তাড়াশ (সিরাজগঞ্জ) প্রতিনিধি :  দারিদ্রতাকে দূরে ঠেলে নিরন্তর লড়াই করে মানুষের মত মানুষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে প্রাণপণ চেষ্টায় সফলতা পেয়েছে তাড়াশ উপজেলার ৪জন মেধাবী ছাত্রী। ভাল ফলাফল করে প্রতিবেশীসহ আত্মীয়-স্বজনকে তাক লাগিয়ে দিলেও ভবিষ্যৎ চিন্তায় এরা হতাশ! যাদের সংসারে নুন আনতে পানতা ফুরায় তাদের ভাগ্যে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক, প্রশাসনিক কর্মকর্তা হবার স্বপ্ন কি পুরণ হবার। এবারের এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে, তাড়াশ উত্তরপাড়ার দিনমজুর ভূমিহীন বেল্লাল হোসেনের মেয়ে কানিজ ফাতেমা, তাড়াশ সদর ঘোষপাড়ার চা বিক্রেতা শুকুর ঘোষের মেয়ে বৃষ্টি ঘোষ, চকরসুল্লা গ্রামের পিতৃহীন আছিয়া খাতুন, সোনাপাতিল গ্রামের ভূমিহীন অসুস্থ্য রহমত আলীর মেয়ে রেহানা পারভীন এরা এবার এসএসসি পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করেও কি? দারিদ্রতার কাছে হার মানতে হবে। 

বৃষ্টি ঘোষ : তাড়াশ সদরের ঘোষ পাড়ার চা বিক্রেতা শুকুর ঘোষের মেয়ে বৃষ্টি ঘোষ। সে তাড়াশ বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসি পরীক্ষায় বিজ্ঞান বিভাগ থেকে গোল্ডেন এ-প্লাস পেয়েছে। মা অলকা রানী ঘোষ স্বামীকে চা বিক্রেতা করতে সহযোগিতা করে। অবসরে কুঠির শিল্পের কাজ করে কোনমতে সংসার চালায়। শুকুর ঘোষের ২মেয়ে সহ ৪জনের সংসার চলে ছোট্ট একটি চা’র দোকানের উপর নির্ভর করে। জমিজমা বলতে কিছুই নেই। মাত্র ৩শতক জায়গার উপর বাড়ি টুকুই সম্বল। শুকুর ঘোষ জানায়, মাঝে মধ্যে অসুস্থ্য হয়ে পড়লে কিংবা ঝড় বৃষ্টিতে ২-৪দিন দোকান বন্ধ থাকলে অনাহারে অর্ধাহারে থাকতে হয়। তার ছোট মেয়ে ৮ম শ্রেণীতে পড়ে। চা বিক্রি করে ২মেয়ে পড়াশোনা করানোর মত সাধ্য তার নেই। যে সংসার চলে চা বিক্রির উপর নির্ভর করে সেই সংসারের আয় দিয়ে মেয়েকে বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করানোর মত সাধ্য তার নেই। বৃষ্টির স্বপ্ন ডাক্তার হয়ে অসহায় মানুষের সেবা করার। কিন্তুু অর্থের অভাবে তার এ স্বপ্ন পুরণ হবে কিনা সেও জানে না। বৃষ্টির প্রার্থনা সমাজের বিত্তবানদের সহযোগিতা পেলে ডাক্তার হবার স্বপ্ন পূরণ হবে।

কানিজ ফাতেমা : কানিজ ফাতেমা তাড়াশ জে,আই টেকনিক্যাল বালিকা বিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৫ পেয়েছে। পিতা মোঃ বেল্লাল হোসেন একজন ভূমিহীন দিনমজুর। বসতভিটা ছাড়া আর তাদের কিছুই নেই। বেল্লাল হোসেন তাড়াশ আওয়ামী লীগের পার্টি অফিসে পিয়নের কাজ করে। মাসে দেড় থেকে ২হাজার টাকা পায়। মা রাবেয়া বেগম বাড়িতে অন্যের কাথা সেলাই করে দু’জনে মিলে কোন মতে সংসার চালায়। ২মেয়েসহ ৪জনের সংসারে নুন আনতে পানতা ফুরায়। শত কষ্টের মধ্যেও মেয়েকে পড়াশোনা বন্ধ করেনি। কখনও মেয়েকে ভাল জামাকাপড় দিতে পারেনি। ফাতেমা পিতার কষ্টকে ভাগ করে নিয়ে শিক্ষক ও বন্ধু-বান্ধবীর সহযোগিতায় পড়াশোনা চালিয়ে আসছে। শত কষ্টকে সহ্য করে নিজের প্রাণপণ চেষ্ঠায় এসএসসি পরীক্ষায় এ-প্লাস পেয়েছে। কিন্তু অর্থের অভাবে উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করা তার অনিশ্চিত হয়ে পরেছে। ভূমিহীন পিতার পক্ষে আর পড়াশোনা করা সম্ভব নয় বলে সে জানায়। ফাতেমার পড়াশোনা করে উচ্চ শিক্ষা গ্রহন করে আদর্শ শিক্ষক হয়ে মানুষের সেবা করার ইচ্ছা ও স্বপ্ন পরণ করতে পারবে কি। তার পিতার আকুতি সমাজে বিত্তবানদের সহযোগিতা পেলে হয়ত ফাতেমার শিক্ষক হবার স্বপ্ন একদিন পূরণ হতে পারে।


