পরিতোষ বড়ুয়া লিমন : আজ ৩০ জুন। ১৬০ বছর আগে ইতিহাসের এই দিনে একটি শক্তিশালী বিদ্রোহ সংগঠিত হয়েছিল, যা সাঁওতাল বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

সাঁওতাল বিদ্রোহ বা সান্তাল হুল এর সূচনা হয় ১৮৫৫ সালে পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ ও বিহারের ভাগলপুর জেলায়। ইংরেজ আমলে স্থানীয় জমিদার, মহাজন ও ইংরেজ কর্মচারীদের অন্যায় অত্যাচারের শিকার হয়ে সাঁওতালরা ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলে।এটি ছিল তাদের বিরুদ্ধে প্রথম সশস্ত্র গণসংগ্রাম। তাদের এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয় সিধু, কানু, চাঁদ প্রমুখ। ১৮৫২ সালে লর্ড কর্নওয়ালিশের প্রবর্তিত চিরস্থায়ি বন্দোবস্তের ফলে তাদের উপর অত্যাচার বেড়ে গিয়েছিল। তাই সিপাহী বিদ্রোহের আগে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে সাঁওতালরা সোচ্চার হয়েছিল।

১৮৫৫ সালে সাঁওতালরা সশস্ত্র সংগ্রাম করেছিল তাদের অধিকার আদায়ের জন্য। তারা এ যুদ্ধ ঘোষণা করেছিল ইংরেজদের শাসন-শোষণ, সুদখোর, মহাজন ও ব্যবসায়ীদের বিরুদ্ধে। এ যুদ্ধের উদ্দেশ্য ছিল বৃটিশ সৈন্য ও তাদের দোসর অসৎ ব্যবসায়ী, মুনাফাখোর ও মহাজনদের অত্যাচার, নিপীড়ন ও নির্যাতনের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করা এবং একটি স্বাধীন সার্বভৌম সাঁওতাল রাজ্য প্রতিষ্ঠা করা। সান্তাল হুলের ইতিহাস হতে জানা যায় দামিন-ই কোহ ছিল সাঁওতালদের নিজস্ব গ্রাম, নিজস্ব দেশ।

১৮৫৫ সালের ৩০ জুন যুদ্ধ শুরু হয় এবং ১৮৫৬ সালের নভেম্বর মাসে তা শেষ হয়। সাওতাঁলরা তীর-ধনুক ও দেশীয় অস্ত্র সস্ত্র নিয়ে যুদ্ধ করলেও ইংরেজ বাহিনীর হাতে ছিলো আধুনিক বন্দুক ও কামান। তারা যুদ্ধে ঘোড়া ও হাতি ব্যবহার করেছিল।এ যুদ্ধে ইংরেজ সৈন্যসহ প্রায় ১০ হাজার সাঁওতাল যোদ্ধা শহীদ হন। সাঁওতাল বিদ্রোহের লেলিহান শিখা বৃটিশ সরকারের মসনদ কাঁপিয়ে দিয়েছিল।

এই সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ১৮৫৬ সালের ২৭ জানুয়ারি লেফটেন্যান্ট ফেগানেরর বাহিনীর সঙ্গে ভাগলপুরে সাঁওতালদের মুখোমুখি যুদ্ধ হলো। যুদ্ধে মারা গেলেন সিধু-কানুর দুই ভাই চাঁদ ও ভৈরব। শুধু সিধু-কানুর ভাই-ই না, তারা ছিলেন সাঁওতালদের দুইজন বীরযোদ্ধা। এসময় সিধু-কানুর খোঁজে ইংরেজ সৈন্যরা গ্রামে গ্রামে হানা দিতে শুরু করলো। সাঁওতালদের উপর চালাতে লাগলো অমানুষিক নির্যাতন। সে নির্যাতন সইতে না পেরে কয়েকজন সাঁওতাল সিধু-কানুর গোপন আস্তানার খবর ইংরেজ সৈন্যদের বলেই দিলো। ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় সপ্তাহে ইংরেজ সৈন্যরা সিধুকে তার গোপন আস্তানা থেকে গ্রেফতার করে সেখানেই গুলি করে মেরে ফেলে । আর তার পরের সপ্তাহে বীরভূমের জামতারা থেকে পুলিশ কানুকে গ্রেফতার করে। পরে তাকে ফাঁসি দেয়া হয়। এই দুই বীর নেতার মৃত্যুর পর বিদ্রোহী সাঁওতালরা পরাজয় মেনে নেয়। এই বিদ্রোহে প্রায় ২৫ হাজার সাঁওতাল মারা গিয়েছিলো।

সাঁওতাল জাতির ইতিহাসে সিধু-কানুর নেতৃত্বে সাঁওতাল যুদ্ধই ছিলো সব থেকে বড় এবং গৌরবের। তাদের এই বিদ্রোহই ভারতবর্ষে স্বাধীনতার বীজ বপন করে গিয়েছিল। এই যুদ্ধের ফলাফল ইংরেজ সরকার সাঁওতালদের অভিযোগ সম্পর্কে তদন্তের ব্যবস্থা করলেন। ম্যাজিট্রেট এডন সাহেব সাঁওতালদের আবেদন শুনলেন। যুদ্ধের পরে সাঁওতালদের সমস্যা বিবেচনা করে আদিবাসী সাঁওতালদের জন্য একটি জেলা বরাদ্দ করা হলো। এই জেলার নাম হলো ডুমকা। এটাই সাঁওতাল পরগনা নামে পরিচিত। এখানে সাঁওতাল মানঝি, পরানিক, পরগনা জেলার শাসন পরিচালনার জন্য দারোগা, পুলিশ ও বিভিন্ন সরকারী কমকর্তা-কর্মচারী ক্ষমতা প্রাপ্ত হলো। সাঁওতালদের বিচার সালিশ তাদের আইনে করার জন্য সরকার ক্ষমতা প্রদান করলেন। খাজনা, কর প্রভৃতি তাদের হাতে অর্পণ করা হলো। তারা জেলা প্রশাসক বা ডিসির নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হতে থাকলো। ১৮৮৫ সালে বেঙ্গল টেনান্সি এ্যাক্ট অনুযায়ী আদিবাসীরা তাদের জমি সরকারী অনুমতি ছাড়া বিক্রি করতে পারতো না। এই আইন এখন পর্যন্ত কার্যকর আছে।

স্বাধীনতা সংগ্রামে মুক্তিকামী মানুষের মনে আজও অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে কাজ করেছে সাঁওতাল বিদ্রোহ। সাঁওতাল বিদ্রোহের ১৬০তম বার্ষিকীতে গভীর শ্রদ্ধায় স্মরন করছি সেদিনের সব সাঁওতাল বিদ্রোহী ও শহীদদের। তাঁদের সবার প্রতি আমাদের গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি।

তথ্যসূত্র : ইন্টারনেট