আরিফুন নেছা সুখী : সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলিসারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি... উঁঁ উঁঁ ...মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে উঁঁ উঁঁ... সুর তুলে পড়ছিলো অরণ্য।

মুখটা একটু বন্ধ হয়েছে কি হয়নি,ওমনি মা চেঁচালেন, 'কি রে, পড়ছিস না যে? জোরে জোরে পড়।''মনে মনে পড়তে বলেছে তো, তাই মনে মনে পড়ছি।' পড়ার রুম থেকে জবাব দিলো অরণ্য। 'দাঁড়া, আসছি। বাঁদর ছেলে কোথাকার! জোরে পড়!'

আবার জোরে পড়া শুরু করে অরণ্য- সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলিসারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি...উঁঁ উঁঁ...এর মধ্যে আবার তাগাদা দিলেন মা, 'স্কুলে যেতে হবে; তৈরি হয়ে নে।'মনে মনে গজ গজ করে অরণ্য বললো, 'ব্রাশ করো, নাস্তা করো, কতো যে ঝামেলা! আর ভালো লাগে না!' বলেই শুয়ে পড়লো। ওদিকে মা আবার ডাকলেন, 'কি রে, ঘুমালি নাকি?''চুলায় রান্না, উঠতেও পারছি না; মনে হয় ঘুমিয়ে গেলো। যাক, এখনো তো এক ঘণ্টা সময় আছে।' মনে মনে বললেন মা।

আর ওদিকে ঘুম রাজ্যে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে অরণ্য। ওহ কী মজা! স্কুল নেই, বই-খাতা নেই, ব্রাশ করার ঝামেলা নেই; শুধু খেলা আর ঘুরে বেড়ানো। ঘুরে বেড়ানো আর খাওয়া। খাওয়া আর ঘুম। ঘুম থেকে উঠতে গেলেই মা বলেন, কি রে, কোথায় যাস? ঘুমা!' ব্র্রাশ করতে চাইলে বলেন, 'আরে, রাখ তোর ব্রাশ করা! এতো ব্রাশ করলে দাঁতগুলো ক্ষয় হয়ে যাবে তো!'আর পড়তে বসতে চাইলে বলেন কি না, 'আরে ধুর! পড়ে কে বড় হলো!'অরণ্যের তো পুরো চক্ষু ছানাবড়া, না রসমালাই বড়া, না একে রাজভোগ বড়া বললেও কম বলা হবে। একেই বুঝি বলে ভূতের মুখে রাম নাম! মা কিনা বলছেন পড়তে বসতে হবে না! কিন্তু তার আর এই বোরিং সময় ভালো লাগছে না। হাতে পায়ে বাত ধরে যাওয়ার উপক্রম। উঠে একটু হাঁটবো মনে করছে, এমন সময় মা বললেন, 'আরে, কোথায় যাস? ঘুমা! কতোদিন ঘুমাসনি! আরে, ঘুমের উপর কোনো...!'

- বলেই মা ঘুমিয়ে পড়লেন। অরণ্য বললো, 'না বাবা! তুমি ঘুমাও। শোনোনি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন- আমি হবো সকাল বেলার পাখিসবার আগে কুসুম বাগেউঠবো আমি জাগি...''আরে, এতো জোরে পড়ছিস কেন? আস্তে, আস্তে, মনে মনে পড়। এই রে বৃষ্টি শুরু হলো! যা অরণ্য, বৃষ্টিতে ভিজে আয়। স্কিন ভালো থাকবে। তোর না ঘামাচি উঠেছে? যা বাবা, বৃষ্টিতে ভিজলে ঘামাচি ভালো হয়ে যাবে। কই রে, যাস না কেন?'

অরণ্য ভাবছে, মা কি পাগল হয়ে গেলো নাকি! কি সব উল্টা পাল্টা কথা বলছে। বাবাকে ডেকে আনা যাক। ওমা, সে কি! এতো দেখি আরেক কাণ্ড! অরণ্যের বাবা কিনা বৃষ্টিতে ভিজছেন! শুধু কি তাই? বাচ্চাদের মতো হাত পা ছুঁড়ছেন। অরণ্যকে দেখামাত্র হাত ধরে টেনে উঠানে নামিয়ে নিলেন। সে তো মাথা-মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছে না। কিন্তু বৃষ্টিতে ভিজতে তার খুব বিরক্ত লাগছে। অথচ সে বৃষ্টিতে ভিজতে খুব পছন্দ করে। আজ যে কি হচ্ছে, কিছুই বুঝতে পারছে না। সে উঠান থেকে ঘরে উঠে বাবাকে জোর করে ঘরে তুললো।

বাব্বা! তার কি রাগ! তিনি ঘরে উঠবেন না; আরও ভিজবেন! বাবার মাথা মুছিয়ে দিয়ে নিজের মাথা মুছলো অরণ্য। বাবা আবার ভিজতে যাওয়ার বায়না ধরেছেন। অরণ্য দরজা লাগিয়ে দিলো। ওদিকে মা ঘুমিয়েই যাচ্ছেন। অরণ্য গিয়ে ডাকতেই তিনি রাগ করে উঠলেন। বললেন, 'খেলতে যাও।'

অরণ্য বললো, 'স্যার যখন মারবে, তখন কি অবস্থা হবে? তুমি ঘুমাও বলে আমি আস্তে আস্তে পড়ছিলাম। কিন্তু এ কী অবস্থা, জোরে না পড়লে তো পড়া কিছুই বুঝতে পারছি না। জোরে জোরে পড়ে কি যে বাজে অভ্যেস হয়েছে! মুখস্ত যখন হচ্ছে না, একটু জোরে পড়ি।' সে কি একটু জোরে পড়েছে কি পড়েনি, অমনি মা এসে দুম করে পিঠে বসিয়ে দিলেন এক কিল...

কিল খেয়ে অরণ্য চমকে উঠলো। দেখলো, মা তার কান ধরে টানছেন। আর বলছেন, 'কি? স্কুলে যাওয়া লাগবে না? ওঠ, রেডি হয়ে নে। দেখি তোর বাবা কি করছে? 'অরণ্য বললো, 'বাবা তো বৃষ্টিতে ভিজছে।''বৃষ্টিতে ভিজছে মানে? বৃষ্টি কোথায় পেলি?' আড়মোড়া ভেঙে উঠে দাঁড়ালো অরণ্য। তারপর মাকে জড়িয়ে ধরে বললো, 'আহারে! জীবনটা যদি সত্যিই এমন হতো! তাহলে খুব বাজে হতো!'