কিশোরগঞ্জ প্রতিনিধি : এবারও উপমহাদেশের বৃহত্তম ঈদের জামাত কিশোরগঞ্জের ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সারারাতের বৃষ্টি আর সকালের হালকা হালকা মেঘের হাতছানি থাকা স্বত্বেও মাঠের বিভিন্ন প্রবেশ দ্বার দিয়ে লাখো লাখো মুসুল্লি নামাজ আদায় করেন।

লাগাতার তিনদিনের প্রচন্ড বৃষ্টিতে কর্দমাক্ত মাঠকে উপেক্ষা করেও এবারের ১৮৮ তম ঈদ জামাতে প্রায় তিন লক্ষাধিক মুসুল্লী একসঙ্গে নামাজ আদায় করেছেন বলে জানিয়েছেন, ঈদগাহ কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক জি.এস.এম জাফর উল্লাহ।

উপমহাদেশের বৃহত্তম শোলাকিয়া মাঠে ঈদের জামাতে ইমামতি করেন ইসলাহুল মুসলিমিন পরিষদের চেয়ারম্যান ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম এর মহাসচিব মাওলানা মোঃ ফরিদ উদ্দিন মাসউদ। নামাজ শেষে বঙ্গবন্ধু তাঁর পরিবারের, ১৫ আগস্ট নিহতদের আত্মার মাগফেরাত, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা ও মুসলিম উম্মাহর শান্তিু ও সমৃদ্ধি কামনা করে দোয়া ও মোনাজাত করা হয়।

এছাড়াও স্বাধীনতার বিরোধী ও যারা মানুষ পোড়ার রাজনীতি করে তাদেরকে যেন আল্লাহর দরবারে বিচার করা হয়। এছাড়াও বর্তমানে এ সরকারের কার্যপ্রণালীকে উমর শাসন এর সাথে তুলনা করা হয়েছে।

সকাল ১০টায় ঈদের জামাত শুরু হলেও সকাল ৯টার মধ্যে বিশাল ঈদগাহ ময়দানে মুসুল্লিদের সমাগম ঘটে। মুসল্লিরা দলে দলে ঈদগাহে আসার সময় লাব্বায়িক আল্লাহুমা লাব্বায়িক ধবনিতে চারদিক মুখরিত করে তোলেন। এ মাঠের রেওয়াজ অনুযায়ী জামাত শুরুর ৫ মিনিট, ৩ মিনিট ও ১ মিনিট আগে নামাজের প্রস্তুতি হিসেবে শটগানের গুলি ছোড়া হয়।

নির্ধারিত সময়ের আগেই মাঠ ও তার পার্শ্ববর্তী রাস্তা, ফুটপাত, বাড়ি ঘরের আঙ্গিনায় মুসুল্লীরা জামাতে শরীক হন। অনেক মুসুল্লী ঈদের দিন ভোর বেলায় ট্রেন, বাসসহ বিভিন্ন যানবাহনে ঈদগাহে আসেন। মুসুল্লীদের সুবিধার্থে শোলাকিয়া স্পেশাল দু’টি ট্রেন ময়মনসিংহ, ভৈরব থেকে কিশোরগঞ্জ এর উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে।

এবারের ঈদের জামাতে দেশ ছাড়াও বিদেশী নাগরিকদের উপস্থিতিও লক্ষ্য করা যায়। লন্ডন এর স্থায়ী বাসিন্দা মোঃ শাখের (৫০) বলেন, এত বড় ঈদ জামাতের মাঠে নামাজ আদায় করতে পেরে আমি খুব সৌভাগ্যবান।

এছাড়া বৃহত্তর ময়মনসিংহের জামালপুর, শেরপুর, নেত্রকোনা, টাঙ্গাইল জেলা ছাড়াও ঢাকা, গাজীপুর, মাদারীপুর, মুন্সিগঞ্জ, বগুড়া, রাজশাহী, সিলেট, হবিগঞ্জ, চট্টগ্রামসহ দেশের দূর-দূরান্ত থেকে ছুটে আসেন মুসুল্লিরা এ মাঠে নামাজ আদায় করতে।

জামালপুর জেলার এক দিনমজুর ফজর আলী (৪২) জীবনের প্রথম এ ঈদগাহে নামাজ পড়তে আসেন, তার জীবনের শেষ ইচ্ছা তিনি আজ পুরণ করতে পেরেছেন। সিলেট বিভাগের জেলার সুনামগঞ্জ থেকে আসা ইবনে-বিন-হায়দার (৬০) বলেন, লক্ষ লক্ষ মানুষের ভীড়ে নামাজ আদায় করা সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। এ ধরণের অসংখ্য লোকের সন্ধান মিলে যারা তাদের মনের আশা পূরণ করেছেন এ মাঠে নামাজ পড়তে আসেন।

এছাড়া এ মাঠে জেলা পরিষদ প্রশাসক মোঃ জিল্লুর রহমান, পাবলিব প্রসিকিউটর শাহ্ আজিজুল হকসহ প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, ইলেকট্রনিক্স, অনলাইন পোর্টাল ও প্রিন্ট মিডিয়ার সাংবাদিক, এলাকার বিশিষ্ট ব্যক্তি ও অসংখ্য সাধারণ মুসুল্লী এ জামাতে অংশগ্রহনের মাধ্যমে নামাজ আদায় করেন।

