মো. শামীম মিয়া : ১৯৭১ সালের কথা, এক মা পাখির ভয়ংকর দশা। কত স্বপ্ন, আশা ভরা মনটা নিয়ে আনন্দে গুন গুন করে গান গাইছে, আর বটগাছে বাসা বাঁধছে। গ্রামের পর গ্রাম পেরিয়ে বয়ে আনছে খড়কুটো, বাঁধছে শক্ত করে নরম বাসা। যাতে তার সন্তানরা ভালো ভাবে বসবাস করতে পারে, স্থায়ী না হলেও অস্থায়ী ভাবে। মা পাখিটি প্রায় বিশ দিনের মধ্যে বাসা বাঁধা শেষ দেয়। এবার একটু বিশ্রাম নেওয়ার পালা। মা পাখি বিশ্রাম নিচ্ছে এমন সময় মনে পরে তার স্বামী অর্থাৎ বাবা পাখির কথা।

গত মাসে কোন একদিন হঠাৎ করেই মানুষের তৈরি একটা বড় পাখির পাখার সাথে লেগে বাবা পাখির দেহ খন্ডখন্ড হয়ে যায়। সেদিন বাবা পাখিটি মা পাখির জন্য অন্য গ্রাম থেকে আদার আনছিলো । বাবা পাখি আদার আনতে যাওয়ার সময় মা পাখিকে বলেছিলো, আমি আদার আনতে যাচ্ছি, তুমি বাসা বাঁধার জন্য ভালো কোন গাছ খোঁজ যাতে আমাদের সন্তানরা সুন্দর ভাবে জীবনযাপন করতে পারে। মা পাখি শুধু মাথা নেড়ে বলেছিলো, তুমি তাড়াতাড়িই ফিরে এসো। সেই যে গেলো বাবা পাখি আর ফিরে এলোনা। মা পাখিটির চোখের পানিতে বুকটা ভিজে যায়। শান্তনা দেওয়ার মত আশে পাশে কোন পাখি ছিলোনা। মা পাখি অনেক্ষণ অপেক্ষা করে মনে মনে ভাবে আমি ভেঙ্গে পড়লে চলবেনা। আমার স্বামী আমাকে অনেক দ্বায়িত্ব দিয়ে গেছে, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতে হবে। নইলে ওপারে আমার স্বামীর আত্মা খুব কষ্ট পাবে।

আমাকে প্রথমে ডিম পাড়তে হবে, তারপর ডিমে তা দিতে হবে এবং সন্তানদের লালন পালন করতে হবে। মনে অনেক দুঃখ মা পাখিটির তবুও মনকে শক্ত করে ঘুমিয়ে পড়লো। কারণ তার এখন ডিম দেওয়ার ভালো সময়, তাকে ভালো ভালো খেতে হবে। তবেই না সে ভালো ভাবে তার সন্তানের যত্ন নিতে পারবে।

কেটে যায় বেশ কিছুদিন: মা পাখিটি দুটি ডিম পেড়েছে। মা পাখি তার ডিম দুটি দেখে মনের দুঃখ সব ভুলে যায়। আনন্দে আলোকিত হয় তার মুখ, খুশিতে মা পাখিটি একদিন খুব হাসে। পরক্ষণেই তার মনটা ভার হয়ে যায় একটু। ডিম গুলোর নিরাপত্তার জন্য। তাই মা পাখি ঠিক করলো বেশি দুর বা অন্য গ্রামে আর আদার আনতে যাবে না। আশে পাশে যা আদার পাবে তা খেয়ে থাকবে। কারণ, মা পাখি যদি অন্য গ্রামে আদার আনতে যায় তাহলে ডিম গুলোর নিরাপত্তা থাকেনা । সাপ, মানুষসহ অন্য জীবজন্তু ডিমগুলো নষ্ট করতে পারে। মা পাখি পেটে পাথর বেঁধে ডিমগুলোতে তা দিতে লাগলো।

প্রায় এক মাস পর, ডিম দুটি থেকে দুটি পাখির ছানা হলো, একটি ছেলে পাখি,আরেকটি মেয়ে পাখি। মা পাখি খুব খুশি কারণ পাখি দুটি দেখতে ঠিক তার বাবা পাখির মত হয়েছে। ছানা দুটির নামও রাখলো মা পাখি, ছেলে পাখির নাম দুল আর মেয়ে পাখির নাম দুলি। মা পাখি অন্য পাখিদের জানায় তার ছানা দুটির কথা। সেই সুবাদে অন্য অন্য পাখিরা এসে দেখে যায় ছানা দুটি। অন্য পাখিরা দেখে বলে ছানা দুটি ঠিক তাদের বাবার মত হয়েছে। এদিকে মা পাখিকে অনেক কষ্ট করতে হয়, নিজের খাবার এবং ছানাদের খাবার সংগ্রহ করার জন্য। বাবা পাখি বেঁচে থাকলে হয়তো মা পাখির এতো কষ্ট হতো না।

