ফেনী প্রতিনিধি : ফেনীর সোনাগাজীতে দ্বিতীয় কিস্তিতে চলমান হতদরিদ্রদের ৪০ দিনের কর্মসৃজন প্রকল্পের টাকা হরিলুট হচ্ছে অভিযোগ করেছে স্থানীয় এলাকাবাসী।

উপজেলার ৯টি ইউনিয়নে কর্মসৃজন প্রকল্পের বরাদ্দ ও কাজের অগ্রগতি এবং জনপ্রতিনিধি, প্রকল্প সংশ্লিষ্ট শ্রমিকসহ বিভিন্ন শ্রেনী-পেশার মানুষের তথ্যে এমন চিত্র বেরিয়ে এসেছে। ৭ শতাধিক গায়েবি শ্রমিকের টাকা নিচ্ছেন পিআইও ও প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। পিআইওর সাফ কথা-কাজ নয়, আমরা টাকা চাই।

একাধিক জনপ্রতিনিধি বলেছেন, গায়েবি শ্রমিকের বিষয়টি স্যারেরা জানেন। স্বাক্ষর ও টিপ সহিতে চলছে অনিয়ম। বৃষ্টি হলে কাজ বন্ধ থাকার কথা বলেছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিরা।

সরেজমিনে দেখা যায় ভেল্কিবাজির অত্যাধুনিক চিত্র। ৯টি ইউনিয়নের প্রত্যেকটি প্রকল্পে রয়েছে হাজারো অনিয়ম। ভাগবাটোয়ারার জন্য গায়েবি শ্রমিকের নাম দেওয়া হয়েছে যারা কখনো কাজে যায় না। ওই নামের টাকা ব্যাংক থেকে উত্তোলন করে নেন জনপ্রতিনিধিরা। টাকা প্রদানে নিয়মের ধার ধারছে না ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। পিয়ন ও দারোয়ানেরা দেয় পেমেন্ট। ৩/৪ জন শ্রমিক মিলে দেড় দুই শতাধিক শ্রমিকের টিপ সহি দিয়ে থাকেন। অনেক সময় ইউপি সদস্যরাই দিয়ে বসেন সকল টিপ সহি। বিনিময়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষকে দিতে হয় টুপাইস। পরে গায়েবি শ্রমিকের লাখ লাখ টাকা গিলে খান পিআইও ও প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মঙ্গাপিড়িত শ্রমিকেরা যাতে বছরের কাজ না থাকা সময়ে কষ্টে না থাকে সে বিবেচনায় সরকারের বিশেষ তহবিল থেকে সারা দেশের ইউনিয়ন পরিষদে কর্মসৃজন প্রকল্পের নামে টাকা বরাদ্ধ দেওয়া হয়। শ্রমিকদের কষ্ট ও দু:খ লাঘবে বরাদ্দ দেওয়া হলেও এক্ষেত্রে সোনাগাজীর ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে বরাদ্দকৃত টাকা প্রকৃত শ্রমিকদের কোন কাজে আসছে না। প্রকৃত শ্রমিকেরা জানতেও পারছে না সরকার প্রতি বছর তাদের জন্য কর্মসৃজন প্রকল্পের নামে টাকা বরাদ্দ দিচ্ছে।

স্থানীয়দের কাছ থেকে অভিযোগ পেয়ে বর্তমানে চলমান ৪০ দিনের কর্মসৃজন প্রকল্পের বিস্তারিত তথ্য পেতে প্রথমে প্রতিবেদক ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ও সচিবদের সাথে যোগাযোগ করলে তারা বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে তথ্য প্রদানে অপারগতা প্রকাশ করে। পরে উপজেলা পরিষদের ওয়েবসাইটে প্রবেশ করেও কোন তথ্য না পেয়ে ৬ মে বিস্তারিত তথ্য পেতে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা বরাবর লিখিত আবেদন করা হয়। কিন্তু অদ্যাবধি প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা কোন তথ্য প্রদান করেনি।

