প্রবীর বিকাশ সরকার : বাবা দিবস লোকান্তরিত পিতাকে স্মরণ করিয়ে দেয় এটা এই দিবসটির অন্যতম মহত্ত্ব। বাবাকে নিয়ে বাংলা সাহিত্যে ক’জন কবি, লেখক বা সাহিত্যিক আত্মজৈবনিক উপন্যাস লিখেছেন জানা নেই।

বাবার সঙ্গে আমার শৈশব থেকে যৌবনের প্রায় ২৫টি বছর অতিবাহিত করার সৌভাগ্য হয়েছিল। বাকী সময়টা তো প্রবাসেই কেটেছে বাবার অম্ল-মধুর সান্নিধ্য ছাড়া। সেই ২৫টি বছর আমি বাবার দৃষ্টিতে কীভাবে ধরা পড়েছি তারই স্মৃতিকথা ‘অতলান্ত পিতৃস্মৃতি’ গতবছর সাহিত্য সাময়িকী ‘নতুনধারা’য় প্রকাশিত হয়েছে তিন পর্বে। এটা আমার জীবনের এক মহাতৃপ্তিকর ঘটনা।

বর্তমান ছবিটি বাবার লোকান্তরিত হওয়ার বছর খানেক আগের ২০১১ সালের এপ্রিল মাসে আমি তুলেছিলাম কথা বলার ফাঁকে ফাঁকে। সেদিন নানা কথার সঙ্গে কুমিল্লার রাজাকারদের প্রসঙ্গ উঠেছিল। একসময় বাবা বললো, “পুলিশের অফিসার হওয়ার সুবাদে কুমিল্লার প্রভাবশালী মুসলিম লীগার যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকারি করেছে---যাদের সবাই ছিল আমার খুবই ঘনিষ্ঠ, একই আদালতে কাজ করেছি বহু বছর, কম সহযোগিতা করিনি যখন ধরা পড়ে জেলে ছিল বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত। কোর্টের এজলাশে বা জেলহাজতে যখন হাজির করা হতো চোখেমুখে ভিক্ষুকের মতো কী করুণ চাহনি! কী আকুতি-কাকুতি! কান্নাকাটি করে বলতো, “বাবু, রক্ষা করেন, একটা কিছু করেন বৌ, ছেলেমেয়েরা না খেয়ে আছে! যা অপরাধ করার তো করে ফেলেছি! মাফ চাইছি দেশের কাছে, সরকারের কাছে!.........এমনও হয়েছে এক রাজাকার উকিলের বাসায় গিয়ে দেখে এসেছি অবস্থা, কী করুণ! কী নিদারুণ দারিদ্রে না খেয়ে মরার উপক্রম পরিবারটির! ছোট ছেলেমেয়ে নিয়ে আদালতে এসেছিল বৌটা, খাবার কিনে দিয়েছিলাম! ........মানবতারে বাবা, স্রেফ মানবতার কারণে সহযোগিতা করেছি জামিন পেতে। আর এই ব্যাটারাই ১৯৭৫ সালে রাতারাতি আমূল বদলে গ্যালো! যেই সাপ সেই খোলস লাগিয়ে বনে গেল আবার রাজাকার! অবশ্য সমীহ করতো আমাকে, ভয়ও করতো যমের মতো। আমার সামনে কোনোদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে পারতো না! সেসব কথা কাউকে বলিনি কোনোদিন। ইতিহাস ঘুমিয়ে আছে ঘুমিয়ে থাক, একদিন নিজেই জেগে উঠবে। .......কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় কী জানো? এরা দীর্ঘ আযু পায়নি। অথচ দ্যাখো, আমি ৮৩ বছর বেঁচে আছি নানা ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করে। এরা জীবিতকালে একটা ‘ধন্যবাদ’ পর্যন্ত দেয়নি আমাকে!

কিছুক্ষণ থেমে থেকে বললো, এখন ওদের ছেলেমেয়ে, নাতি-নাতনি সুখ্যাত, কুখ্যাত হয়েছে আমার চোখের সামনেই কিন্তু বড় মানুষ হতে পারেনি। এর প্রধান কারণই হচ্ছে, পিতার সচেতন অপকর্ম সন্তানদের মাথাকে উঁচু করে তুলে ধরতে দেয় না।

এখন দেখছি বাবার কথাই সত্যি। বাবা জীবনকে যেভাবে গভীর দৃষ্টিতে দেখেছে দীর্ঘ সময় ধরে তাঁর দৃষ্টিকে ফাঁকি দেয়া কঠিন ছিল। আমরা তো জানি সবাইকে ফাঁকি দেয়া যায় কিন্তু জীবন-দার্শনিককে নয়। বাবা কী দার্শনিক ছিল?

লেখক : জাপান প্রবাসী