শোভন সাহা : আমাদের দেশের মানুষকে একসময় মাছে ভাতে বাঙালি বলা হতো। কিন্তু কালের বিবর্তনে পরিবর্তন হয়েছে বাঙালিদের আচার-আচরণ সহ অনেক কিছুই। বাঙালিকে এখন অনেকে কাঙ্গালও বলে থাকে।

বর্তমানে শুধু বিভিন্ন রোডই নয়, লেক, পার্ক, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, মসজিদ, মন্দির, হাসপাতাল, রেস্টুরেন্ট, শপিংমলের সামনে যেন ছোট বড় সকল বয়সের ভিক্ষুকদের মিলনমেলা।

আমাদের দেশে প্রতিনিয়ত কোন না কোনভাবে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে। তারপরও সমাজের এক পেশার মানুষ প্রতিনিয়ত বেছে নিচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তি। ভিক্ষাবৃত্তি বর্তমানে সাধারণ মানুষের মাথা ব্যথার কারণ না হলেও আমাদের দেশের সরকারের চিন্তার কারণ। এই পেশা বর্তমানে আমাদের দেশের সম্মানের প্রশ্নও বটে।

আমাদের দেশের ইতিহাস ও গৌরব কোন অংশে অন্য কোন জাতির তুলনায় কম নয়। আমাদের দেশ স্বাধীন হবার পরও এত ভিক্ষুক ছিল না। কিন্তু বর্তমানে ভিক্ষুকদের জন্য রাস্তা বা অন্য কোথাও যাতায়াত সত্যিই বিরক্তিকর হয়ে উঠেছে।

বর্তমানে বাংলাদেশে ছোট বড় সকল বয়সের মানুষই আস্তে আস্তে জড়িয়ে পড়ছে এই পেশায়। তবে ৫০-৬০ বছর বয়স্কদের সাথে ৫-১২ বছরের শিশুদের এই ভিক্ষাবৃত্তির প্রতি আগ্রহ ধীরে ধীরে বাড়ছে। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রেস্টুরেন্টের সামনে এই পেশার মানুষদের চলাফেরা সব সময় চোখে পড়ে।

রাস্তার বিভিন্ন খাবারের দোকান থেকে যখন পথচারীরা তাদের খাবার সংগ্রহ করে থাকে তখন তাদের নিকট থেকে বিভিন্নভাবে খাবার অথবা টাকা আদায়ের একটা প্রচেষ্টা করে থাকে ভিক্ষুকরা। তারপরও অনেক শিক্ষার্থীই শুধু নয়, সমাজের শিক্ষিত ও বিত্তবান শ্রেনীর মানুষরাও ভিক্ষুকদেরকে সাহায্য করছে।

কিন্তু কোন সময় যদি পথচারীরা তাদেরকে এড়িয়ে যেতে চাই তাহলে অনেক সময় বিভিন্ন ধরনের বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হয় সমাজের সাধারণ মানুষদের। অনেক সময় আবার ভয় ভীতি বা অভিশাপের কথা বলে আদায় করা হয় টাকা। আমরা হয়ত অনেকেই জানিনা তাদের দৈনিক আয় ৫০০-৫০০০ টাকা পর্যন্ত।

ভিক্ষাবৃত্তি এমন একটি পেশা যে পেশায় কোন বিনিযোগ নেই, পরিশ্রম নেই। শুধু নাটক আর অভিনয় করতে পারলেই কেল্লা ফতে। অনেক সময় পথচারীরা পূণ্যলাভের আশায় ভিক্ষুকদের বিভিন্নভাবে সাহায্য করে থাকে। এরপরও পান থেকে চুন খসলেই তো অভিশাপ আর সাথে উপহার হিসেবে পাওয়া যায় অনেক ধরনের বিদ্রুপ। কিন্তু আমরা অনেকেই জানি না যে ভিক্ষার অর্থ যা আমরা তাদের হাতে তুলে দিচ্ছি তাতে হয়তো তাদের কোন অধিকার নেই।

ঢাকা শহর শুধু নয়, সমগ্র বাংলাদেশের পথে ঘাটেই এখন ভিক্ষুকদের উপদ্রব ক্রমশ বাড়তে শুরু করেছে। অনেক সময় তারা সংঘবদ্ধ হয়ে ভিক্ষা করে থাকে। তাছাড়া রমজান মাসে ঈদকে কেন্দ্র করে এখন ভিক্ষুকদের সংখ্যা আরো বেড়েছে।

ভিক্ষুকদের বিষয়ে কথা বলতে চাইলে একজন পথচারী আশিক বলেন, ‘বর্তমানে আমার তো বাসার বাইরে কোন জায়গায় যেতেই ইচ্ছা করে না এই ভিক্ষুকদের যন্ত্রণায়। রাস্তায় দাঁড়িয়ে কিছু খাচ্ছি, কিন্তু হঠাৎ করে দেখি বাচ্চা ছেলে-মেয়েদের সাথে আরো অনেক বয়সের মানুষ এসে বলতে থাকে সে ২ দিন ধরে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে, ছেলে-মেয়ে অসুস্থ ইত্যাদি। এগুলো এখন আর দেখতে বা শুনতেও ভাল লাগে না। তাদের যদি চলে যেতে বলা হয় তারা তো তা শোনেও না, বরং বিরক্ত হয়ে আমাকেই চলে আসতে হয়।’

