ছেলে ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো
বর্গী এল দেশে
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কিসে।।
ধান ফুরল, পান ফুরল
খাজনার উপায় কি?
আর ক’টা দিন সবুর কর
রসুন বুনেছি।।
ধনিয়া পিয়াজ গেছে পচে
সর্ষে ক্ষেতে জল
খরা-বন্যায় শেষ করিল
বর্ষ এর ফসল।
ধানের গোলা, চালের ঝুড়ি
সব শুধু খালি
ছিন্ন কাপড় জড়িয়ে গায়ে
শত শত তালি
ধানের গাছ, বিলের মাছ
যাই কিছু ছিল
নদীর টানে বাঁধটি ভেঙ্গে
সবই ভেসে গেল।
এ বারেতে পাঁচ গাঁয়েতে
দিয়েছি আলুর সার
আর কটা দিন সবুর করো
মশাই জমিদার।

শৈশব কালে আমাদের মা-খালা, দাদী-নানীরা প্রায় এই ছড়াটা শুনিয়ে ঘুম পারাতেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে বর্গী মানে কি? কাদের কে বর্গী বলে ডাকা হতো? আমাদের সাথে বর্গীদের কি সম্পর্ক?

অষ্টাদশ শতাব্দীর লুটতরাজপ্রিয় অশ্বারোহী মারাঠা সৈন্যদলের নাম ‘বর্গি’। বাংলাদেশের পশ্চিমের নানান স্থানে প্রতি বছর প্রায় নিয়মকরেই একটা নির্দিষ্ট সময় (১৭৪১ – ১৭৫১) পর্যন্ত মারাঠাদের কিছু সংঘবদ্ধ লুটেরা এদেশে এসে লুটপাট করতো, সৃষ্টি করতো বিশৃঙ্খলার। লুট করে নিতো খেতের ফসল। ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দিতো, হত্যা করতো নিরীহ মানুষ। এইসব লুটেরাদেরকেই বাংলার মানুষজন বর্গী বলে ডাকতো। বর্গিহানা এই সময় একপ্রকার বাৎসরিক ঘটনায় পরিণত হয়েছিল।

মারাঠি ধনগর জাতীয় লোকেরা অভিযানে যাওয়ার সময় কেবলমাত্র একটি সাত হাত লম্বা কম্বল ও বর্শা নিয়ে বের হত। এই বর্শাকে মারাঠি ভাষায় বলা হত ‘বরচি’। এই নাম থেকেই ধনগররা বারগির বা বর্গা ধনগর বা বর্গি নামে পরিচিত হয়। বর্গি শব্দটি মারাঠি বারগির শব্দের অপভ্রংশ। বারগির বলতে মারাঠা সাম্রাজ্যের সেই সব অশ্বারোহীদের বোঝাত। এরা ছিল ধনগর জাতীয় এবং মারাঠা নেতা ছত্রপতি শিভাজী মারাঠী প্রশাসন কর্তৃক এদের ঘোড়া ও অস্ত্র সরবরাহ করা হত। মারাঠারা প্রধানত ভারতের মহারাষ্ট্রের অধিবাসী হলেও তারা ভারতবর্ষের গোয়া গুজরাট কর্নাটক অন্ধ্রপ্রদেশ তামিলনাড়ু– ও মধ্য প্রদেশেও বাস করে। সনাতন ধর্মের অনুসারী মারাঠারা মুগল আমলে ছিল ক্ষত্রিয় যোদ্ধা।


মারাঠাদের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন ছত্রপতি শিবাজী (১৯ ফেব্রুয়ারি, ১৬২৭-এপ্রিল ৩, ১৬৮০); তিনিই ১৬৭৪ সালে মহারাষ্ট্রের মারাঠী সাম্রাজ্যটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন । মারাঠী সাম্রাজ্য রাজধানী ছিল মহারাষ্ট্রের রাইগাড। ১৮১৮ অবধি মারাঠী সাম্রাজ্যটি টিকে ছিল। মারাঠী সাম্রাজ্য পতনের কারণ ভারতবর্ষে নতুন শক্তির আগ্রাসন।

মুগল সম্রাট আওরঙ্গজেব (নভেম্বর ৪, ১৬১৮-মার্চ ৩, ১৭০৭) সম্রাটের দক্ষিণ ভারতের সামরিক অভিযানের সময় মারাঠা সাম্রাজ্যটি ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে, যার ফলে মারাঠারা মুগল শাসনের প্রতি বিক্ষুব্দ হয়ে উঠে। যেহেতু মুগল আমলে মারাঠারা ছিল হিন্দু ক্ষত্রিয় যোদ্ধা সুতরাং সম্রাট আওরঙ্গজেব মনসব পদ দিয়ে মারাঠা সৈন্যদের মুগল সেনাবাহিনীতে অর্ন্তভূক্ত করে মারাঠাদের রোষ প্রশমিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু তাতে তেমন কোনো লাভ হয়নি। কিছু কিছু মারাঠা সেনাপতি সম্রাট আওরঙ্গজেব-এর অনুগত থাকলেও বেশির ভাগ মারাঠা সৈন্যই রোষবশত ভারতবর্ষে মুগল শাসিত প্রদেশগুলিতে লুঠপাঠ আরম্ভ করে। রোষের শিকার মুগল শাসিত প্রদেশগুলিতে সুবা বাংলা ছিল অন্যতম।

