মনোজ হালদার : মেডিকেল কলেজে ভর্তির ক্ষেত্রে কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করার কোনো গ্রহণযোগ্য কৌশল নির্ধারণ করতে পারেনি শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। তাই আগের মতোই এবারও মেডিকেলে ভর্তি ইচ্ছুক শিক্ষার্থীদের বহন করতে হবে কোচিংয়ের বাড়তি বোঝা। অনেক অভিভাবককে জমি বিক্রি করে হলেও গুনতে হবে ছেলে-মেয়ের কোচিংকালীন অর্থ। কোচিংয়ে ভর্তি হওয়ার সামর্থ না থাকায় চিকিৎসক হওয়ার স্বপ্নটি অনেক গরীব মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীর কাছে স্বপ্নই থেকে যাবে। গরীব ও মেধাবীরা ভর্তিতে বঞ্চিত হলেও কাড়ি কাড়ি টাকা চলে যাবে কোচিং ব্যবসায়ীদের হাতে।

চলতি বছর যারা মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষা দেবেন তাদের কাছ থকে নানা উপায়ে টাকা হাতিয়ে নেওয়ার ফাঁদ এরই মধ্যে ভালোভাবে তৈরি করেছে কোচিংগুলো। ২০১৫ সালে এইচএসসি পরীক্ষা এখনও শেষ না হলেও ঢাকা মহানগরীতে বিশেষ করে কোচিং বাণিজ্যের এলাকা ফার্মগেটে এরই মধ্যে এই বাণিজ্যে তোরজোড় শুরু হয়েছে। মেডিকেল কোচিংগুলো দাবি করছে, মে মাসের শুরু থেকে এ পর্যন্ত তারা অনেক শিক্ষার্থী ভর্তিও করেছে। পরে ভর্তি হলে সুবিধাজনক সময়ে ব্যাচ পাওয়া নাও যেতে পারে এজন্য ব্যবহারিক পরীক্ষা শেষ না হতেই অনেকেই কোচিংয়ে ভর্তি হয়ে গেছেন।

কোচিংগুলোতে গিয়ে জানা যায়, ১ মে থেকে তারা নতুন মৌসুমের জন্য শিক্ষার্থী ভর্তি করছেন। আবার গতবার যারা ভর্তি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করতে পারেনি তারা সারা বছরই এসব কোচিংয়ে ক্লাস করেছে। ভর্তি কোচিংয়ের ক্ষেত্রে নিয়ম না মেনে প্রায় সারা বছরই তারা চালিয়েছেন কোচিং বাণিজ্য।

প্রতি বছরের ন্যায় এবারও হরেক রকম বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছেন এসব ব্যবসায়ীরা। কোনো অভিভাবকই তার সন্তানকে পিছিয়ে রাখতে চান না। যতই কষ্ট হোক প্রয়োজনে জমি বিক্রি করে হলেও কোচিংয়ের টাকা যুগিয়ে সন্তানকে মেডিকেল কলেজে ভর্তি করাতে পিছপা হতে চান না তারা। সন্তানের প্রতি অভিভাবকের এই দুর্বলতা চিরন্তন, তাই চটকদার বিজ্ঞাপনে অভিভাবকদের আকৃষ্ট করতে কষ্ট হচ্ছে না কোচিং বাণিজ্যে জড়িতদের। তাই যতই কষ্ট হোক কেউ কেউ ভর্তি হচ্ছেন একাধিক কোচিংয়ে।

কোচিংয়ের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের নিয়ে আরও নানা রকমের বাণিজ্যের জন্য এরই মধ্যে তৎপর হয়ে উঠেছে রাজধানীর সুবিধাভোগী আরও কিছু ব্যবসায়ীরা। হোস্টেল বাণিজ্যও যেন পিছিয়ে নেই। ফার্মগেট এলাকায় কোচিংয়ে ভর্তির বিষয়ে খোঁজ নিতে গেলে অভিভাবক ও শিক্ষার্থীদের ঘিরে ধরবে বিভিন্ন হোস্টেলের দালালরা। তারা বিভিন্ন রংয়ের লিফলেট দিয়ে শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের আকৃষ্ট করার চেষ্টা করবে। এসব হোস্টেলে থাকতে গেলেও অভিভাবকদের গুনতে হবে অনেক টাকা। হোস্টেলে থাকতে হবে ন্যুনতম ছয় মাস। এ রকম থাকার প্রয়োজন হলে তাদের ছয় মাসের টাকাই গুনতে হবে।

