তখন আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র ১৯৭১ সালের ২১ শে এপ্রিল ভোর ৫টার দিকে পাক বাহিনীর গানবোট পদ্মা নদী পার হয়ে রাজবাড়ী শহরে প্রবেশ করে। আমি তখন ইউনাভার্সিটি হলে তখন কার্জন হলের পাশের মাঠে আমরা ট্রেনিং নিতাম আমাদের ট্রেনিং দিতেন ২জন রিটায়ের্ড আমি অফিসার কিছু কোন অস্ত্র পাঠনিশুধু কিছু ডামি রাইফেল ছিল তাও আবার সেগুলি দেওয়া হতো মেয়েদের হাতে।

১৯৭১ মার্চ মাসের ৮ কিংবা ৯ তারিখে এয়ারফোর্সের একজন অফিসার ফোন করেছিলেন আক্রমন হতে পারে। এই বিষয়টি কিছু সময়ের মধ্যে ছড়িয়ে পরে। তখন আমি ন্যাফ ছাত্র ইউনিয়ন করতাম ।পার্টি থেকে নির্দেশ আসলো যে যার যার মতো নিজ নিজ এলাকাতে চলে যেতে । কিন্তু যাওয়াটাও এত সহজ ছিল না ,কারন অসহযোগ আন্দোলন চলছিল যাতায়াত ব্যবস্থা খুব কঠিন যাইহোক আমরা ১৩ জন ছাত্র একত্রিত হলাম তার ভেতর ৬ জন ছাত্রী ছিল যাদের বাড়ী ছিল কুষ্টিয়া অঞ্চল এর দিকে ;আমরা ভোরে রওনা দিয়ে সারাদিন ধরে আরিচা ঘাটে পৌছালাম। ঘাট পার হয়ে যে যার বাড়ীতে চলে আসলাম।
রাজবাড়ীতে এসেই যোগাযোগ করলাম পার্টি অফিসের সাথে ,তখন ন্যাফ কমিউনিষ্ট ছাত্র-ইউনিয়ন এর অফিস ছিল রাজবাড়ী তালপট্টিতে ওখানে পার্টির সবাইকে ট্রেনিং করানো হতো অস্ত্র ছাড়াই। আর একটা ট্রেনিং করানো হতো রাজবাড়ী গর্ভমেন্ট হাইস্কুল মাঠে এর মধ্যে ২৬শে মার্চ, ঢাকা আক্রান্ত হলো আর এদিকে কুষ্টিয়াতে পাক আর্মি অপারেশন চালাতে লাগলো পাক আর্মি দের জবাব দেবার জন্য রাজবাড়ী আনসার, বি ডি পি, বেলগাছির বকুল চৌধুরী সহ আমাদের অঞ্চলের কিছু মানুষ কুষ্টিয়া অপারেশনে যায়।

তিন দিন যুদ্ধের পর কুষ্টিয়া জয় করে তাঁরা ফিরে আসলেন কিন্তু ওই অপারেশন রাজবাড়ীর ১ জন শহীদ হলেন তখন আমি রাজবাড়ীতে, আমাদের পরিবারের সবাই আগেই গ্রামের বাড়ী জৌকুরাতে চলে গিয়েছিল। আমি ,আমার মেজদা, ফজর আলী (আমদের বাড়ীতে থাকত) এবং আনসার কমান্ডার বিশু মোল্লা ১২টা কি ১২.৩০ টার দিকে রওয়ানা হলাম। যাবার পথে ছিনতাই রাহাজানির মুখোমুখি হতে হলো ।তখন রাজবাড়ী বিভিন্ন স্থানে আগুন জ্বলছে কোন রকমে জৌকুরা পৌছালাম,কিন্তু বাড়ী পৌঁছে দেখলাম আমার পরিবারের কারোরই জায়গা হয়নি আমাদের বাড়ীতে। কারন তৎকালীন এমপি কাজী হেদায়েত হোসেন এবং তার প্রায় ৭০ জন লোক আমার বাড়ীতে অবস্থান করছে, এবং আরো ৪/৫ টি পরিবার আমার বাড়ীতে অবস্থান করছে। আমার পরিবার আমাদের সবাই আমাদের শরিকদের বাড়ীতে একটি ঘর নিয়ে থাকলাম।

