মাদারীপুর প্রতিনিধি :গত বছর ঈদের ছুটি শেষে ৪ আগস্ট কর্মস্থল রাজধানী ঢাকায় ফিরতে গিয়ে পদ্মা নদীতে পিনাক-৬ নামের লঞ্চ ডুবে মারা যায় দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার বহু মানুষ। এই ঘটনায় লাশ পদ্মায় ভেসে উঠলেও আবার অনেক লাশ পাওয়া যায়নি।

সেই সব পরিবারগুলোতে এবার ঈদে কোন আনন্দ ছিলো না। ছিলো না উৎসবের আমেজ। তাদের ঈদ কেটেছে বুকভরা বেদনা আর না পাবার হতাশা নিয়ে। চোখ জুড়ে অশ্রু, বুকের ভিতর জমে থাকা পর্বত সম বোবা কান্না। স্বজনহারা এবারের ঈদ তাদের জন্য এক কষ্ট জাগানিয়া স্মৃতি নিয়ে হাজির হয়েছিলো।
মাদারীপুর জেলার শিবচরে স্বজন হারানো কয়েকটি পরিবারের সাথে কথা বলতে গেলে দেখা যায়, নিরব-নিস্তব্ধ বাড়ির চারপাশ জুড়ে যেন বিষাদের ছায়া। এই ঈদ করতে গ্রামে এসেই স্বজনদের হারানো পরিবারের মাঝে ঈদের আনন্দ ছিলো না। ঈদ মানেই এখন শুধু হারানো কষ্ট। স্বজনদের স্মৃতি প্রবলভাবে মানসপটে ফুটে উঠা।

ঈদের দিন শিবচর উপজেলার পাঁচ্চর ইউনিয়নের লপ্তেরচরে পিনাক-৬ ডুবিতে নিহত মিজানুর হাওলাদারের বাড়িতে গিয়ে দেখা গেছে বিষাদের ছায়া। ঈদ যেন নিয়ে এসেছে নতুন করে বেদনার বোঝা। বেঁচে থাকা বৃদ্ধ মায়ের ঘোলাটে চোখে এখন শুধু অশ্রু ভরা।

নিহত মিজানুর হাওলাদারের চাচাতো ভাই বিল্লাল হাওলাদার জানান, ঈদের এই সময়টায় ক’দিন ধরে চাচীর মধ্যে বড় ধরণের পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। মৃত ছেলে মিজানুর, তার স্ত্রী রোকসানা ও দুই সন্তান মিলি ও মইনের ব্যবহৃত জামা-কাপড় যতœ করে গোছাচ্ছে। নেড়ে-চেড়ে দেখছে আর কাঁদছে। দুদিন হলো সারাদিন শুধুই কাঁদে। ঈদের আনন্দ নেই আমাদের পরিবারে। এই ঈদ করেই ঢাকা যাওয়ার সময় মিজান ভাই তার স্ত্রী ও ছেলে মেয়েসহ মারা যায় লঞ্চ ডুবিতে।’

নিহত মিজানুর হাওলাদারের মা রিজিয়া বেগমের সাথে কথা বলতে গেলে বারবার চোখ মুছেন তিনি। যা বলতে চান কান্না এসে আটকে যায় তার কণ্ঠ। সাংবাদিকদের দেখেই চোখ মুছতে শুরু করেন। শুরু করেন হাউমাউ করে কান্না।
কান্নাজড়িত কণ্ঠে ছেলের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জানান, যে কদিন বেঁচে থাকবেন ঈদের আনন্দ আর আসবে না। গত বছরের ঈদের আগের সময়টায় পুত্র-পরিজনদের জন্য অপেক্ষায় কাটতো তার সময়। সেই অপেক্ষায় ছিল এক অন্য রকম ভালো লাগার অনুভূতি। পুত্র-পুত্রবধু-নাতি-নাতনিদের দেখার জন্য সে কী অপেক্ষা, আনন্দ! আজ আর সেই আনন্দ নেই। এখন শুধুই কষ্ট।

কান্না জড়িত কণ্ঠে তিনি আরো বলেন,‘আমি আর যে কদিন বেঁচে থাকবো, আমার জীবনে কোন ঈদ নেই। আমার জীবনের সব কিছু আমি হারিয়েছি এই ঈদে। সন্তান হারানো শোকে মিজানের বাবা নুরুল ইসলামও সবাইকে ছেড়ে চলে গেলো। দুঃখ-বেদনা আর কষ্টের এই স্মৃতির সম্বল নিয়ে পরে আছি আমি।’
প্রতিবেশী শিরিন আক্তার বলেন, ‘চাচী গত বছর তার নাতি-নাতনীর জন্য ঈদের জামা-কাপড় কিনেছিলেন। ঈদ শেষে ঢাকা যাওয়ার সময় নিজ হাতে সেই জামা-কাপড় পরিয়ে দিয়েছিলেন নাতি-নাতনীদের। চাচী এই ঈদের ওদের কথা স্মরণ করে নতুন জামা কিনেছে। সেই জামা নিয়ে সারাক্ষণ কাঁদে আর বিলাপ করে।’

এখন ঈদ মানেই হলো সন্তান-পরিজন হারানো স্মৃতি ঘটা করে জানান দেয় শিবচর, মাদারীপুর, রাজৈরসহ দক্ষিণাঞ্চলের বহু পরিবারের মানুষদের মাঝে। আর বুক চাপা দিয়ে থাকা বেদনায় বুকের পাশটা ব্যথায় ভাড়ী হয়ে আসে লঞ্চ ডুবিতে নিহত পরিবারের মানুষদের মাঝে। এমনই অসংখ্য পরিবার মাঝে ঈদ মানে কষ্ট। শিবচর উপজেলার সন্ন্যাসিরচর ইউনিয়নের দৌলতপুর গ্রামের ঢাকায় ফেরার পথে স্ত্রী-সন্তান নিয়ে একই দূর্ঘটনায় মারা যান ফরহাদ মাতুব্বর। স্ত্রী শিল্পী, এক বছর বয়সী সন্তান ফাহিম ও শ্যালক বিল্লালসহ সলিল সমাধী ঘটে তার। যাদের লাশও শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। এই স্বজন হারানো পরিবারের এবারের ঈদও নিয়ে আসছে বিষাদের ছায়া।

নিহত ফরহাদের ১২ বছর বয়সী বোন প্রিয়া আক্তার বলেন, গত বছর ভাই-ভাবীসহ লঞ্চ দূর্ঘটনায় মারা যান। আমরা তাদের লাশও পাইনি। এখন ঈদের সময়টায় শুধু তাদের কথাই বেশি মনে পরছে।’
শিবচরে নিহত এমন আরো শতাধিক পরিবারে রয়েছে স্বজন হারানো বেদনা। ঈদ তাদের বেশি করে মনে করিয়ে দেয় হারানো স্বজনদের কথা।

উল্লেখ, গত বছর দেশের অন্যতম নৌপথ শিবচরের কাওড়াকান্দি-মাওয়া (বর্তমানে শিমুলিয়া) রুটে প্রায় আড়াই শতাধিক যাত্রী নিয়ে মাওয়া যাওয়ার পথে ডুবে যায় পিনাক-৬ নামের লঞ্চটি। এতে ৮৬ জনের লাশ উদ্ধার হয় এবং বেসরকারী হিসেব মতে আরো অর্ধ শতাধিক নিখোঁজ রয়েছে।

(এএসএ/এসসি/জুলাই২০,২০১৫)