, নারায়ণগঞ্জে ২টি, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে ১টি করে বাস অচল হয়ে পড়ে আছে। এর মধ্যে ৯টি ভারী ও ৫টি হালকা বাস মেরামত প্রয়োজন। এসি বাসগুলোর মধ্যে ২টি কল্যাণপুরে, ২টি সোনাপুরে ও একটি মতিঝিলে আর আর্টিকুলেটেডের ৩টিই গাজীপুরে বিকল হয়ে পড়ে আছে। এগুলোর মধ্যে ৩টি এসি ও ৩টি আর্টিকুলেটেড বাসের ভারী মেরামত এবং ২টি এসি বাসের হালকা মেরামত প্রয়োজন।

ডিপো ম্যানজোররা জানান, ভারত থেকে আনা বেশির ভাগ বাসই বিকল হয়েছে। গত এক বছরে এগুলোর সঙ্গে আনা খুচরা যন্ত্রাংশ শেষ হয়ে যাওয়ায় এখন আর বাস মেরামত করা যাচ্ছে না। আর ওয়ারেন্টি শেষ হওয়ায় ভারতের অশোক লেলেন কোম্পানীও এগুলো মেরামত করে দিচ্ছে না। ফলে বাসগুলো অচল অবস্থায় রাখতে হচ্ছে। এতে ক্রমইে কর্মক্ষমতা হারাচ্ছে বিআরটিসির কেনা আধুনিক সব বাসগুলো। চলমান বাসগুলোর অবস্থাও বেশ খারাপ বলে তারা জানান।

তাদের তথ্যমতে, প্রায় সব দ্বিতল ও আর্টিকুলেটেড বাসগুলোর পাখা নষ্ট হয়ে পড়েছে। এছাড়া দ্বিতল বাসগুলোর অনেকগুলোর চেয়ার ভেঙ্গে গেছে। বাজটে পর্যাপ্ত বরাদ্দ না থাকায় মেরামত করা যাচ্ছে না।

ডিপো ম্যানজোররা অভিযোগ করেন, মূলত ইজারায় পরিচালনার কারণে নতুন বাসগুলো দ্রুত অকেজো হয়ে পড়ছে। আর এগুলো মেরামতের পরিবর্তে র্কতৃপক্ষ আরো নতুন ২০০টি দ্বিতলা ও ১০০টি আর্টিকুলেটেড বাস কেনার চেষ্টা করছে।

এ প্রসঙ্গে বিআরটিসি চেয়ারম্যান মো. মিজানুর রহমান বলনে, আর্থিক সংকটের কারণে বাসগুলো মেরামতে বাজটে বরাদ্দ দেওয়া যাচ্ছে না। গত প্রায় ৩ মাসের রাজনৈতিক অস্থিরতায় বিআরটিসি আয় অনেক কমে গেছে। এতে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়মিত বেতন পরিশোধই কষ্টসাধ্য হয়ে পড়েছে।

এজন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছে ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চাওয়া হয়েছে। ক্ষতিপূরণ বাবদ অর্থ পাওয়া গেলেও বাসগুলো মেরামত বাবদ কিছু অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হবে। তবে বিআরটিসি কিছু বাস অনেক আগেই অকেজো হয়ে পড়েছে। এই সব বাস প্রতিস্থাপনে নতুন বাস কেনার চেষ্টা করা হচ্ছে।

উল্লখ্যে, অবহলো আর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিআরটিসির বাস নিয়মিতই অচল হয়ে পড়ে থাকে। আর মেরামতের অভাবে এগুলো অকেজো হয়ে পড়ে থাকছে মাসের পর মাস। চীন থেকে আনা বাসগুলো এর বড় উদাহরণ। ২০১০ সালে কিনে আনা ২৭৫টি বাসের মধ্যে এখন ১১৫টি অচল। এছাড়া বিগত সরকারের সময় কিনে আনা ৫০টি ভলভোর ৪৯টি ও ১২০টি দ্বিতল বাসের ৭৪টি অকেজো হয়ে পড়েছে।

(এসএস/পিএস/মে ২৫, ২০১৫)