স্পোর্টস ডেস্ক : ক্রিকেটে বাংলাদেশ হাঁটতে শিখছে। হাঁটতে শিখেছে না বলে অবশ্য এখন বলা যায়, দৌড়াতে শিখছে। এই দৌড়ের মধ্যেই খানিক ‘হোচটে’ বা খানিক ‘চোটে’ সমালোচনার তীরে বিদ্ধ হতে হয় বাংলাদেশকে; ‘পারছে না’ বলে। পিছিয়ে দেওয়ার ছকও কষা হয়, ‘পারছে না’ বলে।

সফল বিশ্বকাপ মিশন, পাকিস্তানকে বাংলাওয়াশ এবং ভারতের সঙ্গে সিরিজ জয়ের পরও দক্ষিণ আফ্রিকার সঙ্গে লড়াইয়ের শুরুর দিকে এ সমালোচনার বাতাস বইতে থাকে। প্রথম দু’টি টি-টোয়েন্টির পর প্রথম ওয়ানডে ম্যাচেও হারের পর মুখ খোলে বসেন সমালোচকরা, মুখে তাদের ফুটতে থাকে ‘দু তিনটে ম্যাচ জিতলেই বড় দল হওয়া যায় না, এই হলো স্বরূপ!’

রোববার (১২ জুলাই) রাত সাড়ে ৯টার আগেই সেই সমালোচকদের মুখ বন্ধ হয়ে গেল। ‘ছোট’দের ‘বড়’ হওয়া দেখে যারা হিংসায় জ্বলে বলতে থাকেন ‘কিছু একটা ঘটানো হয়েছে’; লেজ গুটিয়ে ফেললেন তারাও। মিরপুর শেরেবাংলা জাতীয় ক্রিকেট স্টেডিয়ামে টাইগার ক্রিকেটারদের গর্জন সমালোচকদের মুখ ভোঁতা করে দিয়েছে, লেজ গোটাতে বাধ্য করেছে ‘হিংসুক’ ‘বড় ভাই’দের।

দিবারাত্রির এ ম্যাচ যেমন টাইগারদের ঘুরে দাঁড়ানোর সাক্ষী হয়ে রইলো, তেমনি বাংলাদেশ দলকে ফেরালো সব ফরম্যাটের প্রধান সারির দল দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজেও। তিন ম্যাচ ওয়ানডে সিরিজের এ দ্বিতীয় ম্যাচে সাত উইকেটের বিশাল জয় নিয়ে বাংলাদেশ কেবল ১-১ সমতায়ই ফিরলো না, ফিরলো আরেকটি ক্রিকেট পরাশক্তিকে সিরিজে ধরাশায়ী করার দৌড়েও।

রোববার টাইগারদের সিরিজে ফেরার ম্যাচে টসে জিতে প্রথমে ব্যাট করতে নামে দক্ষিণ আফ্রিকা। বড় জয়ের লক্ষ্যে প্রথমে ব্যাট করতে নামলেও টাইগারদের অসাধারণ বোলিংয়ে মাত্র ১৬২ রানেই অলআউট হয়ে যায় প্রোটিয়ারা। চার ওভার বাকি থাকতেই গুটিয়ে যায় হাশিম আমলা, ডি কক, জেপি ডুমিনি, ডেভিড মিলার, রিলে রুশো আর ফাফ ডু প্লেসিসদের মতো তারকানির্ভর ব্যাটিং লাইনআপ।

ম্যাচের শুরু থেকেই প্রোটিয়া ব্যাটসম্যানদের চেপে ধরে টাইগাররা। নিয়মিত বিরতিতে উইকেট খোয়াতে থাকে সফরকারীরা। টাইগারদের হয়ে মুস্তাফিজুর রহমান ও নাসির হোসেন তিনটি করে উইকেট তুলে নেন। দু’টি উইকেট পান রুবেল হোসেন আর একটি করে উইকেট দখল করেন মাশরাফি ও মাহমুদুল্লাহ।

কার্টার স্পেশালিস্ট মুস্তাফিজুর রহমানের বাউন্সে দলীয় পঞ্চম ওভারের প্রথম বলেই ফেরেন দক্ষিণ আফ্রিকান ওপেনার কুইন্টন ডি কক। বাঁহাতি এ ওপেনার সাব্বির রহমানের তালুবন্দি হয়ে আউট হওয়ার আগে মাত্র দুই রান করেন। এর আগে ইনিংসের দ্বিতীয় ওভারে মাশরাফির করা একটি বলে স্লিপে ক্যাচ দিয়েও বেঁচে যান হাশিম আমলা।