রাস্তার আরো এক পথচারী বলেন, ‘আমি একদিন দুপুরে ধানমন্ডি লেকে বসে আছি। দেখি, একজন পঙ্গু মানুষ আমার কাছে সাহায্য চাইল। কিন্তু আমি তার আবেদনে সাড়া না দিলে সে চলে যায়। মানুষটি কিছু দূর যাবার পর আমি দেখি সে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক মানুষের মতো দুই পা দিয়েই হাঁটছে। এই দৃশ্য দেখে তো আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলাম।’

কিছু মানুষ নিশ্চিত ভিক্ষা লাভের জন্য নিজেদের বিকলাঙ্গ ও বিকৃত চেহারা দেখিয়ে রাস্তাঘাটে ভীতিকর পরিবেশ তৈরি করে অর্থ সংগ্রহ করছে। অনেকে শিশুদের দিয়ে এভাবে অর্থ উপার্জন করিয়ে থাকে। করুণ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় যখন দুধের শিশুকেও ভাড়ায় নেওয়া হয়।

ভিক্ষাবৃত্তি একটি সামাজিক ব্যধি। দারিদ্র্য এটির অন্যতম কারণ। দরিদ্রতার অভিশাপ থেকে মুক্তি লাভের আশায় অনেকে বেছে নেয় মানবতার চরম অবমাননাকর এই পেশা। তারপরই এই পথে গরিব শ্রেনীর এই সকল মানুষ হয়ে ওঠে স্বচ্ছল।

ভিক্ষা কোন স্বীকৃত বা সম্মানজনক পেশা নয়। আর যেখানেই লোকজনের সমাগম হয়, সেখানেই এখন এই চক্রটি সক্রিয়ভাবে তাদের কাজ করতে থাকে। ভিক্ষাকে কোন পেশা বলে গণ্য করা হয়না। ভিক্ষাবৃত্তি বিশ্বের অতি প্রাচীন এক বাজে ধারণা।

কলাবাগান যাত্রীছাউনির কছে জাহানারা, আনোয়ারা, জামিলাসহ আরো অনেক ভিক্ষুকের সাথে কথা বললে তারা বলেন, ‘আমরা অনেক কষ্ট পাই যখন আমাদের সাথে অনেক পথচারী খারাপ ব্যবহার করে। এখানে আমাদের প্রত্যেকের বয়স ৫৫-৭০ বছরের মতো। রাতে বা দিনে আমাদের থাকার জায়গা বলতে শুধু এই রাস্তাই। যারা প্রকৃত ভিক্ষুক তারা ভিক্ষা পায় না। আর আমরা তো বুঝি এই পেশা ভাল না। কিন্তু এই ভিক্ষা না করলে আমারা কি খাব? অনেক সময় শুনি সরকার থেকে অনেক সাহায্য আসে। কিন্তু আমরা তা কোনদিনও পাইনি। আমাদের ছেলে-মেয়ে আছে, কিন্তু তাদের অনেকের সংসারেই অভাব। আবার অনেকেই তাদের নিজের মা-বাবার সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করেছে। তাছাড়া সত্যিকারের ভিক্ষুকদের চেয়ে সাজানো ভিক্ষুকদের আয়ও বেশি।’

ধানমন্ডির পরিচিত পথশিশু সুমন। তার সাথে কথা বলে জানা যায় বিভিন্ন শিক্ষার্থীরা তাকে টাকা দেয়। সে কোন স্কুলে যায় না। তার দৈনিক আয় প্রায় ৩০০-৫০০ টাকা। তাছাড়া তার পরিবারের জন্য তার এই উপার্জিত টাকা খুবই কাজে আসে।

মর্যাদাপূর্ণভাবে আমাদের এই দেশকে সাজাতে প্রথমেই এই ভিক্ষাবৃত্তির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। ভিক্ষাবৃত্তি বন্ধ করতে বাংলাদেশে নতুন আইন পাশ হচ্ছে। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত বলেন, এই আইন তাদের জন্য প্রযোজ্য হবে যারা অসুস্থতার ভান করে বা প্রতিবন্ধী সেজে টাকা পয়সা আদায় করে থাকে।

২০১১ সালের ৩০ সেপ্টেম্বরে রাজধানীতে শুরু হয়েছিল ভিক্ষুক জরিপের একটি কাজ। সেই জরিপের তথ্য অনুযায়ী প্রাথমিকভাবে ১০ হাজার ভিক্ষুকের নাম উঠে আসে এবং ২ হাজার ভিক্ষুকদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে সরকার।

(এসএস/পিএস/জুন ২২, ২০১৫)