সিলেট প্রতিনিধি : বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ১২ জনের একটি ব্রিটিশ পরিবারের ইসলামিক স্টেট (আইএস) নিয়ন্ত্রিত এলাকায় পালিয়ে যাওয়ার খবর নিশ্চিত হওয়ার পর থেকে বাংলাদেশে তাদের পৈত্রিক ভিটা সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও গ্রামে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বইছে। বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন ও মিডিয়া কর্মীরা তাদের বাড়িতে যাচ্ছেন। খোঁজার চেষ্টা করছেন বাংলাদেশে কারো সঙ্গে আইএস’র কোনো যোগসূত্র রয়েছে কি না।

ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও গ্রামে গিয়ে পোশাকধারী পুলিশ ছাড়াও সাদা পোশাকে একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার লোকজনের আনাগোনা দেখেছেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। গোয়েন্দারা আব্দুল মান্নানের ওই পরিবারের ঘনিষ্ঠ স্বজনদের বাড়িতে যাচ্ছেন এবং বারবার তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছেন। তারা কথা বলছেন প্রতিবেশীদের সঙ্গেও। এ অবস্থায় মাইজগাঁও গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছে উদ্বেগ ও আতঙ্ক। তবে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ১২ জনের ব্রিটিশ সদস্যের কেউই জঙ্গি কোনো সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নন। পরিবারের সাবাই প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের বর্তমান সদস্য নজরুল ইসলামের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আইএস-এ যোগদান করা পরিবারের সদস্যরা কেউই জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত নন।’ ওই পরিবারের সদস্যরা আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের রাজনীতের সঙ্গে জড়িত রয়েছেন বলেও জানিয়েছেন তিনি।

নিখোঁজ ১২ সদস্য সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘নিখোঁজ হওয়ার আগে তারা দেশে এসেছিল। তখন আমার সঙ্গে তাদের দেখা হয়েছে। তখন তাদের আচরণে মনে হয়নি তারা কোনো জঙ্গি সংগঠনে জড়িয়ে পড়েছে।’ তবে নারী সদস্যদের সঙ্গে তার দেখা হয়নি জানিয়ে নজরুল ইসলাম বলেন, ‘ইংল্যান্ড থেকে আসা পুরুষ সদস্যরা অন্য প্রবাসীদের মতোই চলাফেরা করেছেন। গ্রামের সাবার সঙ্গে কথা বলেছেন। এ সময় তাদের মধ্যে কোনো ধরনের জঙ্গি মনোভাব লক্ষ্য করা যায়নি।’

তিনি ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘ব্রিটিশ বাংলাদেশি সম্প্রদায়ের মধ্যে জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হওয়ার প্রবণতা দেখা দিলেও সে সমস্যা বাংলাদেশের নেই। এ প্রবণতা ব্রিটিশ সমাজের। কারণ যারা আইএস-এ যোগদান করেছে তারা বাঙালি হতে পারেন কিন্তু তারা বসবাস করেন যুক্তরাজ্যে। সেখানে বসবাস করা অবস্থায় তারা জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে জড়িত হয়েছেন। তাই ব্রিটেন সরকারকেই এর দায় নিতে হবে।’ নিখোঁজ ১২ সদস্য ও তাদের পরিবার সম্পর্কে জানতে যোগাযোগ করা হয় মাইজগাঁও ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নূরুল ইসলাম বাছিতের সঙ্গে। স্থানীয় ইউপি সদস্য নজরুল ইসলামের মতো তিনিও জানালেন, ফেঞ্চুগঞ্জে যারা বসবাস করে তারা সবাই প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। তবে যুক্তরাজ্যে বসবাসরতদের সম্পর্কে তিনি কিছু বলেতে পারেননি।

ব্রিটেনের লুটন শহরে বসবাসরত মান্নান অনেক বছর পর পরিবারের ১১ সদস্যকে নিয়ে সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জের মাইজগাঁও গ্রামের বেড়াতে এসেছিলেন। গত ১১ মে সিলেট ছাড়ার পর মাঝপথে তুরস্ক থেকে উধাও হয়ে যাওয়া পরিবারটিকে নিয়ে নানা গুঞ্জন চলছিল। এর মধ্যে ৪ জুলাই আইএস’র পাঠানো এক বিবৃতিতে জানানো হয়, পরিবারটি আইএস’র সঙ্গে রয়েছে।

তারা আইএস-এ যোগদানের আগে গ্রামের বাড়ি ঘুরে গেছেন। তাই তাদের গ্রামের বাড়ির আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে বিরাজ করছে উদ্বেগ ও আতঙ্ক। তবে তাদের স্বজন ও এলাকাবাসীর ধারণা, আইএস-এ যোগ দেয়ার পেছনে পরিবারের মেয়ে রাজিয়া খানমের কট্টর ধর্মান্ধতাই কাজ করেছে। হয়ত রাজিয়ার প্ররোচনায় অথবা যুক্তরাজ্য ফেরার পর পুলিশী হয়রানির ভয়ে তারা এ পথে পা বাড়িয়েছেন। রাজিয়া খানম নিষিদ্ধ ইসলামী গোষ্ঠী ‘আল-মোহাজিরুন’র সদস্য বলে মনে করা হয়।

