ধামরাই (ঢাকা) প্রতিনিধি : শনিবার (১৮ জুলাই) উৎসবমুখর পরিবেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব রথযাত্রা শুরু হবে। সারাদেশেই পালিত হবে রথ-উৎসব। এই উৎসবে মিলিত হবেন ধর্মপ্রাণ হিন্দুধর্মাবলম্বীরা।

রথযাত্রার কথা উঠলেই ঢাকার ধামরাইয়ের ঐতিহ্যবাহী শ্রীশ্রী যশোমাধবের রথযাত্রার কথাই উঠবে। ধামরাই রথযাত্রার ইতিহাস বেশ প্রাচীন। ৪০০ বছর ধরে ধামরাইয়ে এই রথযাত্রা উৎসব পালিত হয়ে আসছে। এটি দেশের অন্যতম প্রাচীন রথযাত্রা।

এই রথ উৎসব শুরু হয়েছিল ১০৭৯ বঙ্গাব্দে। এই রথের সুনামও আছে। বাংলাদেশে এতো বড় রথযাত্রা ও রথ উৎসব এবং মেলা অন্য স্থানে হয় বলে জানা যায় না। গ্রামবাংলার মানুষের হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া এ রথযাত্রা উৎসব মূলত হিন্দু ধর্মীয় চেতনার ওপর প্রতিষ্ঠিত হলেও এ উৎসবের স্রোতধারা নির্দিষ্ট গন্ডিতে সীমাবদ্ধ থাকে না। দেশ-বিদেশ থেকে হিন্দু-মুসলমানসহ বিভিন্ন ধর্মের হাজার হাজার দর্শক ধামরাইয়ে এ রথযাত্রার উৎসবে সমবেত হয়।

প্রতি বছরের আষাঢ় মাসের শুক্লপক্ষের দ্বিতীয়া তিথিতে এ রথযাত্রা শুরু হয়। ধামরাইয়ের কায়েতপাড়ায় যশোমাধবের মূল মন্দির রয়েছে। যশোমাধব বিগ্রহসহ ওই দিন শ্বশুরবাড়ি যাবেন ধামরাইয়ের যাত্রাবাড়ী মন্দিরে। এখানে তিনি ৯ দিন থাকবেন। তারপর ২৬ জুলাই আবার রথে উঠে যাবেন কায়েতপাড়ার যশোমাধবের মন্দিরে। এই রথযাত্রাকে বলা হয় উল্টো রথযাত্রা।

রথযাত্রা উপলক্ষে ২৬ দিন চলবে রথমেলা। পবিত্র ঈদ এবং রথ উৎসবকে ঘিরে এখন ধামরাইয়ে সাজসাজ রব। এ উৎসবকে কেন্দ্র করে মেলায় আসতে শুরু করেছে সার্কাস, নাগরদোলা, তৈরী পোষাক থ্রি-পিসের দোকান, ফার্নিচার, শিশুদের জন্য খেলনাসহ বিভিন্ন ধরনের দৃষ্টিনন্দন ও আকর্ষনীয় দোকানপাট।

এ বছর মুসলমান ও হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বছরের দু'টি উৎসব একই সময়ে উদযাপিত হবে বলে এ উৎসবকে কেন্দ্র করে স্থানীয় প্রশাসন সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। আগত অতিথি ও দর্শকদের জন্য নেওয়া হয়েছে পর্যাপ্ত নিরাপত্তার ব্যবস্থা। মেলাঙ্গনে সাদা পোশাকে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার সদস্যরা (র‌্যাব, ডিজিএফআই, এনএসআই, ডিএসবি) দায়িত্ব পালন করবে। এ উৎসব নির্বিঘ্নে পালন করতে পৌরশহর নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে দেওয়া হবে বলে জানিয়েছেন ঢাকা জেলার পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান।

প্রধান অতিথি হিসেবে রথযাত্রার উদ্বোধন করবেন যুব ও ক্রীড়া প্রতিমন্ত্রী শ্রী বীরেন শিকদার। যশোমাধব মন্দির ও মেলা পরিচালনা কমিটির সভাপতি মেজর জেনারেল (অবঃ) জীবন কানাই দাসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে থাকবেন স্থানীয় সংসদ সদস্য এম এ মালেক, ইন্ডিয়ান হাই কমিশনার জনাব পঙ্কজ শরন, জেলা প্রশাসক মোফাজ্জল হোসেন মিয়া, পুলিশ সুপার হাবিবুর রহমান প্রমুখ।

রথের ইতিহাস ও ঐতিহ্য : ১৩১৯ বঙ্গাব্দে কলকাতা থেকে প্রকাশিত যতীন্দ্র মোহন রায়ের লেখা “ঢাকার ইতিহাস” নামক বইয়ের ২২৩ ও ২২৫ নং পৃষ্ঠায় বর্ণিত তথ্যাবলীর আলোকে জানা যায়, পাল বংশের শেষ রাজা যশো পাল একবার হাতিতে আরোহণ করে বেড়াতে যাচ্ছিলেন। চলতে চলতে ধামরাইয়ের অনতিদূরে শিমুলিয়ার গাজীবাড়ির রণস্থানে গিয়ে হাতিটি একটি মাটির ঢিবির সামনে গিয়ে আর এগোয় না। তখন রাজা হাতিতে অবস্থান করেই তার সঙ্গের লোকদের মাধ্যমে ওই মাটির ঢিবিতে খননকাজ শুরু করেন। সেখানে পাওয়া যায় পুরনো এক মন্দির। তাতে বিষ্ণু মূর্তির মতো শ্রীমাধব মূর্তিও ছিল।