মেডিকেল কোচিংয়ে এককালীন ১৪-২০হাজার টাকা লাগার পাশাপাশি হোস্টেলে প্রতি মাসে দিতে হবে অন্তত ৬-৮ হাজার টাকা। এছাড়া হোস্টেলে ওঠার সময় গুনতে হবে সার্ভিস চার্জ বাবদ আরও অন্তত ৫ হাজার টাকা। এছাড়া নিশ্চিত ভালো রেজাল্ট করার জন্য কোচিংয়ের পাশাপাশি এর পরিচালকের কাছে ব্যক্তিগতভাবে পড়ারও পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে (মাসে অন্তত ৬ হাজার টাকা করে)।

উত্তম কুমার ভট্টচার্য নামের এক অভিভাবকউত্তরাধিকার ৭১ নিউজকে বলেন, বর্তমানে মেডিকেলে চান্স পেতে গেলে টাকা খরচ না করে উপায় নেই। তিনি গত বছর তার এক মেয়েকে কোচিং করানোর পাশাপাশি ওই কোচিং সেন্টারের পরিচালকের কাছে মাসে ৬ হাজার টাকা দিয়ে প্রাইভেটও পড়িয়েছেন বলে জানান।

মেডিকেল কোচিংয়ের জন্য রেটিনা, প্রাইমেট, থ্রি ডক্টরস একাডেমি, ম্যাক, উন্মেষ, অবজার্ভ, ডিএমসি প্রোগ্রাম, টাচ্ স্টোন, ফেইম ও মেডিকোতে খোঁজ নিয়ে প্রায় একই চিত্র ধরা পড়ে। সবাই এখন ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করাতে বেশ তোরজোড় চালাচ্ছেন।

ফার্মগেট শাখায় রেটিনার ম্যানেজার পরিচয়দানকারী আমান উত্তরাধিকার ৭১ নিউজকে বলেন, মে মাসের শুরু থেকে তাদের কোচিং সেন্টারে ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। ২৫ জুন ক্লাস শুরু হবে। তবে এখনই অধিকাংশ শিক্ষার্থী ভর্তি হয়ে গেছে। সকাল ও দুপুরের দিকে তাদের কোনো ব্যাচ খালি নেই।

মেডিকেলে ভর্তি হতে ইচ্ছুকদের মধ্যে একটি বড় অংশ রেটিনায় ভর্তি হয়ে থাকে বলে সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র থেকে জানা যায়। তাদের বিভিন্ন শাখা থেকে মেডিকেলের জন্য অন্তত ১০ হাজার শিক্ষার্থী কোচিং করে থাকে বলে একাধিক সূত্র জানায়। আমান আরও জানান, ১৪ হাজার টাকার বিনিময়ে রেটিনায় কোচিং করা যাবে। তবে আরও কিছুদিন পর্যন্ত ১ হাজার টাকা ছাড় পাওয়া যাবে।

আরেক কোচিং সেন্টার ম্যাকের ফার্মগেট শাখার ম্যানেজার সাদিয়াউত্তরাধিকার ৭১ নিউজকে জানান, তাদের প্রতিষ্ঠান অন্যদের থেকে আলাদা। ম্যাক কোচিং হলেও সেটিকে প্রাইভেট প্রোগ্রাম হিসেবে অবিহিত করেন তিনি। সেখানে এক হাজারের বেশি শিক্ষার্থী ভর্তি করা হবে না। এর পরিচালক ডা. এম.এ মান্নান যিনি চিকিৎসা পেশা ছেড়ে এই পেশায় আত্মনিয়োগ করেছেন বলেও জানান তিনি।