অন্যদিকে কিশোরগঞ্জ এস.ভি সরকারী বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ে পৃথকভাবে মহিলাদের জন্য একটি জামাত অনুষ্ঠিত হয় । এতে ইমামতি করেন মাওলানা মোহাম্মদ ছানাউল্লাহ।
ঈদু উল ফিতর উপলক্ষে শোলাকিয়া ঈদগাহ ময়দানসহ কিশোরগঞ্জ শহরকে বিশেষ সাঁজে সজ্জিত করা হয়। রাস্তার দু’পাশে টানানো হয় রং বেরংয়ের পতাকা, কালেমা লিখা ব্যানার ও নানা রংয়ের আলোকসজ্জা।

এছাড়াও ঈদুল ফিতরের বিশেষ আকর্ষন ছিল শোলাকিয়া ময়দানের সামনে অনুষ্ঠিত ঈদ মেলা। মেলায় উঠা বিশেষ ধরণের সুন্নতি লাঠি সবার দৃষ্টি আকর্ষন করে। প্রিয় নবী হযরত মোহামম্দ (স) এর সুন্নত পালনের উদ্দেশ্যে হাজার হাজার মুসুল্লী এ লাঠি কিনে কিনে বাড়ী ফিরেছেন।
জামাত আগত দূর দূরান্ত থেকে আসা মুসুল্লীদের তৃষ্ণা লাঘব করতে দল মত নির্বিশেষে স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী ও এলাকাবাসী মুসুল্লীদের মাঝে বিশুদ্ধ খাবার পানি, শরবত, খুরমা ও মিষ্টি দ্রব্য বিতরণ করেছেন।

সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ জামাত অনুষ্ঠানের জন্য পুলিশ প্রশাসনের পক্ষ থেকে নেয়া হয় নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা। নিরাপত্তায় ঈদগাহ মাঠ ও আশ-পাশে দায়িত্ব পালন করে সহস্রাধিক পুলিশসহ র‌্যাব ও আর্মড পুলিশ ব্যাটেলিয়নসহ অন্যান্য বাহিনী। মাঠের ২৮টি প্রবেশ মুখে মেটাল ডিটেক্টর দিয়ে মুসুল্লীদের তল্লাশী করা হয় এবং ওয়াচ টাওয়ার ও ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরার সাহায্যে পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করা হয়। এছাড়াও বয়েজ স্কাউট, স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের দেখা গেছে তৎপর। মেডিকেল টিম ও ফায়ার বিগ্রেডের উপস্থিতিও ছিল লক্ষনীয়।

প্রায় তিনশ বছরের পুরোনো ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহটি ঐতিহ্যের তুলনায় উন্নয়ন ও সংস্কারের ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে আছে। শোলাকিয়া ঈদগাহকে শোলাকিয়া আন্তর্জাতিক ঈদগাহ নামকরণ ও মুসুল¬ীদের সুবিধার্থে মাঠের পরিসর বৃদ্ধি এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নের দাবী দীর্ঘদিনের। এছাড়াও বৃষ্টিতে এ মাঠে যেন ভবিষ্যতে সুষ্ঠুভাবে নামাজ আদায় করা যায় সে বিষয়টির প্রতিও সরকার এবং মাঠ কর্তৃপক্ষের নিকট দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

সংক্ষিপ্ত ইতিহাস : শোলাকিয়া কিশোরগঞ্জ জেলা শহরের একটি বৃহৎ ও পুরোনো এলাকা। বর্তমান শোলাকিয়া কিশোরগঞ্জ শহরের পূর্ব উত্তর কোনে নরসুন্দা নদীর অববাহিকায় শোলাকিয়া নামের এলাকাটির অবস্থান। জনশ্র“তি আছে যে, শোলাকিয়া ঈদগাহের প্রথম বড় জামাতে সোয়ালাখ মুসুল্লী অংশগ্রহন করেছিলেন। অন্য মতে মুঘল আমলে এখানে অবস্থিত পরগনার রাজস্বের পরিমান ছিল সোয়ালাখ টাকা। উচ্চারণের বিবর্তনে সোয়ালাখিয়া থেকে বর্তমান শোলাকিয়া নামে ঈদগাহটি পরিচিতি লাভ করে। ১৯৫০ সাল থেকে ওয়াকফ দলিলমূলে হয়বতনগর জমিদার বাড়ির দেওয়ান মান্নান দাদ খান থেকে বংশানুক্রমিকভাবে বড় ছেলেরা শোলাকিয়া ঈদগাহের মুতাওয়াল্লির দায়িত্ব পালন করে আসছেন। বর্তমানে দেওয়ান ফাত্তাহ দাদ খান মঈন মুতাওয়াল্লি ও দেওয়ান মোঃ রউফ দাদ খান নায়েবে মুতাওয়াল্লির দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। ১৯২৮ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম বড় জামাতের ইমামতি করেন শোলাকিয়া সুফি সৈয়দ আহমদ। আন্তর্জাতিক ও বরকতময় ঈদগাহে যুগে যুগে খ্যাতনামা আলেমগণ ইমামের দায়িত্ব পালন করে আসছেন।


(পিকেএস/এসসি/জুলাই১৮,২০১৫)