বাংলা মুগলশাসিত প্রদেশ বলেই ১৭৪২ থেকে ১৭৫১ সাল পর্যন্ত বার বার বাংলায় বর্গীদের আক্রমন সংঘটিত হতে থাকে। নওয়াব আলীবর্দী খান ১৭৪০ সালে বাংলার নওয়াব নিযুক্ত হন। ১৭৪২ সালের ১৫ এপ্রিল বর্গীরা বর্ধমান (বর্তমান পশ্চিম বাংলা) আক্রমন করে। জরুরি সংবাদ পেয়ে নওয়াব আলীবর্দী খান সসৈন্য বর্ধমানের দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। বর্গীদের নেতা ছিল ভাস্কর পন্ডিত, তার নির্দেশে বর্গীরা নওয়াব-এর রসদ সরবরাহ বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ২৬ এপ্রিল বর্গী বেষ্টনী ছিন্ন করে কোনওমতে প্রাণে বাঁচেন নওয়াব ।
৬ মে, ১৭৪২। মুর্শিদাবাদের দ্বারপ্রান্তে সশস্ত্র বর্গীরা এসে উপনীত হল। নওয়াব আলীবর্দী খান সে সময় মুর্শিদাবাদে ছিলেন না। নির্মম বর্গীরা মুর্শিদাবাদ নগরের বড় একটি বাজার পুড়িয়ে দেয়। এবং এভাবে বর্গীদের নির্বিকার ধ্বংসযজ্ঞ বাংলার মানসে চিরতরে প্রোথিত হতে থাকে: যে রুদ্ধশ্বাস অনুভূতি প্রকাশ পেয়েছিল মনোরম বিষন্ন একটি ছড়ার আকারে ...

খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো
বর্গী এল দেশে,
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে
খাজনা দেব কীসে?

মুর্শিদাবাদ নগরে জগৎ শেঠ নামে এক ধনী সওদাগর বাস করতেন । বর্গীরা তার কাছ থেকে ৩ লক্ষ টাকা আদায় করে নেয়। পরের দিনই, অর্থাৎ ৭ মে নওয়াব আলীবর্দী খান মুর্শিদাবাদ উপস্থিত হন। ততক্ষণে মুর্শিদাবাদের অনেকটা জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাড়খার করে বর্গীরা আরও দক্ষিণে পালিয়ে গেছে ।
১৭৪২ সালের জুলাই মাসে, অর্থাৎ মুর্শিদাবাদ আক্রমনের ২ মাস পর হুগলি জেলায় বর্গীরা একটি সৈন্য শিবির স্থাপন করে এবং খাজনা আদায় করতে লাগল। (‘বুলবুলিতে ধান খেয়েছে’-এই লাইনটি একটি বিশেষ সময়ের প্রতীক। বাঙালির রসিক মনের গূঢ়তম অভিব্যাক্তি ...)

সপ্তদশ ও অস্টাদশ শতকে বাংলার রেশমি কাপড়ের আড়ংগুলি (আড়ং শব্দটা ফারসি। আড়ং বলতে বড় আকারের বাজারকে বোঝায়) ছিল জমজমাট। বর্গী আক্রমনে আড়ংগুলি লোকশূন্য হয়ে পড়ে, আড়ংগুলি খাঁ খাঁ করতে থাকে। বাংলার অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়তে থাকে। বাংলাজুড়ে খাদ্যশস্যের অভাব দেখা দেয়, ব্যবসা-বানিজ্য বন্ধ হয়ে যেতে থাকে। যা হোক। বর্গীরা চৌথ আদায় করতে থাকে এবং পুবের যশোর জেলা অবধি বর্গীদের খাজনা আদায় ক্রমেই সম্প্রসারিত হতে থাকে। বর্গীদের নির্মম অত্যাচারে বহু লোক ভিটেমাটির মায়া ত্যাগ করে গঙ্গার পূর্বাঞ্চলে ( বর্তমান বাংলাদেশে) চলে আসে। পূর্বাঞ্চলের বাঙালিরাও বর্গী লুন্ঠনের শিকার হয়।