তিনি আরও জানান, এর পরিচালকের দেওয়া সাজেশন থেকে গত বছর ৯২টি প্রশ্ন কমন পড়েছে। গত বছর মাত্র ২০০ শিক্ষার্থী ভর্তি করেছিলেন ডা. মান্নান। সেখান থেকে ১৫০ জনই চান্স পেয়েছে জন। তিনি এরকমই জানান ভর্তির ব্যাপারে খোঁজ নিতে আসা অভিভাবকদের।

থ্রি ডক্টরস’র ম্যানেজার জাহিদউত্তরাধিকার ৭১ নিউজকে বলেন, তার প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের কাছে রাত ১২টা পর্যন্ত যেকোনো সমস্যার সমাধান করতে পারবেন শিক্ষার্থীরা। ওই প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে মেডিকেলের জন্য এককালীন লাগবে ১৬ হাজার টাকা। তবে বাড়তি চার হাজার টাকা দিয়ে এখান থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘ক’ ইউনিটের জন্যও কোচিং করা যাবে।

এদিকে সরকারও বলে আসছে, দেশের কোচিং সেন্টারগুলো ভর্তির বিষয়ে শতভাগ কমন সাজেশনসহ নানা ধরনের প্রতিশ্রুতি দেয়। এদের যোগসাজশে প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা ঘটে বলে অভিযোগ রয়েছে।

এক অভিভাবক উত্তরাধিকার ৭১ নিউজকে বলেন, কোনো ব্যক্তির পক্ষে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা খুবই কঠিন কাজ। কিন্তু এসব কোচিং সেন্টার যাদের কোটি কোটি টাকা মুনাফা তাদের পক্ষে প্রশ্নপত্র ফাঁস করা একটি সহজ কাজ। ব্যক্তির চেয়ে কোনো কাজ প্রতিষ্ঠান সহজে করতে পারে বলে তিনি যুক্তি দেন। তাছাড়া অনেক টাকা পেলেই কোনো ব্যক্তি প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঝুঁকি নেয়। আর এ কারণেই সম্প্রতি প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা বেড়ে যাচ্ছে বলে জানান তিনি।

তিনি পরামর্শ দিয়ে বলেন, এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হওয়ার পরেই এসএসসি পরীক্ষার রেজাল্টের ভিত্তিতে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে রাখা যেতে পারে। পরবর্তী সময়ে ভর্তি পরীক্ষা ও এইচএসসি পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে তাদের মেডিকেলে ভর্তি করানো হলে কোচিং করানোর সুযোগ থাকবে না।

এদিকে উচ্চশিক্ষায় কোচিং বাণিজ্যের প্রভাবের বিষয়টি নিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকেও উদ্বেগ জানানো হয়েছে। পরিকল্পনা নেওয়া হয়, 'সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষা'র। কিন্তু তার বাস্তবায়ন হয়নি। গত বছর এক সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বলেছিলেন, প্রতি বছর ভর্তি নিয়ে ৩২ হাজার কোটি টাকার কোচিং বাণিজ্য হয়। কোথায় কোচিং করলে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পাওয়া যাবে- তাও শিক্ষার্থীরা জানেন। স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়কে ভর্তি পরীক্ষা নিয়ে নিজেদের পদ্ধতি বের করে আরো দায়িত্বশীল হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি।

গত বছর মেডিকেলে ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার জন্য ৬৯ হাজার ৪৭৭ জন শিক্ষার্থী ভর্তি ফর্ম তোলে। যাদের অধিকাংশকেই কোচিং করতে হয়। এভাবে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ টাকা চলে যায় কোচিং ব্যবসায়ীদের হাতে। আর ছেলে-মেয়ের এসব বাড়তি খরচের বোঝা বহন করে অনেক অভিভাবককেই হতে হয় নিঃস্ব।

(এমএইচ/অ/মে ৩১, ২০১৫)