প্রায় ২৩ দিন মতো তারপর জৌকুরা যখন আক্রান্ত হলো তখন আমি এবং আমার পরিবারের সবাই চলে গেলাম চরের ভেতরে আমাদের এক বর গাদার এর বাড়ীতে সে আমাদের আশ্রয় দিয়েছিল। সে নিজের ঘর ছেড়ে দিয়ে তার পরিবার থাকত বারান্দায় আর আমরা থাকতাম ঘরের ভিতরে। ঐ বাড়ীতে কয়েকদিন কাটানোর পর চলে গেলাম সাগরকান্দি, সাগরকান্দি থেকে নাজিরগঞ্জ ঘাট পাড়ি দিয়ে পাবনা জেলায় ঢুকলাম ঢোকার পথেই দেখতে পেলাম প্রায় ৩০০ এর বেশি ডেট বডি।

কারণ পাক আর্মি এসে এদেরকে মেরে ফেলে গেছে। সেখান থেকে রওয়ানা দিয়ে উঠলাম খোকসা আমবাড়িয়া ঘাট সেখানে পরিচয় হল আরজু রহমান নামে একজন ব্যক্তির সাথে। সে আমাদেরকে নিয়ে সেখানকার একটি স্কুলে থাকার ব্যবস্থা করল। কিন্তু সেখানে আগে থেকেই আরো অনেক পরিবার অবস্থান করছিল। আমি তখন আরজু কে বললাম কোন বাসায় একটু থাকার ব্যবস্থা করা যায় কিনা। সেখানে সোহবার হোসেন নামে একজন লোক বললেন আপনারা আমার বাড়ীতে থাকবেন।

সেই বাড়ীতে এক রাত্রি থাকার পর ভোরে যখন রওয়ানা হব তখন জানতে পারলাম খোকসার ভেতর দিয়ে যাবার কোন উপায় নেই কারন খোকসার সেই সময়কার চেয়ারম্যান আকামউদ্দিন সব ইয়ং ছেলেমেয়েদের ধরে আটকিয়ে রেখেছেন। আর বৃদ্ধদেরকে ছেড়ে দিয়েছেন। দেখলাম প্রায় ৮০ টি ঘোড়ার গাড়ী ফেরৎ আসল। চারদিকে কান্নাকাটির রোল পড়ে গেল। আকামউদ্দিন ৩৭ জন ছেলে মেয়েকে পাক আর্মির হাতে তুলে দিয়েছেন। এমতবস্থায়, রওয়ানা দেওয়া সম্ভব নয়। আমাদের সাথে ছিলেন আমাদের এক কাকা তিনি বললেন এভাবে যাওয়া যাবে না। চল বাড়ীর দিকে ফিরে যাই। কিন্তু আমিতো দেশে যাবোনা, যে কোন উপায়ে ভারতে যাব সেখানে ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধে যোগ দেব।

কাকাকে বললাম, আপনি গেলে যান আমি যাবনা। আমার কাকা তার পরিবার নিয়ে নদী পথে রওয়ানা দিলেন। আমি আর আমার ছোট ভাই ভারতের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। আরজু আমাদেরকে ২ জন লোক দিল পথ চিনিয়ে নেওয়ার জন্য। আমরা পায়ে হেঁটে রওয়ানা দিলাম। রবি ঠাকুরের কুঠি বাড়ী পর্যন্ত আসতেই সন্ধ্যা হয়ে গেলো। কুঠি বাড়ীর পাশে এক পুরহিত বাড়ী ছিল আমার পূর্ব পরিচিত সেখানে আমাদের আশ্রয় মিলল এবং সেই সাথে খাবার। এদিকে আমার কাছে ২৭ টাকা ছাড়া আর কিছু নাই। বাড়ীর পুরহিতের বউকে বললাম আমাদের খুব ভোরে রওয়ানা দিতে হবে। তিনি আমাকে বললেন তোমরা অনেক ক্লান্ত আগে খাওয়া দাওয়া করে ঘুম দেও। আমি ভোরে তোমাদেরকে ডেকে দেবো। যথারিতী ভোর ৪.০০টার সময় তিনি আমাদেরকে ডেকে দিলেন আমরা রওয়ানা দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হচ্ছি। তখন দেখলাম আমাদের সকালের খাবার ও প্রস্তুত। সেইসাথে একটি পোটলায় করে চিড়া, মুড়ি, গুড় বেঁধে দিয়েছেন।

