লেখক : চাং ইউয়ান (ষষ্ঠ শ্রেণি) : "সোনামনি, এখন ঘুম থেকে উঠবার সময় হয়েছে।" এই ডাক কানে বাজতেই আমি চোখ দুটো খুললাম। চোখের দৃষ্টিতে তখনো ঘুম জড়ানো ভাব।

আর, রোজকার মতো ঘড়িতে কাঁটায় কাঁটায় সাড়ে সাত। মা আমার পাশে বসে এক হাত দিয়ে আমার মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে আর অন্য হাতে আমার পরবার কাপড়-চোপড় নিয়ে বললেন- "লক্ষ্মী মেয়ে, এখন জামা কাপড় পরে নাও।" বলতে বলতে মা আমাকে জামা-কাপড় পরিয়ে দিলেন, মুখ ধুয়ে দিলেন... তারপর সকালের খাবার যা রোজই খাই অর্থাৎ এক কাপ গরম দুধ, এক প্যাকেট বিস্কুট এবং কয়েকটা সাদা খরগোশ মূর্তির চিনির সাজ এনে দিলেন খেতে। "সোনামনি, তাড়াতাড়ি করো, স্কুলে যাবার সময় হয়ে এলো।" বলেই মা আমার বইয়ের ব্যাগটা ঠিকঠাক করে নিজের কাঁধে ঝুলিয়ে নিলেন, তারপর আমার হাত ধরে স্কুলের দিকে রওনা হলেন।

"সোনামনি, স্কুলে সিঁড়ি দিয়ে উঠবার সময় সাবধানে পা ফেলবে, অন্যমনস্ক হলে পড়ে গিয়ে বিপদ ঘটাবে। জল খাবার সময় কখনো কলে মুখ রেখে খাবে না, নইলে..."। "থাক, থাক! মা এসব কথা আমার মুখস্থ হয়ে গেছে! আর বলো না!" আমি আর ধৈর্য ধরে থাকতে পারলাম না। বইয়ের ব্যাগটা মা-র কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে পা বাড়িয়ে দৌড় দিলাম। "সোনামনি, দৌড়ে যেও না, নইলে..." আমি হাত দিয়ে কান দুটো ঢেকে এক নিঃশ্বাসে দৌড়ে স্কুলের মধ্যে ঢুকলাম।

সেদিন প্রথম পিরিয়ড ছিলো "আমি কাজ করতে শিখেছি"। আমি দুহাতের উপর থুঁতনিটা রেখে খুব ভাবতে লাগলামঃ আমি কি কি কাজ করতে পারি? হাত-মুখ ধোয়া? চুল আঁচড়ানো? এ কাজ কে না পারে! আমার এখন এগারো বছর বয়স, শুধু হাত-মুখ ধুতে অ চুল আঁচড়তে পারি একথা বললে ক্লাসের সবাই আমাকে নিয়ে ঠাট্টা করবে! ভাত রান্না? কাপড় ধোয়া? এ কাজ দুটি আমিতো কোনো দিন করি নি। বাকী আর কি কাজ... আমি ভাবতে থাকি। এমন সময় শুন যে আমার পাশেই বসে, একখানা চিরকুট আমার হাতে গুঁজে দিলো। তা পড়েই রাগের চোটে আমার নাক সিটকে উঠলো। চিরকুটে লেখা ছিলোঃ "ও আমার সোনামনি। তাড়াতাড়ি এসো, মা তোমার প্রবন্ধটা লিখে দেবে!" আমি শুন-এর দিকে তাকিয়ে দেখলাম, সে যেন ধ্যানমগ্ন হয়ে প্রবন্ধ লিখছে।

আমি অধীর হয়ে স্কুল ছুটি হওয়ার অপেক্ষায় রইলাম। ছুটির ঘন্টা বাজতেই আমি বইয়ের ব্যাগটা হাতে নিয়ে তড়তড় করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নামতে লাগলাম। হঠাৎ পিছন থেকে এক অদ্ভুত সুরে কে যেন বললোঃ "ওগো সোনামনি, এমন তড়তড় করে নামতে যেও না, নইলে..." আমি পিছন ফিরে তাকাতেই দেখলাম, ওই শুন তার নাকটা টিপে ধরে করিডরে দাঁড়িয়ে আমার সঙ্গে মজা করছে। তার কথা শুনে সহপাঠীরা খিলখিল করে হাসতে লাগলো। লজ্জায় আমার মুখ একবার লাল একবার সাদা হয়ে উঠলো।

আমি রাগে কাঁপতে কাঁপতে স্কুলের গেটের দিকে ছুটলাম। গেটের বাইরে আসতেই দেখলাম মা দাঁড়িয়ে আছেন। আমি সঙ্গে সঙ্গে আমার সব রাগ তাঁর উপর ঝাড়তে লাগলাম। "এর জন্য তুমি দায়ী! তুমি দায়ী!" আমি চিৎকার করে বললাম। "ওগো সোনামনি, কি হয়েছে? এতো রাগ কেন?" মা অবাগ হয়ে আমার দিকে তাকালেন। "সব তোমারই দোষ, তুমি কেন আমার সঙ্গে স্কুলে আসবে? কেন সবার সামনে আমাকে সোনামনি বলে ডাকো? কেন ... তাই সবাই এখন আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করছে, আমাকে ক্ষ্যাপাচ্ছে।" "ওহো সোনামনি! আমি ভাবছিলাম তোমার কোনো বিপদ হয়েছে? ওদের কোথায় কান দিও না। নাও এই মিষ্টিটা খাও!" "ওঃ।" আমি গোমড়া মুখে মা-র সঙ্গে বাড়ির দিকে চললাম।

বিকাল বেলায় মা কাজ করতে চলে গেলেন। রোজকার মতো দরজাটার বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিলেন, আর টেবিলের উপরে রেখে গেলেন অনেক ভালো ভালো খাবার জিনিষ যেমন মধু, গরুর দুধ, কৌটার লিচু ইত্যাদি। কিন্তু সেদিকে আমার তাকাতেও ইচ্ছে করলো না। সকালের সব ঘটনা সিনেমার পর্দার ওপর ছবির মতো আমার চোখের সামনে ভাস্তে লাগলো। আমি যান দেখলাম, মা আমার হাতে টফি দিয়ে আমাকে সন্তুষ্ট রাখবার চেষ্টা করছেন যাতে আমি বাইরে গিয়ে কোনো বিপদে না পড়ি, জলে ডুবে না যাই অথবা অন্য লোকর উস্কানিতে বাইরে খেলতা না যাই। হায়রে, এমন এক সুন্দর বিকেলবেলায় আমি শুধু কাঁচের জানালা দিয়ে নীল আকাশে অবাধে উড়ে বেড়ানো ঈগল পাখিটির দিকে তাকিয়ে থাকি...

(প্রথম পুরস্কারপ্রাপ্ত)

সংগ্রহ : পরিতোষ বড়ুয়া (লিমন)