ওই সময় যশোমাধবের সংবাদে লিখিত আছে-
“মাটিকাটি শ্রীমন্দির বাহির করিল।
কপাট ভিতরে আটা খুলিতে নারিল ॥
অতপর মহারাজা ব্যাকুল হইয়া।
তিনদিন অনাহারে রৈল হত্যাদিয়া ॥”
ভক্তিদেখি ভগবান নারিল থাকিতে।
দৈববাণী আসি তারে কৈল অলক্ষিতে ॥
তোর বংশ থাকিবেনা তুলিলে আমারে।
তমোপূর্ণ পৃথিবী দেখিয়া আমি ডরে।
লুকাইয়া আছি হেথা মৃত্তিকা ভিতরে”॥

রাজা ভক্তি করে সেটা নিয়ে আসেন। ধামরাই সদরের পঞ্চাশ গ্রামের বিশিষ্ট পন্ডিত শ্রীরাম জীবন রায়কে মূর্তিটি প্রতিষ্ঠার ভার দেন। মহাসমারোহে সেখানে প্রতিষ্ঠিত হলো ভগবান শ্রীমাধবের মূর্তি। ভগবানের সঙ্গে ভক্ত যশো পালের নামের ‘যশো’ অংশটি মিলিয়ে বিগ্রহের নতুন নামকরণ করা হয় শ্রীশ্রী যশোমাধব। এভাবেই অমর হয়ে আছেন রাজা যশো পাল। পরবর্তীকালে শ্রীমাধবকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে ধামরাইয়ের শ্রী শ্রী যশোমাধব রথ উৎসব ও মেলা। এই রথ উৎসব শুরু হয়েছিল ১০৭৯ বঙ্গাব্দে।

৪৪ বছর পূর্বে ধামরাইয়ের রথযাত্রা ও রথমেলার এমন একটি রূপ ছিল যা ভারতের মহেশুর বা অন্যকোন মেলায় খুঁজে পাওয়া যায়নি। প্রায় ৪০০ বছর পূর্বে তৈরী করা হয়েছিল এই প্রথম রথ।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যশোমাধবের বিগ্রহসহ মন্দিরটি পাকিস্তানী সেনাবাহিনী ও দেশীয় রাজাকার আলবদররা পুড়িয়ে দেয়। বন্ধ হয়ে যায় রথ উৎসব। ১৯৭২ সালে কায়েতপাড়ার মাখন সূত্রধরের মেয়ের জামাই ঢাকার শাখারী বাজারের স্বর্ণশিল্পী মাখন সূত্রধরের আর্থিক সহায়তায় বাঁশ ও আম কাঠ দিয়ে ছোট আকারে একটি রথ তৈরী করা হয়। ওই রথ দিয়েই ১৯৭২ সনেও পালন করা হয় রথ উৎসব।

২০০৬ সালে রথ উৎসবের দিন তৎকালীন ভারতীয় হাইকমিশনার বীণা সিক্রি ভারত সরকারের পক্ষ থেকে রথটি নির্মাণের ঘোষণা দেন। ধামরাইয়ে যে রথটি টানা হবে সেটি ২০১০ সালে তৈরী। ভারত সরকারের অর্থায়নে পরবর্তীতে রথটি নির্মাণের কাজ পান ইউসিস ক্যালভিন টেকনোটাচ কোম্পানি। এতে ব্যয় হয় ৮৭ লাখ টাকা।

এটি প্রায় আদি রথের আদলে তৈরী করা হয়েছে। ৪১ ফুট উচ্চতা সম্পন্ন নতুন এ রথে প্রথমে লোহার পাত দিয়ে তৈরী ৩৭ ফুট দৈর্ঘ্য, ২০ ফুট প্রস্থ ও ৩ তলা বিশিষ্ট অবকাঠামো তৈরী করা হয়েছে। এরপর সেগুন কাঠের পাতলা স্তর বসিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়েছে লোহার পাত। কাঠের উপর করা হয়েছে দৃষ্টিনন্দন কারুকাজ ও দেব-দেবীর মূর্তির চিহ্ন। এটি চলবে ১৫টি চাকায় ভর করে। সামনে কাঠের তৈরী ২টি তেজস্বী ঘোড়া।

তাই পল্লী কবি জসিম উদ্দিন তাঁর ‘ধামরাই রথ’ কবিতায় লিখেছেন-
‘কোন জাদুকর গড়েছিল রথ তুচ্ছ কি কাঠ নিয়া
কি মায়া তাহাতে মেখে দিয়েছিল নিজ হৃদি নিঙারিয়া।
তাহারি মায়ায় বছর বছর কোটিকোটি লোক আসি
রথের সামনে দোলায়ে যাইত প্রীতির প্রদীপ হাসি।’

(এএইচ/পিএস/জুলাই ১৫, ২০১৫)