আমার বয়স পঁয়ত্রিশ। মানুষের গড় আয়ুর হিসাবে বয়সটা খুব বেশিও না আবার কমও না। তবে জগৎ সংসারের যে বয়স তার নিরিখে এই বয়সের ব্যাপ্তি অতি ক্ষুদ্র। সময়টা হতে পারে চোখের একটি পলকেরও কয়েকশো ভাগের এক ভাগ। এই স্বল্প সময়ে আমার পচনশীল চর্মচোখে দেখেছি অতি সামান্যই।

ত্যাগের অপর নাম কি প্রেম নয়? সংযমের অপর নাম কি ভালোবাসা নয়? আমার দৃষ্টিতে রমজান অনেক-অনেক বড় প্রেম। মহান আল্লাহ্ তা’য়ালার জন্য তাঁর বান্দাদের পক্ষ হতে রমজান হচ্ছে ভালোবাসার এক অকৃত্তিম বহিঃপ্রকাশ।
রমজান সম্পর্কে আল্লাহ্ তা’য়ালা বলেন,
“রমজান মাসই হলো সেই মাস, যাতে নাজিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের হেদায়েত এবং সত্যপথ যাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে, সে এ মাসে রোজা রাখবে। আর যে লোক অসুস্থ কিংবা মুসাফির অবস্থায় থাকবে সে অন্য দিনে সংখ্যা পুরণ করবে। আল্লাহ তোমাদের জন্য সহজ করতে চান; তোমাদের জন্য জটিলতা কামনা করেন না, যাতে তোমরা সংখ্যা পূরণ কর এবং তোমাদের হেদায়েত দান করার দরুণ আল্লাহ তা’য়ালার মহত্ব বর্ণনা কর, যাতে তোমরা কৃতজ্ঞতা স্বীকার কর।”
সুরা বাকারা- (আয়াত: ১৮৫)
মানুষ হয়ে আল্লাহর আদেশ আপনি মানুন, আর না মানুন তার জন্য মহান আল্লাহ্ তা’য়ালার কোনো কিছু যাবে আসবে না। মানুষকে তিনি ভালোবেসে সৃষ্টি করেছেন, তিনি মানুষের জন্য কল্যাণ চান। আর এই উপলব্ধিটুকু যাদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে কেবল তারাই এই প্রেমে অংশ নিতে পেরেছে। রমজান মাস, যেন গণপ্রেমের মাস। ছেলে থেকে জোয়ান, কুজো থেকে বুড়ো সকলে একযোগে তাঁর জন্য, তাঁর হুকুম পালন করার জন্য, রোজা রাখছে। মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনে রোজাদার বান্দারা সারাদিনে এক ফোটা পানিও পান করে না ! অদ্ভুত প্রেম বটে ! কিন্তু যার জন্য এতো পরিশ্রম, এতো আয়োজন, তাকে তো কেউ কোনোদিন দেখেই নি। এ কেমন প্রেম ? কেমন ভালোবাসা ? পৃথিবী বড় নিষ্ঠুর। এখানে প্রতিদান ছাড়া কেউ কাউকে কিছু দেওয়া তো দূরে থাক কারো দিকে ফিরেও তাকায় না। অথচ যাকে কেউ কখনও দেখেনি তাঁর জন্য এত আয়োজন ! হিম্মতের প্রয়োজন আছে। অবশ্যই অদৃশ্যের প্রতি ইমান এনে রমজান পালন করার মধ্যে হিম্মতের প্রয়োজন আছে। আর এই হিম্মতওয়ালাদের জন্য, অদৃশ্যে ইমান আনয়নকারীদের জন্য মহান আল্লাহ্ তা’য়ালা এত পুরস্কার রেখেছেন যে মানুষ তা কল্পনাও করতে পারে না। হুজুরে পাক (সা.) এর একটি হাদিসে বর্ণিত আছে,
“খালিদ ইবনে মাখলাদ রঃ... সাহল রাঃ থেকে বর্ণিত নবি করিম (সাঃ) বলেন, জান্নাতে রায়্যান নামক একটি দরজা আছে। এ দরজা দিয়ে কিয়ামতের দিন সাওম পালনকারীরাই প্রবেশ করবে। তাদের ছাড়া আর কেউ এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। ঘোষণা দেওয়া হবে সাওম পালনকারীরা কোথায়? তখন তারা দাঁড়াবে। তারা ছাড়া আর কেউ এই দরজা দিয়ে প্রবেশ করবে না। তাদের প্রবেশের পরেই দরজা বন্ধ করে দেওয়া হবে। যাতে এই দরজা দিয়ে আর কেউ প্রবেশ না করে। বুখারী শরীফ- সাওম অধ্যায় (হাদিস নং- ১৭৭৫)