বাংলাপিডিয়ায় মোহাম্মদ শাহ লিখেছেন, ‘ঘন ঘন মারাঠা হামলা বাংলাকে মহাবিপর্যয়ে নিপতিত করে। বাংলার জনগনের জন্য এটা এতটাই ধ্বংস আর দুঃখ বয়ে আনে যে, মারাঠা বর্গীদের হামলার ভীতিকর গল্প বাংলার শিশুদের ঘুমপাড়ানি গানে বিশেষ স্থান অধিকার করে। এর সাথে অজন্মা ও খরা মিলে বাংলার অবস্থা আরও ভয়াবহ আকার ধারণ করে। মারাঠা হানাদাররা লুন্ঠন, অগ্নি সংযোগ ও হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে বাংলার জনগনের মনে এমনি ত্রাসের সঞ্চার করেছিল যে, বহুলোক তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে গঙ্গার পূর্বদিকের জেলাগুলিতে পালিয়ে যায়। এতে উক্ত এলাকার জনসংখ্যার চাপ বৃদ্ধি পেয়ে মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকট সৃষ্টি করে। মূল এই অর্থনৈতিক সংকটই পরবর্তী সময়ে বাংলার নওয়াবকে বিপর্যস্ত ও পর্যুদস্ত করে।’
বাংলার ইতিহাসে মীর জাফরের আগেও মীর হাবিব নামে বাংলায় আরও একজন বিশ্বাসঘাতক ছিল! পারস্য সেই অভিজাতটি এক সময় নওয়াব আলীবর্দী খানের ঘনিষ্ট ছিল; অথচ, এই লোকটিই লোকাল এজেন্ট হিসেবে বর্গীদের সাহায্য করত! আসলে মীর হাবিব ছিল রাজাকার; তার বাংলা সম্বন্ধে খুঁটিনাটি জ্ঞান ছিল। বর্গীরা সে জ্ঞান প্রয়োগ করে সহজেই বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ত!

১৭৪২ সালের মাঝামাঝি বাংলা থেকে বর্গীদের নিমূর্ল করার কঠিন সিদ্ধান্ত নেন নওয়াব আলীবর্দী। নওয়াবের এ সিদ্ধান্ত বাঙালিদের ভালোবেসে নয়, দিল্লির প্রাপ্য খাজনায় বর্গীরা ভাগ বসাচ্ছিল বলেই। ১৭৪৩ সালে বর্গীরা মেদিনীপুর আক্রমন করে। নওয়াব আলীবর্দীর নেতৃত্বে মুগল সৈন্যরা মেদিনীপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ৯ ফেব্রুয়ারি দুপক্ষের তুমুল সংর্ঘষ হয়। নওয়াব আলীবর্দীর উন্নততর রণকৌশলের ফলে মেদিনীপুর থেকে বর্গীরা উৎখাত হয়ে যায়। ১৭৪৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বর্গী নেতা ভাস্কর পন্ডিত আবার বাংলা আক্রমন করে বসে। নওয়াব আলীবর্দী খান বাধ্য হয়ে এবার ষড়যন্ত্রের পথ ধরেন। বর্গী নেতা ভাস্কর পন্ডিতকে বৈঠকের আহবান জানান। বৈঠকে ২১ জন বর্গীসহ ভাস্কর পন্ডিত এলে তাঁবুর আড়ালে লুকিয়ে থাকা মুগল সৈন্যদের আক্রমনে বর্গীরা নিহত হয়। ১৭৫০ সালের বর্গীরা আবার বাংলায় হানা দেয়। ১৭৫১ সালে বর্গী আক্রমনের তীব্রতা এতই বেড়ে যায় যে, নবাব আলীবর্দী খানকে মারাঠা-বর্গীদের সঙ্গে সন্ধিচুক্তি করেন। এই সন্ধিচুক্তি অনুযায়ী তিনি উড়িষ্যার অধিকার ছেড়ে দেন। চুক্তির শর্তানুসারে মীর হাবিব নওয়াবের কর্মকর্তা হিসেবে পরিগণিত হবেন এবং উড়িষ্যায় নওয়াবের নায়েব নাজিম বা ডেপুটি গভর্নরের দায়িত্ব পালন করবেন; আলীবর্দী মীর হাবিবের জন্য উড়িষ্যায় ১২ লক্ষ টাকা চৌথ পাঠাবেন এবং প্রদেশের রাজস্বের উদ্বৃত্ত টাকা রঘুজীকে পাঠাবেন। এ চুক্তি অনুসারে ভবিষ্যতে আর কখনও যেন আলীবর্দীর এলাকায় হানাদার মারাঠাদের পদার্পণ না ঘটে মারাঠা সরকার সেই অঙ্গীকার ব্যক্ত করেন। কিন্তু ১৭৫২ সালের ২৪ আগস্ট মারাঠা সৈন্যদের হাতে মীর হাবিব নিহত হলে আলীবর্দী উড়িষ্যায় তাঁর নিয়ন্ত্রণ হারান এবং প্রদেশটিতে পুনরায় মারাঠাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।
আর তার মাত্র ৬ বছর পর ইংরেজদের করতলগত হয়ে যায় বাংলা । ওদিকে মারাঠা-বর্গীরা মুগলদের পরির্বতে নতুন এই শক্তির মুখোমুখি হতে হয়- যে শক্তিটি মুগলদের চেয়ে সহস্রগুণ চতুর খল ও শক্তিশালী।
গ্রন্থনাঃ পরিতোষ বড়ুয়া লিমন
তথ্যসূত্রঃ উইকিপিডিয়া, বাংলাপিডিয়া