পরে স্থানীয় জনসাধারণ ও বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে কর্মসৃজন প্রকল্পের বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়। ইউনিয়নে জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে কর্মসৃজন প্রকল্পের টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। সেই হিসেবে সোনাগাজীতে মোট বরাদ্ধের পরিমান ১ কোটি ৯১ লক্ষ টাকা। তার মধ্যে চর মজলিশপুর ইউনিয়নে ১৬ লক্ষ, বগাদানা ইউনিয়নে ১৫ লক্ষ, মঙ্গলকান্দি ইউনিয়নে ১৩ লক্ষ, মতিগঞ্জ ইউনিয়নে ১৪ লক্ষ, চরদরবেশ ইউনিয়নে ৩০ লক্ষ, চরছান্দিয়া ইউনিয়নে ৩৬ লক্ষ, সোনাগাজী সদর ইউনিয়নে ২৪ লক্ষ, আমিরাবাদ ইউনিয়নে ২৭ লক্ষ, নবাবপুর ইউনিয়নে ১৬ লক্ষ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

৪০ দিনের কর্মসৃজন প্রকল্পের বিধান অনুযায়ী প্রতিটি ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নিজ ক্ষমতা বলে প্রতিটি ওয়ার্ডের ইউপি সদস্যকে সভাপতি করে টাকার পরিমান নির্দিষ্ট করে প্রকল্পের অনুমোদন দিবে। উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ওয়ার্ডগুলোতে চেয়ারম্যান কর্তৃক অনুমোদিত প্রকল্পের কাজ নির্দিষ্ট করে দিবে। প্রতিটি ইউনিয়নে কর্মসৃজন প্রকল্পের জন্য নির্দিষ্ট সংখ্যক শ্রমিক থাকার বিধান রয়েছে। প্রতিটি প্রকল্পে শ্রমিকেরা দৈনিক ৮ ঘন্টা এবং ২০০ টাকা মজুরির বিনিময়ে ৪০ দিন কাজ করবে। প্রকল্পের নিয়মানুযায়ী কাজ সম্পন্ন হলে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ও ট্যাগ কর্মকর্তার অনুমোদনের পর শ্রমিকেরা তাদের ব্যক্তিগত একাউন্টের মাধ্যমে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করবে।

সোনাগাজী উপজেলার প্রতিটি ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডগুলোতে অনুমোদিত প্রকল্পের কাজের সরজমিনে দীর্ঘ অনুসন্ধান করে রাষ্ট্রীয় বরাদ্দের পরিকল্পিত আত্মসাতের ও অনিয়মের ভয়াবহ চিত্র বেরিয়ে এসেছে। রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতা থাকলেও রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ আত্মসাতের বিষয়ে অনুসন্ধানে প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে কোন ভিন্ন মতের লক্ষণ দেখা যায়নি। তবে কয়েকটি ইউনিয়নের কয়েকটি ওয়ার্ডে প্রকল্পের বিধান অনুযায়ী যথাযথ কাজের চিত্রও উঠে এসেছে।

প্রকল্পের অনিয়ম ও দুর্নীতির ক্ষেত্রে সরকার সমর্থক অন্তত একজন জনপ্রতিনিধির নেতৃত্ব দানের সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পাওয়া গেছে। উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নের স্থানীয়দের অভিযোগ, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা, ট্যাগ কর্মকর্তা ও প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা পরস্পরের যোগসাজসে অনুমোদিত শ্রমিকদের দিয়ে কাজ না করিয়ে মাটি কাটার শ্রমিক সর্দারের সাথে সামান্য টাকার চুক্তিতে অল্প মাটি ফেলে নামে মাত্র কাজ করছে। এরাই আবার পরস্পরের যোগসাজসে ভুয়া মাষ্টার রোল তৈরী করে শ্রমিকদের নাম ব্যবহার করে ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলনের পায়তারা করছে।

লক্ষনীয় বিষয় হলো, ইউনিয়ন পরিষদগুলোতে কর্মসৃজন প্রকল্পের জন্য যেসব শ্রমিকের নাম অন্তর্ভুক্ত রয়েছে তার ৮০ ভাগ ভুয়া ও গায়েবি শ্রমিক। কাগজে-কলমে এসব শ্রমিকের অস্তিত্ব থাকলেও বাস্তবে কোন অস্তিত্ব নেই।। বাস্তবে বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে দরিদ্র শ্রমিকের পরিবর্তে নিজেদের আত্মীয়-স্বজনদের নাম শ্রমিক হিসেবে অন্তভুক্ত করা হয়েছে যাতে অতি সহজে টাকা আত্মসাৎ করা যায়।