আমরা রওয়ানা দিয়ে তালবাড়ীর ঘাট পাড়ি দিলাম। এদিকে আমার ছোট ভাই বলল দাদা এখানে আমার এক বন্ধু ছিল চল তার খোঁজ করে নিই। আমরা মাঝিকে তার কথা বলতেই সে চিনতে পারল এবং সেই বাড়ী দেখিয়ে দিল। আমরা সেই বাড়ীতে গিয়ে খোঁজ নিলাম ছোট ভাইয়ের বন্ধুর। তখন জানতে পারলাম আমার ছোট ভাইয়ের বন্ধু এবং তার বোন ভারত অবস্থান করছে। এই খবরটি দিল তার বাবা এবং তিনি ঐ অঞ্চলের পিচ কমিটির চেয়ারম্যান। তিনি বললেন আমার ছেলে-মেয়ে ভারতে শিকারপুরে আছে তোমরা যখন যাচ্ছ তখন ওদের সাথে দেখা করে বলো আমরা ভাল আছি। আমরা তাড়াহুড়া করে সেই বাড়ী থেকে বের হয়ে আসলাম। কারণ আর যাই হোক পিচ কমিটির চেয়ারম্যানের বাড়ীতে তো আর আশ্রয় নেওয়া যায় না।

সেখান থেকে রওয়ানা দিয়ে আমরা এসে থামলাম বর্ড়ার থেকে ০৩ (তিন) কিলোমিটার আগে তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। এর মধ্যে ক্ষিধেও পেয়েছে চরম চিন্তা করলাম কাছে যা চিড়া মুড়ি আছে তা ই খাব। একটু এগিয়ে গিয়ে দেখলাম আম বাগানের ভেতরে একজন হিন্দু মহিলাকে আর ৩/৪টা ছাপরা ঘর চিন্তুা করলাম এটা কি করে সম্ভব, এই সময়ে এরা এখানে। কাছে গিয়ে বললাম মা আমরা কিছু খাব আমাদের একটি খাবার পাত্র ও একটি পানি খাওয়ার পাত্র যদি দিতেন। তখনি মহিলা বললেন আমাদের পাত্রে কি আপনারা খাবেন বাবু? আমরা হচ্ছি আড়িয়া (সুয়োর চড়ায়) আমি বললাম কেন খাব না মা। যাইহোক উনি খুব পরিস্কার করে পানি খাওয়ার পাত্র ও খাওয়ার পাত্রের ব্যবস্থা করে দিলেন।

আমরা খাওয়া দাওয়া শেরে বর্ডারের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। বর্ডারের কাছে গিয়ে দেখি একটি পাকা রাস্তা আর গাছের উপরে মুক্তিযোদ্ধারা এ্যাম্বুস নিয়ে বসে আছে। কারণ ঐ রাস্তা দিয়ে সন্ধ্যা বেলা পাক আর্মিরা যাতায়াত করে। মুক্তিযোদ্ধারা আমাদের সিগনাল দিলে আমরা রাস্তা পার হলাম ও একটি নদী ও পার হলাম। কিছুদুর যেতেই অনেক মানুষের আওয়াজ শুনতে পেলাম তার মানে কাছেই ক্যাম্প। আমরা ক্যাম্পে পৌছালাম একটু জিড়িয়ে নিয়ে দেখলাম সেখানে খাওয়ার ব্যবস্থা মুশুরীর ডাল আর ভাত। অনেক ক্ষিদে ও লেগেছিল আমরা সেই মুশুরীর ডাল আর ভাত খেলাম যেন অমৃতের মত। তারপর আমার গন্তব্য কৃষ্ণনগর ক্যাম্প থেকে ৫০ কিলোমিটার দুরে।