আছিয়া খাতুন : তাড়াশ উপজেলার চকরসুল্লা গ্রামের মরহুম মোহাম্মদ আলীর কন্যা আছিয়া খাতুন এবার আজিমনগর কম্পিউটার কারিগরি স্কুল এ্যান্ড বানিজ্যিক কলেজ থেকে এসএসসি পরীক্ষায় গোল্ডেন এ প্লাস পেয়েছে। মা তারা বেগম অন্যের বাড়িতে ঝি’র কাজ করে ২মেয়ে, ১ছেলেকে পড়াশোনা চালিয়ে আসছে। আছিয়ার বাবা ৫বছর আগে মারা গেছে। জমিজমা বলতে কিছুই নেই। খাস জায়গায় একটি ঝুপরি ঘর করে বসবাস করছে তার পরিবার। বড় মেয়েকে বিয়ে দেবার পর নেশাগ্রস্থ স্বামীর অত্যাচারে ভাত ছাড়তে হয়েছে। মা তারা বেগম ঝি’র কাজ করে ৩ছেলে মেয়ের পড়াশোনা চালিয়ে আসছে। ৫বছর পুর্বে আছিয়ার পিতা মারা যায়। মা অসুস্থ্য হয়ে পরলে আছিয়া কিংবা তার বড় বোন মাহমুদার ওই বাড়িতে ঝি’র কাজ করতে হয়েছে। শত কষ্ট সহ্য করে মা তারা বেগম তার মেয়েকে পড়াশোনা চালিয়ে আসছে। আছিয়া মায়ের কষ্টের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পরে। মা না খেয়ে রাতে যে খাবার নিয়ে আসে তাই সবাই মিলে ভাগ করে খায়। প্রায় দিনই আছিয়াকে না খেয়ে স্কুলে যেতে হয়েছে। সে প্রতিদিন ৪কিলোমিটার রাস্তা পায়ে হেটে স্কুলে গেছে। রিক্সা কিংবা ভ্যানে যাওয়া তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। পিতার মৃত্যুর পর ৩বার কখনও সে পেট ভরে ভাত খেতে পায়নি। আছিয়া জানায় পড়াশোনা করে ভবিষ্যতে সে কম্পিউটার ইঞ্জিনিয়ার হতে চায়। তার আশংকা অর্থের অভাবে এখানেই হয়ত তাকে থেকে যেতে হবে। তারা বেগম জানান, কি কষ্ট করে ছেলে মেয়েদের নিয়ে সংসার করছি তা একমাত্র আল্লাহ ছাড়া আর কেউ জানেন না। সৃষ্টি কর্তা আমাকে কষ্ট করার জন্য সৃষ্টি করেছে। কথা বলতে বলতে তিনি কান্নায় ভেঙ্গে পরেন। তিনি সমাজের হৃদয়বান দানশীল ব্যক্তিদের নিকট নিবেদন করে বলেন আপনারা কেই এই এতিম মেয়ের সহযোগিতার জন্য আপনাদের দুটি হাত প্রসারিত করবেন। আমি আল্লাহতালার নিকট আজীবন দোয়া করব।

রেহানা পারভীন : তাড়াশ উপজেলার সোনাপাতিল গ্রামের অসুস্থ্য দিন মুজুর রহমত আলী ও মাতা হালিমা খাতুনের মেয়ে রেহানা পারভীন। সদ্য প্রকাশিত এসএসসি পরীক্ষায় জাফর ইকবাল কারিগরি বালিকা বিদ্যালয় থেকে গোল্ডেন এ-প্লাস পেয়েছে। রেহানার পিতা প্যারালাইসেস রোগে আক্রান্ত হয়ে বিছানায় পরে আসে কয়েক বছর ধরে। মা অন্যের বাড়িতে কাজ করে। ২ভাই ৩বোনের মধ্যে রেহানাই বড়। এ পর্যন্ত রেহানার পড়া শোনার কিছু খরচ চালিয়ে আসছে তার মামা। বর্তমানে মামা আর খরচ দিতে পারবেনা বলে সাব জানিয়ে দিয়েছে। মামার ইচ্ছা তাক এখন বিয়ে দেবে। কিন্তু রেহানা বিয়ে না করে কষ্ঠ হলেও সে পড়াশোনা করতে চায়। এমনিতে ৭জনের সংসারে একমাত্র উপার্জন শীল ব্যক্তি তার মা। মায়ের পক্ষে রেহানার পড়াশোনার খরচ চালানো সম্ভব নয়। তার ছোট বোনকে লেখাপড়ার খরচ না দিতে পেরে বিয়ে দিয়েছে। ছোট ২ভাই মাদ্রাসায় পড়ে। রেহানা পড়াশোনার ফাঁকে সে অন্যের বাড়িতে কাজও করে। রেহানা কান্না জনিত কণ্ঠে বলেন, আমি লেখাপড়া করতে চাই। আমাকে আপনারা সহযোগিতা করবেন। লেখাপড়া করে রেহানা ভবিষ্যতে প্রশাসনিক কর্মকর্তা হতে চায়। তার পরিবারের পক্ষে তাকে আর লেখাপড়া করানোর মত সামর্থ নেই। তাই সে সমাজের বিত্তবান ব্যক্তিদের সহযোগিতায় পড়াশোনা করতে চায়।
(এমএইচ/পিবি/জুন ১৭,২০১৫)