আমার পাশের বাড়ির এক ঘরে তিনটি প্রজন্ম একসাথে বাস করে। ছেলে, বাবা এবং দাদা। এক জনের মুখে এখনও গোঁফ-দাঁড়ি গজায় নি, এই রমজানে সে রোজা রেখেছে। আরেক জনের মুখে কুচকুচে কালো দাঁড়ি সেও রোজা আছে। আর যার মুখের দাড়ি ধবধবে সাদা হয়ে গেছে মহান আল্লাহ্কে খুশি করার জন্য সেও রোজা পালন করছে। আহা, ঘরে ঘরে তাঁর জন্য কতো প্রেম! বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ, শতাব্দীর পর শতাব্দী মহান আল্লাহর প্রতি প্রেমের এই ধারা অব্যাহত রয়েছে। মহাপবিত্র আল্লাহ্র প্রতি বান্দার প্রেমের এই পরিমাণ দিনে দিনে বেড়েছে বৈ কমেনি। যার জন্য এতো আয়োজন বান্দার প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতিও কম নয়। রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন,
“ যে ব্যক্তি আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যে মাত্র একদিন রোজা রাখে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা তাকে জাহান্নাম থেকে এতটা দূরে সরিয়ে দেবেন যতটা দূরে যায় একটি কাক, যে শিশুবেলা থেকে উড়তে থাকে। পরিশেষে সে বৃদ্ধ হয়ে মারা পড়ে।”
মিশকাত শরীফ- (১৮১ পৃষ্ঠা)
রমজান এত মর্যাদাপূর্ণ একটি ইবাদত যে মহান আল্লাহ্ তা’য়ালা ঘোষণা করেছেন, এর প্রতিদান তিনি স্বয়ং নিজে দিবেন। রমজান পালন মানে শুধু সারাদিন না খেয়ে কাটানো নয়। রমজান আত্মশুদ্ধির জন্য, রমজান সংযমের জন্য, রমজান আল্লাহ্র সাথে প্রেমের জন্য। আমরা অনেকেই রমজানের তাৎপর্য বুঝি না। কোনো দ্বীনি আলেম ব্যক্তির থেকে জেনে বুঝে যখন আমরা এই আমল করব ঠিক তখনই আমাদের আমল হয়ে যাবে লক্ষ-গুণ বেশি সওয়াব সমৃদ্ধ আমল। তাই পবিত্র এই রমজান মাস যারা পেল এবং সকল প্রশংশার অধিকারী মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের আশায় রোজা রাখল তারা কতো ভাগ্যবান ! পক্ষান্তরে রহমত, মাগফেরাত ও নাজাতের এই মাসে যারা যোগ্য-সমর্থ হয়েও রোজা রাখতে পারলো না তারা কতো অভাগা। ঐ অভাগাদের জন্য সত্যিই আমার খুব দুঃখ হয়। মহান আল্লাহ্ তা’য়ালা পবিত্র এই রমজান মাসে আমাদের সকলকে রোজা পালন করে তার নৈকট্য লাভে তোফিক দান করুন -আমিন।


(এআরএ/এসসি/জুলাই০২,২০১৫)