সেখানে পৌঁছাতে গেলে এক এক জনের ভাড়া লাগবে ১৫ টাকা করে কিন্তু আমার কাছে আছেই মাত্র ২৭ টাকা। এর মধ্যে দুইটি ছেলে এসে ফরিদপুর রাজবাড়ীর লোক খুঁজছে। আমি তাদেরকে পরিচয় দিলাম আমি ফরিদপুর রাজবাড়ীর লোক। তারা বলল যে, আমরা খুঁজছি রাজবাড়ীর জৌকুরার কুন্ডু বাড়ীর লোকজনকে আমি বললাম যে, আমি কুন্ডু বাড়ীর ছেলে। সে আমাকে আমার বাবার নাম জিজ্ঞেস করলেন আমি বাবার নাম বলতেই চিনতে পারলেন। সর্ম্পকে ওরা আমার কাকাতো ভাই হয়। অনেক ছোট বেলাতে ভারত চলে গিয়েছিল বলে সেইভাবে মুখ চেনাচিনি হয়নি। আমার ঐ কাকাতো ভাইয়ের নাম অজিত। অজিত জিজ্ঞাসা করল তোরা এখন কোথায় যাবি? আর আমার বাবা মা’রা কোথায়? আমি থমকে গেলাম কিভাবে বলি জৌকুরা অপারেশনের সময় যে কয়জন মারা গিয়েছিল তার মধ্যে অজিতের বাবা-মা ছিলেন। আমি বললাম যে, আমি কৃষ্ণনগর যাব দিদি বাড়ী। আর তোর বাবা মা’রা আসছে পেছনে হয়তো অনেক দেরী হবে।

এর মধ্যে অজিত আমাকে বলল তোরা এখানেই দাড়া আমি তোদের যাওয়ার ব্যবস্থা করছি। কিছুৃ সময় পরে অজিত একটি বাস রিজার্ভ করে নিয়ে আসলো। তার মধ্যে রাজবাড়ী ফরিদপুরের লোকজন আর আমরা। আমি বললাম অজিত আমার কাছে তো অত টাকা নেই বাস ভাড়া দেওয়ার মত। অজিত বলল তোদের ভাড়া দিতে হবে না। এরমধ্যে আমি বাসে উঠে ঘুমিয়ে ও পড়েছিলাম। কখন যেন টের পেলাম আমার হাত ধরে কেউ একজন টানছে। ঘুম ভেঙ্গে দেখলাম রাজবাড়ীর এমপির ভায়রা এনায়েত মোল্লা সে আমাকে বলল, তোরা যাবি আর আমরা যাব না? আমি অজিতকে বললাম আমার দেশী লোক এদেরকে নিতে হবে। এনায়েত মোল্লারা ছিল ২৬ জন ,অজিত বলল ভেতরে জায়গা নেই ওনাদেরকে বাসের ছাদে উঠতে বল। আমরা সন্ধ্যা ৬.০০ টার দিকে কৃষ্ণনগর পৌঁছালাম। সেখান থেকে ট্রেনে করে চাকদা আমার দিদি বাড়ী, কিন্তু এতগুলি লোক একটা বাড়ীতে আমার নিজের কাছেই কেমন যেন লাগছে। কিন্তু আমার জামাই বাবু সবাইকে সাদরে গ্রহন করল এবং অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল তোরা বেঁচে আছিস? যাইহোক দিদির টানাটানির সংসার তারপর আমরা এতজন। জামাইবাবু আমাদের সবাইকে বলল তোরা ক্লান্ত স্নান সেরে খাওয়া দাওয়া করে ঘুম দে।