দিনের পর দিন চলে যায়, দুল আর দুলি বড় হতে থাকে, সঙ্গে মা পাখির কষ্ট বাড়ে। কারণ, আগে যে আদার লাগতো, তার চাইতে এখন বেশি আদার লাগে। দুল আর দুলি মাকে খুব ভালোবাসে। মার কষ্ট তারা সহ্য করতে পারেনা। তাই সেদিন দুল আর দুলি মাকে বললো, মা আমরা তোমার সাথে আদার সংগ্রহ করতে যাবো। মা পাখি বললো, আরো দেরি আছে তোমরা বড় হও তারপর আমি তোমাদের আমার সাথে নিয়ে যাবো। দুল খুব দুষ্টু উড়তে পারে তবে কিছু দুর গিয়ে উল্টে পরে। তাই মা দুল আর দুলিকে সঙ্গে নেয়না। অনেক রাত হয়েছে, তাই মা দুল আর দুলিকে আদর করে ঘুমিেেয় দেয়, মা পাখি ও ঘুমিয়ে পরে। কিছুক্ষন পর মা পাখি স্বপ্নের রাজ্যে চলে যায়। মা পাখি স্বপ্ন দেখছে দুল আর দুলি তার সাথে আদার সংগ্রহ করছে এবং খাচ্ছে। দুল মাকে বলছে, মা এটা নয় ঐটা খাও, মজা পাবে।

দুলি বলছে, মা এটা নয় ঐটা খেয়ে মজা পাবে। হঠাৎ সকাল বেলা ফটফট শব্দে মা পাখিটার ঘুম ভেঙ্গে যায়। দুল-দুলিরও ঘুম ভেঙ্গে যায়। মা পাখি, ভাবতে লাগলো। শব্দটা তার কাছে পরিচিত মনে হচ্ছে, তাই সে গাছের উপরে গেলো এবং দেখতে পেলো মানুষের তৈরী সেই রাক্ষুসী বড় পাখিটিকে। মা পাখি চুপচাপ বাসায় ফিরে আসে এবং ছানা দুটিকে বুকে জড়িয়ে বসে থাকে। দুল মার ডানার ফাঁক দিয়ে রাক্ষুসী পাখিটিকে দেখছে। কোথায় গিয়ে নামলো সেইটাও দেখলো। দুল মা পাখিকে বললো, মা আমরাও বুঝি বড় হলে ওতো বড় পাখি হবো ? মা বললো, ঐ পাখির কাছে কখনো যাবেনা। দুল বললো, কেন যাবোনা মা ? মা পাখি বললো, ঐ পাখির কাছে গেলে আমাদের মত ছোট পাখিকে খেয়ে ফেলে, যেমন করে আমরা পোকামাকড় খাই। দুল বলে, না না আমি ঐ পাখির ধারে যাবো না।

অনেক বেলা হয়েছে ফটফট শব্দ আর নেই, তার মানে রাক্ষুসী পাখিও আর নেই। এই ভেবে মা পাখি আদার সংগ্রহ করতে গেলো প্রতিদিনের মতো, সেই গ্রামে যেই গ্রামে আদারের কোন অভাব নেই। কিন্তু আজ এ কী অবস্থা, মানুষগুলো ছুটাছুটি করছে, ঘর বাড়ি আগুনে পুড়ছে। মা পাখিটি অবাক দৃষ্টিতে দেখছে। মানুষের কষ্ট দেখে পাখিটিও কাঁদছে। আবার পাখিটির কানে ফটফট শব্দটা ভেসে আসলো, মা পাখিটি লক্ষ্য করলো রাক্ষুসী পাখির ভেতরে কয়েকজন মানুষও আছে। পাখিটি অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রাক্ষুসী পাখিটির দিকে আর মনে মনে বলছে, হায় আল্লাহ! মানুষের তৈরি পাখিটি মানুষেরই ক্ষতি করছে। রাক্ষসী পাখি উড়াল দিলো বটগাছটার দিকে। কিছুক্ষণ পর পাখিটির মনে হলো তার ছানাদের কথা। মা পাখি উড়াল দিলো বটগাছের দিকে, বটগাছের কাছে আসতেই দেখতে পেলো বটগাছটি আগুনে পুড়ছে। অবাক দৃষ্টিতে পাখিটি তাকিয়ে আছে শব্দহীন বটগাছটার দিকে, তার মুখে কোন কথা নেই, শুধু চোখ ভরা পানি।

দূর থেকে পাখির কানে ভেসে আসছে গ্রামের লোকজনদের কথা, এখানে বোমা মেরেছে পাকিস্তানীরা। মা পাখিটি শব্দহীন অবস্থায় দেখছে তার স্বপ্নকে পুড়ে যেতে। কিছু করার ছিলো না তার, এতো সহজে স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। তারও রক্ষা নেই। কী করবে ভেবে পাচ্ছেনা মা পাখিটি। অবশেষে চোখ ভরা স্বপ্ন মন আশাকে কবর দিয়ে উড়াল দিলো অচীনদেশের অস্থায়ী একটি শহরের উদ্দেশে।


একদিন এই দেশ স্বাধীন হলো, ত্রিশ লক্ষ তাজা প্রাণের বিনিময়ে। স্বাধীন হলো গ্রাম। মা পাখিটি সেই যে চলে গেলো, আর ফিরে এলো না।