মিলন কর্মকার রাজু,কলাপাড়া(পটুয়াখালী)থেকে :চাইরদিন আগে রাইতে হঠাৎ সাগরে পানি বাইড়্যা যাওয়ায় বড় বড় চাঙ্গল (ফাঁটল) লইয়া বালুর ঢিপি (ঢিবি) ভাইঙ্গা পড়ছে। সাগরের জোয়ারের ঢেউ বালুর ঢিপিতে আঁচড়ে পইড়্যা ঘরের মধ্যে পানির ছিটা গ্যাছে। হারা রাইত এই হানের সবাই ভয়ে বাইরে রাইত কাডাইছি।

এ্যাহন যে অবস্থা সামনের জোবায় (আগামী পূর্নিমার জো’তে) এইহানে আর কেউ থাকতে পারমু না মনে হয়।নিজ ঝুপড়ি ঘরের মালামাল গুছাতে গুছাতে এ কথাগুলো বলেন বাবুল পাহোলান।

কুয়াকাটা সৈকতের জিরো পয়েন্ট ঘেষা আদর্শ গ্রামের বাসিন্দা তিনি। এক সময় এই গ্রামে দুই শতাধিক পরিবার বাস করলেও সাগরের ভাঙ্গনে গোটা গ্রামটিই এখন বিলীন হয়ে গেছে। গ্রামের শেষ কোনে ৩০/৩৫ ফুট দীর্ঘ বালুর ঢিবিতে এ বাবুল পাহোলানের মতো ২০/২৫ টি পরিবার ছোট্র ঝুপড়ি করে মাথা গোঁজার শেষ আশ্রয় তৈরি করে থাকলেও সেই আশ্রয়টুকুও এখন বিলীনের পথে।

জানাযায়, ১৯৯৮/৯৯ সালে কুয়াকাটা সৈকতের মূল সড়কের পশ্চিম দিকে ছিন্নমূল মানুষের আশ্রয়ের জন্য তৎকালীন আওয়ামীলীগ সরকার ২০০ পরিবারের জন্য গুচ্ছগ্রাম তৈরি করে। সেখানে আশ্রয় নেয় অন্তত আড়াই হাজার মানুষ। জেলে,হকার, শ্রমজীবি,স্বামী পরিত্যক্তা ও অসহায় মানুষকে পূনর্বাসনের জন্য সরকার ওই সময় এ আদর্শগ্রাম তৈরি করে। কিন্তু আদর্শ গ্রাম তৈরি করলেও সাগরের ভাঙ্গন থেকে গ্রামটি রক্ষায় কোন উদ্যেগ না নেয়ায় ২০০৫/০৬ সালে সাগরের ভাঙ্গনে গ্রামটি ভাঙ্গতে শুরু করে। ২০০৭ সালের সিডরে লন্ডভন্ড হয়ে যায় গোটা গ্রামটি। ওই সময় এ গ্রামের বহু পরিবারকে পূনর্বাসন করে সরকার। কিন্তু এখনও আদর্শ গ্রামের বালুর মৃত্যুকূপে বাস করছে দেড় শতাধিক মানুষ।

“সাগর এইদিকে ভাঙ্গে, আর আমরাও পিছনে যাই। জন্মের পর হইতে পাঁচবার ঘর সাগরে ভাঙ্গছে। বিয়ার পর ভাবছি স্বামীর ঘরে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত থাকতে পারমু। কিন্তু ছয় মাসও হয়নি বিয়ার। এ্যাহন দেহি সাগরের ভাঙ্গতে আর দেরি নাই এই ঘরডাও। এ্যাহন কই যামু হেই চিন্তায় আছি। মোগো তো আর জায়গা জমি নাই। এই কথাগুলো বলেন সদ্য বিবাহিত রাবেয়া বেগম। তিনি বলেন, রাইতে ঘুম হয় না। বালি ধুইয়া ধুইয়া পইর‌্যা যাইতাছে। আর কয়দিন থাকতে পারমু এই হানে আদর্শ গ্রামের বাসিন্দা খাদিজা বেগম। চার সন্তান ও স্বামীকে নিয়ে বালুর ঢিবি ভাঙ্গনের মুখে তার ছোট্র ঘরটি। কিন্তু তার মনে নেই কোন হারানোর শঙ্কা। তার ভাষায়“ ঘর ভাঙ্গলে আর কি করমু। আবার যেহানে জায়গা পামু হেইয়ানে উডমু। চাইরবার (চার) ঘর ভাঙ্গছে,চাইরবার তুলছি। একবারওতো সরকার মোগো দিকে তাকায় নায়। তাই মোগো যাওয়ার কোনো জায়গা নাই। এইহানেই থাকতে হইবে। দেহি আল্লায় কয়দিন রাহে”।

জেলে বাবুল পাহোলান আতংকে আছে তার সন্তানদের নিয়ে। চার ছেলে-মেয়েই তার স্কুলে যায়। কিন্তু এখন সাগরে ঘর ভেঙ্গে গেলে তার সবকিছুই শেষ হয়ে যাবে। তিনি বলেন,“সাগরে মাছ ধইর‌্যা পোলামাইয়াগো ল্যাহাপড়া করাই। আশা আছিলো অগো য্যানো আমার মতো কষ্ট করতে না হয়। কিন্তু এ্যাহন ঘর ভাঙ্গলে কই যামু। এইহান দিয়া গ্যালে পোলামাইয়ার ল্যাহাপড়াও তো বন্ধ হইয়া যাইবে”।

স্থানীয়রা জানায়, গত পূর্নিমা ও অমাবশ্যা’র জো’তে সাগরের জোয়ারের পনি বেড়ে যাওয়ায় সৈকত ঘেষা আদর্শ গ্রামের বালুর স্তর ধ্বসে পড়ায় গোটা গ্রামটি ভাঙ্গনের কবলে পড়েছে। সাগরের প্রতিটি জোয়ারে ধ্বসে পড়ছে বালুর ঢিবি। এ বালুর ঢিবি ভেঙ্গে যাওয়ায় এখন হুমকির মুখে পড়েছে কুয়াকাটার মূল রক্ষা বাঁধ। কেননা বর্ষা মেীসুমে সাগরের জোয়ারের পানি বাঁধের কাছাকাছি চলে আসায় শুটকি পল্লী, মাঝিবাড়ি পয়েন্টে বাঁধে ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে বহু স্থাপনা বিলীন হয়ে গেছে। গতবছর জলোচ্ছাসে এ গ্রামের মনির মিয়া, মনির মাঝি, জহিরুল, ইসমাইল, আব্বাস, আজিজ মাঝি, আলামিন, নাসির,মো. মনিরুল ইসলামসহ অন্তত ৫০ টি ঝুপড়ি ঘর সাগরে ভেসে গেছে। এই পরিবারগুলো এখন কুয়াকাটা সৈকতের বেড়িবাঁধের বাইরে এবং মাঝিবাড়ি বাঁধের ভিতরে আশ্রয় নিয়েছে।

কলাপাড়া পাউবো’র নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আবুল খায়ের জানান, কুয়াকাটা সৈকতের ভাঙ্গন ঠেকাতে সৈকতে সিসি ব্লক ফেলে সৈকতের ভাঙ্গন ঠেকানোর উদ্যেগ নেয়া হয়েছে। এ সংক্রান্ত প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হয়েছে।


(এমকেআর/এসসি/মে৩০,২০১৫)