এর মধ্যে এনায়েত মোল্লা আমার জামাই বাবুকে জিজ্ঞাসা করল আমরা কোথায় যাব? আমার জামাই বাবু তাদেরকে বলল এত ব্যস্ত হওয়া কিছু নেই সকাল হলেই খোঁজ নেওয়া যাবে। তারপর সকালে খোঁজ নিয়ে জানা গেল শিয়ালদা ষ্টেশনের পাশে একটি হোটেলে বাংলাদেশের এমপিরা থাকেন। সকালে এনায়েত মোল্লা ও তার সঙ্গীরা সেই উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলেন। আমরা থেকে গেলাম ২ দিন পর আমি আর আমার দিদি সেই হোটেলের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।

আমার গন্তব্য ফণীভুষণ মজুমদার, কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখা পেলাম কাজী হেদায়েত হোসেনের সাথে। তিনি আমাদের দেখে খুব খুশি হলেন এবং আমার দিদির হাতে ৭০০ টাকা দিলেন। দিদি সেই টাকা নিতে চাইলেন না তখন কাজী সাহেব বললেন মা আমি এনায়েতের কাছে সবই শুনেছি তুমি এতগুলো লোককে আশ্রয় দিয়েছো তোমার ও তো সংসার আছে। এটা না হয় বাবা হিসেবেই তোমাকে দিলাম। আমিতো এসেছি ফণীভূষণ মজুমদারের সাথে দেখা করতে। তার সাথে কিভাবে দেখা করতে পারি? কাজী সাহেব বললেন ২ দিন পরে ১২ টার দিকে তিনি এখানে আসবেন তুমি ২দিন পরে আসো দেখা পাবে।
ঠিক ২দিন পর আমি সেই হোটেলে গেলাম এবং দেখা করলাম। তারপর জানতে পারলাম কাজী হেদায়েত সাহেব কল্যানিতে একটি ক্যাম্প পরিচালনা করছেন। আমি কাজী সাহেবকে বললাম আমিতো যুদ্ধে যাবার জন্যই ভারতে এসেছি। আমার ট্রেনিংয়ের ব্যাবস্থা করে দেন। তিনি আমাকে বললেন তোর যুদ্ধে যেতে হবে না। তুই যেখানে আছিস সেখানেই থাক। এই বলে আমার পকেটে ৫০০/- টাকা দিলেন। আর বললেন খরচের টাকা তো কাছে নেই এটা খরচ করিস। আমার মনটা তখন খুব খারাপ হয়ে গেল। আমি দিদি বাড়ী ফেরার জন্য রওয়ানা দিলাম। কল্যানী ষ্ট্রেশনে এসে দেখতে পেলাম রাজবাড়ীর শ্যামল ভট্টাচার্জকে (বিপ্লবী নেতা) তিনি আমাকে দেখে ডাকলেন। কারণ উনি আমার পূর্ব পরিচিত আমাদের রাজবাড়ীর বাড়ীতে যাতায়াত ছিল অনেকবার। আমি শ্যামল ভট্টাচার্জকে সব খুলে বললাম। শ্যামল ভট্ট্রাচার্জ আমাকে বললেন তুমি জানোনা আর জানবেই বা কিভাবে এটাতো একটা গোপন বিষয় ন্যাফ কমিউনিষ্ট পার্টির ছাত্র ইউনিয়নের কাউকেই কোন ট্রেনিং সেন্টারে ঢুকতে দিচ্ছেনা। তবে আশাহত হওয়ার কিছু নেই ৬/৭ দিনের মধ্যেই সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তুমি ৬/৭ দিন পরে এসে যোগাযোগ কর। ৬/৭ দিন পর গিয়ে দেখলাম ভারতীয় কমিউনিষ্ট পার্টির কাছ থেকে বাংলাদেশের ন্যাফ ছাত্রইউনিয়ন কমিউনিষ্ট পার্টি একটি ঘর ভাড়া নিয়েছে। ঐখানে ক্যাম্প পরিচালিত হবে। আমি খবর পেয়ে ক্যাম্পে চলে গেলাম এবং কাজে নিয়োজিত হলাম। আমার