দলীয় ১৬ রানের মাথায় ডি কককে বিদায় করে সফরকারীদের কিছুটা চাপের মধ্যেই রাখে টাইগার বোলাররা। উইকেটে থেকে জুটি গড়ার চেষ্টা করেন ফাফ ডু প্লেসিস এবং হাশিম আমলা। তবে, ইনিংসের ১৩তম ওভারের প্রথম বলেই রুবেল স্ট্যাম্প উড়িয়ে দেন আমলার। এ জুটি থেকে আসে ২৯ রান। আমলা আউট হওয়ার আগে করেন ৩৭ বলে ২২ রান।

দলীয় ৪৫ রানের মাথায় দুই ওপেনারকে ফিরিয়ে দেন মুস্তাফিজ এবং রুবেল হোসেন। দলের রানের চাকা সচল রাখার চেষ্টা করেন ডু প্লেসিস এবং রিলে রুশো। তবে, ইনিংসের ১৯তম ওভারে নাসির আক্রমণে এসে প্রথম বলেই রিলে রুশোকে বোল্ড করেন। আউট হওয়ার আগে ২৪ বল মোকাবেলা করে রুশো করেন মাত্র ৪ রান।

টপঅর্ডারের তিন ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে প্রোটিয়াদের এগিয়ে নিতে থাকেন প্লেসিস-মিলার। ইনিংসের ২৪তম ওভারে শর্টফাইন লেগে দাঁড়ানো মাশরাফির দারুণ এক ক্যাচে সাজঘরের পথ ধরতে বাধ্য হন মিলার। মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের বলে আউট হওয়ার আগে মিলার করেন ২৪ বলে মাত্র ৯ রান।

আগের ওভারে ডেভিড মিলারকে ফিরিয়ে দেওয়া মাহমুদুল্লাহ নিজের পরের ওভারে দারুণ এক ঘূর্ণিতে কাবু করেন টাইগারদের গলার কাঁটা হয়ে উঠা প্লেসিসকে। আম্পায়ার আউট না দেওয়ায় রিভিউ নেন টাইগার দলপতি। তাতে ব্যর্থ হতে হয় টাইগার বাহিনীকে। টপঅর্ডারের চার ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে এগুতে থাকে প্রোটিয়ারা। তবে, সফরকারীদের বেশ ভালোই চেপে ধরে টাইগার বোলাররা। ইনিংসের ২৯তম ওভারে ক্রমেই টাইগারদের গলার কাঁটা হয়ে থাকা ডু প্লেসিসকে ফিরিয়ে দেন নাসির হোসেন। সৌম্যর তালুবন্দি হয়ে প্লেসিস আউট হওয়ার আগে করেন ৪১ রান।

ফেভারিট হয়েই দ্বিতীয় ওয়ানডেতে সিরিজ নিশ্চিত করতে চাওয়া দ. আফ্রিকার দলীয় শতক হওয়ার আগেই টপঅর্ডারের পাঁচ ব্যাটসম্যান সাজঘরে ফেরেন। দলীয় শতক করতে ৩২ ওভার লাগে প্রোটিয়াদের। দলীয় ১০০ রানের মাথায় মুস্তাফিজের বলে শর্টকাভারে সাব্বিরের তালুবন্দি হয়ে ফেরেন ডুমিনি। আউট হওয়ার আগে তার ব্যাট থেকে আসে ১৩ রান। এটি ছিল মুস্তাফিজের দ্বিতীয় শিকার।

রুবেল হোসেনের দারুণ এ ডেলিভারিতে এলবি’র ফাঁদে পড়ে বিদায় নেন ক্রিস মরিস। সাত ব্যাটসম্যানকে হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়ে সফরকারীদের ব্যাটিং লাইনআপ। মাত্র ১১৬ রানের মাথায় নাসির, মুস্তাফিজ, মাহমুদুল্লাহ, রুবেল ফিরিয়ে দেন প্রোটিয়াদের সাত ব্যাটসম্যানকে।

