কলাপাড়া(পটুয়াখালী) প্রতিনিধি :  মূল ভবন একদিকে হেলে পড়েছে। ছাদ ও পিলার ভেঙ্গে চৌচির হয়ে গেছে। ভবনের ইটগুলোর ইটও গুঁড়োগুঁড়ো হয়ে খসে পড়ছে। প্রতিদিনই ভেঙ্গে পড়ছে ছাদের পলেস্তারাসহ দরজা-জানালা। একটু দমকা বাতাস হলেই পলেস্তারার বালিতে অন্ধকার হয়ে যায় ক্লাস রুম। ভবনের ছাদ ভেঙ্গে পড়া ঠেকাতে তিনটি ক্লাস রুমে খেজুর গাছের খুঁটি দিয়ে প্রটেকশন পিলার দেয়া হয়েছে। গত এক বছর ধরে এই তিনটি খেজুর গাছের খুঁটির উপর নির্ভর করছে ১৭১ জন ছাত্র-ছাত্রীর জীবন।

পটুয়াখালীর কলাপাড়ার লালুয়া ইউনিয়নের সৈয়দ গাজী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চিত্র এটি। আতংক ও আশংকা নিয়ে গত এক বছর ধরে এ ঝুঁকিপূর্ন ভঙ্গুর ভবনে ক্লাস চললেও সারা দেশে ভবন ধ্বস ও ভূমিকম্প আতংকের কারণে ভাঙ্গা স্কুল ভবনে এখন ছাত্র-ছাত্রী পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে অধিকাংশ অভিভাবক।
১৯৭০ সালে প্রতিষ্ঠিত এ বিদ্যালয়ের মূলভবন ২২ বছর আগে ৪ লাখ ২০ হাজার টাকা ব্যয়ে নির্মাণ করা হয়। বর্তমানে এ বিদালয়ে শিশু শ্রেণীতে ২৮, প্রথম শ্রেণীতে ২৮, দ্বিতীয় শ্রেণীতে ৩০, চতুর্থ শ্রেণীতে ২৭ ও পঞ্চম শ্রেণীতে ২০ জন ছাত্র-ছাত্রী অধ্যায়নরত।
নদীভাঙ্গন কবলিত রাবনাবাদ নদ ঘেষা এই স্কুল ভবনটিই ছিলো এতোদিন ঝড় জলোচ্ছাস থেকে লালুয়া ইউনিয়নের অন্তত ১০ টি গ্রামের মানুষ নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্র। সরেজমিনে বিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়ে দেখাযায়, ভবনটি এতোটাই নড়বড়ে যে মানুষের হাঁটার কম্পনেও খসে পড়ছে পলেস্তারা। মূলভবনের পলেস্তারা খসে এখন ইটও খসে পড়ছে। দড়জা-জানালা নেই। তিনটি ক্লাসরুম ও একটি অফিস কক্ষ। সেই তিনটি ক্লাস রুমই এখন মূত্যুকূপ। ভবনের ছাদ ধ্বসে পড়ায় স্কুল রক্ষায় শিক্ষকরা তিনটি খেজুর গাছ কেটে ছাদের প্রটেকশন পিলার দেয়া হয়েছে। গত কয়েক বছর ধরে বিদ্যালয়টি ঝুঁকির মধ্যে থাকলেও সংস্কারের উদ্যোগ না নেয়ায় শিক্ষকরা বাধ্যহয়ে এ উদ্যোগ নেয়।
গত এক বছরে ছাদ ধ্বসে পঞ্চম শ্রেনীর ছাত্র হাসানের মাথা ফেঁটে যায়। ক্লাসরুমের দড়জা ভেঙ্গে চতুর্থ শ্রেনীর ছাত্র রনি আহত হয়েছে। এছাড়া প্রতিদিনই ছাদের পলেস্তারা খসে আহত হচ্ছে ছাত্র-ছাত্রীরা। ছাত্র-ছাত্রীরা জানান, একটু বাতাস হলেই চোখে বালু যাচ্ছে। এ কারণে চোখ,শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত হয়ে পড়ছে তারা।
পঞ্চম শ্রেণীর ছাত্র তাওহীদ হোসেন, চতুর্থ শ্রেণীর ছাত্র শাহীন, তৃতীয় শ্রেণীর ছাত্রী মানসুরা জানায়, ‘একটু দৌড়ালেই গায়ে ছাদ ভাইঙ্গা পড়ে। আর ক্লাস রুমেতো বওয়াই(বসা) যায় না। বাতাস হইলেই বালিতে ক্লাসরুম ভইর‌্যা যায়। চোহেমুহে বালি যায়। আমরা ক্লাসে গ্যালে চুপ কইর‌্যা বইয়া থাহি। স্যারেরা কইছে ওয়ালে(দেয়ালে) হ্যালান না দিতে। দড়জা জানার কাছে না যাইতে। স্কুল ভাইঙ্গা পড়বে এই ডরে অনেক ছাত্র-ছাত্রীই এ্যাহন স্কুলে আয় না। আর বর্ষা হইলে তো স্কুল খালিই থাহে’।
অভিভাবক কবির হাওলাদার, হামিদুল ইসলাম জানান, আশেপাশে কোন স্কুল না থাকায় তারা বাধ্য হয়ে ওই ঝুকিঁপূর্ন ভবনে সন্তানদের পাঠাচ্ছেন। অনেকে বাধ্য হয়ে তাদের সন্তানকে দূরের স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। আর ঝড়,বষ্টি হলেতো ভয়তে কেউ স্কুলেই যায়না।
সহকারী শিক্ষক গাজী আবদুস সোবাহান জানান, আমরা আতংক নিয়া স্কুলে আসি। এতো ছাত্র-ছাত্রী কখন কোন দুর্ঘটনা ঘটে এই চিন্তায় ঠিকমতো ক্লাস করাই দুরুহ হয়ে পড়ছে।
প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ শাহাবুদ্দিন ও ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি মুশফিকুর রহমান মঞ্জু জানান, স্কুল ভবন পুননির্মাণের জন্য তারা বারবার উপজেলা শিক্ষা অফিস ও উপজেলা পরিষদে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু কর্তৃপক্ষ স্কুল ভবন নির্মাণে কোন উদ্যোগ নেয়নি।
লালুয়া ইউপি চেয়ারম্যান মীর তারিকুজ্জামান তারা জানান, স্কুল ভবনটি খুবই ঝুঁকিপূর্ন। জরুরী ভিত্তিতে ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে নতুন স্কুল ভবন নির্মাণ করা উচিত।
কলাপাড়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. রুহুল আমিন জানান, কলাপাড়ায় ১৭টি স্কুল ভবন ঝুঁকিপূর্ন অবস্থায় রয়েছে। ওই বিদ্যালয়টি বেশি ঝুঁকিপূর্ন। দু’একদিনের মধ্যে সরেজমিন পরিদর্শন শেষে ঝুঁকিপূর্ন মনে হলে ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে বিকল্প স্থানে পাঠদানের ব্যবস্থা করা হবে।
(এমআর/পিবি/জুন ০৩,২০১৫)