শেখর রায় : গতকাল এই অস্তমিত সূর্যের যেন নবোদয় ঘটল। বন্ধু তুষার ভট্টাচার্যকে পাশে বসিয়ে চালকের আসনে বসে স্টার্ট দিলাম গাড়ি। কলকাতা থেকে প্রায় ৭০ কিমি। গন্তব্য ছিল পশ্চিম বঙ্গের সুন্দরবন সরবেড়িয়া শ্রমজীবী হাসপাতাল। ২৫ শয্যার সম্পূর্ণ একটি স্বাস্থকেন্দ্র। আছেন সর্বক্ষণের চিকিৎসক। আছে সপ্তাহে মাসোয়ারা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। আছে আউটডোর আছে ইনডোর চিকিৎসার সুবন্দোবস্ত।

মেডিসিন, সার্জারি, চোখ, নাক-কান-গলা, শিশু ও স্ত্রীরোগ, অস্থি, ত্বক, দাঁত, ফিজিওথেরাপি। আছে অপারেশান থিয়েটার। আছে জরুরি চিকিৎসা বিভাগ। প্রতিদিন শত শত রোগী হাসপাতালের পরিসেবা গ্রহন করেন। প্রশিক্ষিত কর্মীরা আধুনিক যন্ত্রপাতির সাহায্যে চালাচ্ছেন প্যাথলজি, রেডিওলোজী বিভাগ। এম্বুলেন্স, জেনারেটার, সোলার আলো, ডিপটিউবেল ইত্যাদি কি যে নেই সেখানে। মাত্র ১৫ টাকায় ডাক্তার দেখানো যায়, বিশেষজ্ঞ হলে ২০ টাকা লাগে। ইনডোর বেড ও খাওয়া সমেত ভাড়া মাত্র ৫০ টাকা। আছে চমৎকার একটি জীবন দায়ী ওষুধ বিক্রয় কেন্দ্র। যেখান থেকে খোলা বাজারের এক তৃতীয়াংশ কম দামে ওষুধ বিক্রি হয়। কোন ডাক্তার এখানে কোম্পানির নামে বা ব্রান্ড নামে ওষুধ না লিখে লেখেন জেনেরিক নামে।

শুধু ডাক্তারদের দৈনিক ২০০০ টাকা দিতে হয়। ব্যতিক্রম ১/২ দু’জন ডাক্তার যারা টাকা নেয়া দূরে থাক কিছু দিয়ে নিজের দায় মোচন করেন। কিন্তু হাসপাতাল কর্মীদের মাসিক বা কোন সাপ্তাহিক বেতন নেই। তাদের ক্ষুধার অন্ন যোগায় হাসপাতালের ক্যান্টিন। স্বনির্ভরতার লক্ষে হাসপাতালের মধ্যে বিক্রি হয়, সুন্দরবনের চাক ভাঙ্গা মধু, নানাবিধ স্বহস্তে তৈরি মশলাপাতি। হাসপাতালের তিনদিকে ঘিরে থাকা সুবিশাল জলাশয়ে হয় মাছ চাষ, মুরগি, ছাগল, গরু প্রতিপালন, পার্শ্ববর্তী কৃষিক্ষেত্রে জৈব ফসলের চাষাবাদ। এই সব থেকে তৈরি হয় রুগীর ও স্বাস্থ্য কর্মীদের খাদ্য ও ভরণ পোষণ।

আশেপাশের ১৫/২০ টি গ্রামের মানুষদের দ্বারা বাৎসরিক সভায় গঠন হয় ৪২ জনের কর্ম সমিতি। এই গ্রামগুলির অধিবাসীর গণ হাসপাতাল চালাতে দায়বদ্ধ। মুষ্টি চাল জমিয়ে প্রতিটি পরিবার হাসপাতালকে সাহায্য করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। এছাড়া দলবদ্ধ ভাবে ভিক্ষাবৃত্তি, ব্যক্তিগত ভাবে নিঃশর্ত দান গ্রহনের মধ্যে দিয়ে পায় ১.৫ থেকে ২ লাখ টাকা মাসে জোগাড় করতে হয় হাপাতালের খরচ মেটাতে। এরা না পায় কোন সরকারি বা না নেয় কোন বেসরকারি দানের অর্থ। কোন রাজনৈতিক দল এদের পাশে দাঁড়ায় না। কিন্তু বিরোধিতা করারও সাহস পায় না। যদি করে তাহলে গ্রামের দলমত নির্বিশেষে জনগণই রুখে দেবে। একমাত্র সরকারি হাইস্কুলের কর্মী তার পারিবারিক ১২ বিঘা জমি দিয়েছেন হাসপাতালকে। নিবেদিত প্রাণ অরুণ সেনের পরিবারটি উদ্বুদ্ধ করেছেন বহু সাধারণ সেবা কর্মীদের।

রাষ্ট্রকেন্দ্রিক বা বেসরকারি একচেটিয়া বা ফোঁড়ে পুঁজি হাসপাতাল পরিসেবাকে লাভজনক বাণিজ্য করে জনগণকে লুণ্ঠন করে চলেছে। অথচ মানুষ আশানুরূপ পরিসেবা থেকে বঞ্চিত থাকেন। এই প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে শ্রমজীবী হাসপাতাল আন্দোলন জনগণের প্রতি সেবাদানের একটি অনন্য নজির গড়ে তুলেছে। জনগণের বৃহত্তম অংশের নৈতিক ও অর্থনৈতিক সাহায্যে আগামী দিন অটল ও অপরিবর্তিত থাকবে চিকিৎসা আন্দোলনের এই মানবিক মুখটি ।

লেখক : পশ্চিমবঙ্গের লেখক-গবেষক