সরজমিনে দেখা যায়, ৪০ দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচির প্রকল্পগুলোতে অন্তত দুই ফুট উচ্চতার মাটি ফেলানোর নিয়ম থাকলে বাস্তবে তার ছিটেফোটাও নেই। প্রতিটি প্রকল্পের অগ্রভাগে সাইনবোর্ড টাঙ্গিয়ে প্রকল্প সম্পর্কে জনসাধারণকে অবহিত করার নিয়ম থাকলেও উপজেলার কোথাও সে রকম কোন সাইনবোর্ড দেখা যায়নি।

কাজ না করিয়ে শ্রমিকদের ভুয়া স্বাক্ষর দেখিয়ে টাকা উত্তোলনের বিষয়ে ব্যাংক কর্তৃপক্ষের যোগসাজসের অভিযোগ উঠেছে। নির্দিষ্ট পরিমাণ কমিশনের ভিত্তিতে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ শ্রমিক ছাড়াই প্রকল্পের সভাপতিদের টাকা উত্তোলনের সুযোগ দিচ্ছে।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রকল্পের সভাপতি এক ইউপি সদস্য জানান, কাজ হবে কোথা থেকে? প্রকল্প অনুমোদনের আগেই বরাদ্দের ৪০% টাকা নিজের পকেট থেকে নগদ দিতে হয়। আবার প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ও ট্যাগ কর্মকর্তাকে ১৫% ঘুষ দিতে হয়। আর না দিলে বিভিন্ন উছিলায় টাকা উত্তোলন করতে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে। প্রকল্প কমিটির বকি ৪ সদস্য ও স্থানীয় মাস্তানদের দিয়ে আর কাজ করার জন্য বেশী টাকা থাকেনা। একটা প্রকল্পের ৬০% টাকাতো ঘুষের পিছনেই চলে যায়। সুতরাং আমরা কাজ করবো কোথায থেকে এবং কিভাবে?

অস্তিত্বহীন শ্রমিকের নাম ব্যাবহার করে টাকা উত্তোলন ও আত্মসাতের বিষয়ে জানতে চাইলে তারা বলেন, ২০০ টাকা মজুরিতে কোন শ্রমিক পাওয়া যায় না। তাই আমরা বাধ্য হয়ে নিজেদের লোকদের শ্রমিক সাজিয়ে কোন রকমে নামকাওয়স্তে কাজ শেষ করি। টাকা আত্মসাতের হাতিয়ার হিসেবে কোন কোন জনপ্রতিনিধির বিরুদ্ধে সরকার বিরোধী বক্তব্য প্রদানের অভিযোগ উঠেছে। সরকারী বরাদ্দের টাকা পরিকল্পিতভাবে আত্মসাৎ করে সেই টাকা সরকারের বিরুদ্ধে সংঘঠিত নাশকতায় লগ্নি করার গুরতর অভিযোগও উঠেছে।

কাজ না করার বিষয়ে জনসাধারণ তাদের কাছে অভিযোগ করলে তারা সরকার উন্নয়নের জন্য কোন বরাদ্দ দেয় না, আমরা অনেক তবদির করে সামান্য বরাদ্দ এনেছি বলে সরকার বিরোধী বক্তব্য দিয়ে জনসাধারণকে সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলার অপচেষ্টা চালাচ্ছে।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা গেছে, কাজ না করে ভুয়া কাগজপত্র দাখিল করে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সহায়তায় ব্যাংকে থেকে টাকা উত্তোলন করে তা হরিলুটের চেষ্টা চালানো হচ্ছে। রাষ্ট্রীয় বরাদ্দের হরিলুটের বিষয়টি ইতোমধ্যে স্থানীয় জনসাধারণের অনেকে স্থানীয় সরকার মন্ত্রী, ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় ও জেলা প্রশাসককে লিখিতভাবে অবহিত করার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।

সচেতন সোনাগাজীবাসীর দাবী কর্মসৃজন প্রকল্পের টাকা হরিলুটের চেষ্টার সাথে জড়িতদের যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে আইনের আওতায় আনতে হবে। অন্যথায় গরীব শ্রমিকদের জন্য রাষ্ট্রীয় বরাদ্দ কোন কাজে আসবে না।

৪০ দিনের কর্মসৃজন প্রকল্পের বিভিন্ন অনিয়মের মাধ্যমে টাকা হরিলুটের বিষয়ে জানতে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ও উপজেলা পরিষদের শীর্ষ কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করা হলেও তাদের কোন বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

(এসএমএ/পিএস/জুন ১৭, ২০১৫)