কাজ হল যে সব ছাত্রইউনিয়ন কর্মী অন্য ক্যাম্প থেকে যুদ্ধে যেতে পারছে না। তাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করা এবং কল্যানী ক্যাম্পে নিয়ে এসে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করা। সেই সাথে আমাদের আরেকটি রিক্রুটিং অফিস খোলা হল বোনগাতে। এভাবেই চলতে লাগল আমার কাজ। একমাস পরে খবর আসল বোনগাতে রিক্রুটিং ক্যাম্পে মিটিং হবে সেখানে মনি সিং উপস্থিত থাকবেন। যথারিতী আমি সেই মিটিংয়ে উপস্থিত হলাম। সেখানে গিয়ে দেখতে পেলাম রাজবাড়ীর আশু ভরতদাশকে। উনি এখানকার ক্যাম্প ইনচার্জ। উনিও আমার পূর্ব পরিচিত। আমি তাকে কাকা বলে ডাকতাম। আমি কাকাকে বললাম আমি বোনগাও ক্যাম্পে আসতে চাই। কারন সশস্ত্র ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধে যাব। তখন কাকা বললেন এখনি না তোকে কল্যানী ক্যাম্পে দরকার। তুই ১৫ দিন পরে বোনগাও ক্যাম্পে আসবি। আমি ১৫ দিন পরে বোনগাও ক্যাম্পে গেলাম আশু ভরতদাশ আমাকে জিজ্ঞাসা করল তোরা ঐ ক্যাম্পে কয়জন আছিস সবার বিষয়ে তিনি খোজ খবর নিলেন এবং আমাকে একটি ফরম দিলেন ফিলাপ করার জন্য। ফরম টা ফিলাপ করার পরে তিনি আমাকে বললেন আজ থেকে তুই আর বাড়ীতে যোগাযোগ করতে পারবি না। আমার মনটা খুব খারাপ হয়ে গেলো। তার পরেও চিন্তুা করলাম আগে বাংলা মা তারপর আমার পরিবার। সেইদিন থেকে আমার দায়িত্ব ছিল গোয়েন্দাদের মত। এভাবেই চলতে লাগলো আমার বনগাও ক্যাম্পের কাজ। লোক জোগাড় করা, ট্রেনিংয়ে পাঠানো ইত্যাদি। কিন্তু আমার ভাগ্যে আর ট্রেনিংয়ে যাওয়া হলনা। যত বারই ক্যাম্প প্রধানকে বলেছি শুধু একটা উত্তরই পেয়েছি সবাই ট্রেনিংয়ে গেলে কাজ পরিচালনা করবে কে? কি আর করার দলীয় নির্দেশ যেহেতু মানতেই হবে। আমরা বনগাও ক্যাম্প থেকে রাজবাড়ী অপারেশনে যেসব ছেলেদেরকে পাঠাতাম। মাছপাড়ার মেঘনা গ্রামে মালেক মিয়ার কাছে। তিনি ছিলেন রাজবাড়ী ছাত্র ইউনিয়নের সাংগঠনিক সম্পাদক। মালেক মিয়ার নেতৃত্বে যে কয়টি অপারেশন পরিচালিত হয়েছিল সব কয়টা অপারেশন ই সাকসেস অপারেশন ছিল। এভাবেই শেষ হল যুদ্ধ দেশ স্বাধীন হল কিন্তু আমরা মুক্তিযোদ্ধ হিসাবে আজও স্বীকৃতি পেলাম না। এই কয় দিন আগেই সরকার এবং দল থেকে আমাদের নাম চাওয়া হয়েছিল অনলাইনে নতুন করে মুক্তিযোদ্ধাদের নাম অর্ন্তুভুক্ত করার জন্য। আমার কোন দুঃখ নেই নিজের স্বীকৃতি নিয়েও মাথাব্যথা নেই। কারন সময়ের প্রয়োজন ছিল বাংলা মাকে রক্ষা করা ছেলে হিসেবে আমি আমার দায়িত্ব পালন করেছি। কেউ জানুক আর নাইবা জানুক বাংলা মা তো জানে তার সন্তানেরা তাকে কতখানি ভালবাসে !


অনুলিখন : সুমন কুমার নাগ

(এসসি/জুলাই ০৭, ২০১৫)