৪১তম ওভারের শেষ বলে রাবাদাকে বোল্ড করে আবারো টাইগার ভক্তদের মাতিয়ে তোলেন মুস্তাফিজ। এটি ছিল বাঁহাতি বোলারের তৃতীয় শিকার। রাবাদার বিদায়ের পর দলীয় ৪৫তম ওভারে নাসির হোসেনের তৃতীয় শিকারে সাজঘরের পথ ধরেন কাইল অ্যাবোট। টাইগার অলরাউন্ডারের দারুণ এক ঘূর্ণিতে কাবু হয়ে এলবির ফাঁদে পড়েন অ্যাবোট। আর মাশরাফির বলে নাসির হোসেনের তালুবন্দি হয়ে শেষ ব্যাটসম্যান হিসেবে ফেরেন ৩৬ রান করা বেহারদিয়েন। তার বিদায়ের মধ্য দিয়ে ১৬২ রানে গুটিয়ে যায় প্রোটিয়া বাহিনী।

ফলে টাইগারদের সামনে জয়ের টার্গেট দাঁড়ায় ১৬৩। সহজ এই লক্ষ্যে ব্যাটিংয়ে নেমে মাত্র তিন উইকেট হারিয়েই জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় স্বাগতিকরা। টাইগাররা ২৭.৪ ওভার খেলেই এ জয় তুলে নেয়।

খেলায় ওয়ানডে ক্যারিয়ারের তৃতীয় অর্ধশতক হাঁকিয়ে অপরাজিত থাকেন সৌম্য সরকার। দলীয় ২৪ রানের মাথায় তামিম-লিটনের বিদায়ের পর তিনি জুটি গড়ে তুলেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদের সঙ্গে। এ জুটি থেকে আসে ১৩৫ রান। যে জুটি আবার প্রোটিয়াদের বিপক্ষে টাইগারদের যেকোনো উইকেটে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড গড়ে।

অভিষেকের পর থেকেই দুর্দান্ত খেলে চলা সৌম্য ৭৯ বলে ৮৮* রান করেন। তার ইনিংসে ছিল ১৩টি চার আর একটি ছক্কা। আর বিশ্বকাপের চমক জাগানিয়া ব্যাটসম্যান রিয়াদ তার ওয়ানডে ক্যারিয়ারের ১৩তম অর্ধশতক হাঁকিয়ে ৬৩ বলে ৫০ রান করে শেষ মুহূর্তে বিদায় নেন।

সিরিজে সমতা আনার লক্ষ্যে টাইগারদের হয়ে টার্গেট তাড়া করতে ওপেনিংয়ে নামেন তামিম ইকবাল এবং সৌম্য সরকার। তবে, এ ম্যাচেও ব্যর্থতার পরিচয় দেন অভিজ্ঞ ওপেনার তামিম ইকবাল। দলীয় ইনিংসের দ্বিতীয় আর রাবাদার প্রথম বলেই বোল্ড হয়ে ফেরেন ৫ রান করা তামিম।

তামিম ইকবাল ফিরে গেলেও সৌম্য সরকার আর লিটন দাস মিলে টাইগারদের রানের চাকা ঘোরাতে থাকেন। তবে, অভিষেক ম্যাচে ৬ উইকেট নেওয়া রাবাদার দ্বিতীয় শিকারে বিদায় নেন লিটন দাস। চতুর্থ ওভারে বোল্ড হয়ে ফেরার আগে তার ব্যাট থেকে আসে ১৭ রান। লিটন তার ইনিংসটি ১৪ বলে দু’টি চার আর একটি ছয়ে সাজান।

শক্তিশালী ব্যাটিং লাইনআপের প্রোটিয়ারা যেখানে দলীয় ৩২ ওভারে দলের শতক তুলে নিয়েছিল, সেখানে টাইগাররা মাত্র ১৬.৩ ওভার খেলেই দলীয় শতক তুলে নেয়। প্রোটিয়াদের কোনো ব্যাটসম্যান ইনিংসে অর্ধশতক না পেলেও টাইগারদের পক্ষে দু’জন ব্যাটসম্যান অর্ধশতক তুলে নেন।

গ্যালারি কিংবা টিভি সেটের সামনে বসে আটবছরের অপেক্ষার অবসান দেখা টাইগার ক্রিকেটপ্রেমীরা এখন নিশ্চয় স্বপ্ন দেখতে থাকবেন- ‘সাফল্যের এ গল্পটা ধারাবাহিক থাকুক চট্টগ্রামে তৃতীয় ওয়ানডে ম্যাচেও, চিরতরে ভোঁতা হয়ে যাক সমালোচক-নিন্দুকদের মুখ’।

(ওএস/অ/জুলাই ১২, ২০১৫)