তবে তা অস্বীকার করেছেন রাজিয়ার ভাই সালিম। সম্প্রতি যুক্তরাজ্যের সম্প্রচার মাধ্যম আইটিভিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে যুক্তরাজ্যবাসী বাংলাদেশি আব্দুল মান্নানের ছেলে সালিম হোসাইন দাবি করেছেন, যুক্তরাজ্যবাসী বাংলাদেশি আব্দুল মান্নান স্বেচ্ছায় সিরিয়ায় যাননি, আইএস জঙ্গিরা তুরস্ক থেকে তাকে সপরিবারে জোর করে তুলে নিয়ে গেছে। সাক্ষাৎকারে সালিম বলেছেন, তার ভাই-বোনদের কারও মধ্যে উগ্রপন্থি কোনো উপাদান বা জঙ্গি সংগঠনের সঙ্গে কোনো যোগাযোগ তার চোখে পড়েনি। পরিবারটি ‘সবচেয়ে নিরাপদে আছে’ এবং ‘তারা আইএস-এ যোগ দিয়েছে’ বলে জঙ্গি সংগঠনটি সম্প্রতি যে বিবৃতি দিয়ে তাও নাকচ করেছেন তিনি।

প্রসঙ্গত, লুটন শহরের ১২ সদস্যের যে পরিবারটি গত দেড়মাস ধরে নিখোঁজ রয়েছে তার সদস্যরা হলেন- সিলেটের ফেঞ্চুগঞ্জ উপজেলার মাইজগাঁওয়ের আব্দুল মান্নান (৮২), তার স্ত্রী মিনারা খাতুন (৫৩), তাদের মেয়ে রাজিয়া খানম (২১), সেইদা খানম (২৭) ও তার স্বামী আবুল কাশেম সাকের (৩১), আবদুল মান্নানের ছেলে মোহাম্মদ জাঈদ হোসেন (২৫), মোহাম্মদ তৌফিক হোসেন (১৯), মোহাম্মদ সালেহ হোসেন (২৬), তার স্ত্রী রোশনারা বেগম (২৪) এবং ওই পরিবারের তিন শিশু সন্তান।

গত ১১ মে তারা বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাজ্যের উদ্দেশ্যে ফেরার পথে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে দুইদিন যাত্রা বিরতির পর সেখান থেকে উধাও হয়ে যান। এরপর আইএস সংবাদ সংস্থা বিবিসিতে এক বার্তা পাঠিয়ে জানিয়েছে, পরিবারটি তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছে। আইএস-এ যোগ দেয়া আবদুল মান্নানের ভাই আবদুল লতিফ জানিয়েছেন, ‘নিখোঁজ’ পরিবারের সঙ্গে তার ছেলেও রয়েছেন। আবদুল মান্নানের মেয়ে সেইদা খানমকে বিয়ে করেন তার ছেলে আবুল কাশেম সাকের।

আবদুল লতিফ আরো জানান, তার ভাইয়ের পরিবারের নারী সদস্যরা কট্টর ধার্মিক। তার ভাতিজি রাজিয়া ঘরের ভেতরও নেকাব ও দস্তানা পরে থাকতো। তারা সবসময় ধর্মীয় উপদেশ দিতো। আবদুল লতিফ মনে করেন তার ভাইয়ের পরিবার আইএস-এ যোগ দিয়ে থাকলে এর পেছনে দুইটি কারণ থাকতে পারে। প্রথমত, যুক্তরাজ্যে ফেরার পর পুলিশ হেফাজতে নিয়ে রাজিয়াকে জিজ্ঞাসাবাদ, হিথ্রো বিমানবন্দরে কড়া তল্লাশি ও পরিবারের সদস্যদের হয়রানির ভয়। দ্বিতীয়ত, রাজিয়ার প্ররোচনা।

পরিবারের ১২ সদস্য ‘নিখোঁজ’র ঘটনায় তিনি ও পরিবারের সদস্যরা অজানা আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন বলে জানান আবদুল লতিফ। এদিকে, পরিবারের সদস্যরা আইএস-এ যোগ দেয়ার খবরে আবদুল মান্নানের গ্রামের বাড়ি মাইজগাঁওয়ে গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরাও ঘন ঘন যাতায়াত করছেন বাড়িটিতে। জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে পরিবারের সদস্যদের। এ নিয়ে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় দিন কাটাচ্ছেন পরিবারের সদস্যরা।

ফেঞ্চুগঞ্জ থানার ওসি নন্দন কান্তি ধর জানান, মাইজগাঁওয়ের একটি পরিবারের ১২ প্রবাসী আইএস-এ যোগ দেয়ার খবর পাওয়ার পর থেকে নজরদারি বৃদ্ধি করা হয়েছে।

(ওএস/পি/জুলাই ১১, ২০১৫)