কলাপাড়া(পটুয়াখালী)প্রতনিধি :টানা আট বছর ধরেই ওরাই রয়ে গেছে মৃত্যুকূপে। প্রতিটি ঝড়-জলোচ্ছাস ও ঘুর্ণিঝড়ে ওরাই ক্ষতিগ্রস্থ্ হয়। ঝড় পরবর্তী প্রতিটি ক্ষতিগ্রস্থ্ তালিকায় তাদের নাম সবার আগে থাকলেও এই দূর্যোগ থেকে ক্ষতিগ্রস্থদের রক্ষায় কোন পদক্ষেপই নেয়া হচ্ছে না।

কলাপাড়ার লালুয়া, ধুলাসার, মহীপুর, ধানখালী ও চম্পাপুর ইউনিয়নের বেড়িবাঁধের বাইরে ও বাঁধসংলগ্ন এবং চাড়িপাড়া, ধনজুপাড়া ও নিজামপুর ভাঙ্গা বাঁধের পাশে গত আট বছর ধরে সহস্রাধিক পরিবার রয়েছে ঠিক মৃত্যুকূপেই। বৃহস্পতিবার উপকূলের দিকে ধেয়ে আসা ঘূর্নিঝড় “কোমেন” আতংক ছড়িয়ে পড়ায় এইবারগুলোই রয়েছে চরম ঝুঁকিতে। ঘূর্নিঝড় কোমেন এর তথ্য সংগ্রহে গিয়ে জানা যায় এ তথ্য।
নাওয়াপাড়া গ্রামের সাহাভানু। এক সময়ে প্রায় ২৫ একর সম্পত্তির মালিক থাকলেও এখন বাঁধের কোনে ঝুঁপড়ি ঘরই তার শেষ আশ্রয়। ২০০৭ সালের সিডরে তাঁর শেষ সম্বল বসতঘরটি লন্ডভন্ড হওয়ার পর থেকে গত আট বছরে তিনবার ঘর ভেঙ্গেছে রাবনাবাদ নদীর ভাঙ্গনে। কিন্তু তাঁর পূনর্বাসন না হওয়ায় এখনও সেই ভাঙ্গা বাঁধের পাশেই ঝুঁপড়ি করে আশ্রয় নিয়েছে। ঝড়ের সিগন্যাল পেলে, কিংবা ঝড়ো বাতাস হলে ঝুঁপড়ি ছেড়ে বাঁধের উপর আশ্রয় নেয় সে। ঝড় থামলে ক্ষয়ক্ষতির তালিকায় তার নাম থাকে। ত্রানও পায়। কিন্তু হয়না পূনর্বাসন। এ সাহাভানুর মতো কয়েক হাজার পরিবার নিশ্চিত ঝুঁকির মধ্যে বাস করায় ঝড়-জলোচ্ছাস শুরু হলেই তাঁদের নিরাপদ আশ্রয়ে নেয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু ঝড় থেমে গেলে তাদের কথা কেউ মনে রাখে না।

লালুয়ার কৃষক চুন্নু হাওলাদার বলেন, তিনবার ঘর ভাঙ্গছে নদীতে। আবার উডাইছি। কিন্তু গত দুইদিন ধইর‌্যা যে পানি বাড়তেছে মনে হয় আর রক্ষা নেই। ঘূর্নি কোমেন কলাপাড়ায় আঘাত না করলেও আতংকে তাঁর মতো অন্তত তিন সহ¯্রাধিক ভূমিহীন পরিবার নিরাপদে বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছে।
কলাপাড়ার দুর্যোগ কবলিত কাউয়ার চর। ২০০৭ সালের সালের সিডরের জলোচ্ছাসে খড়কুঁটার মতো ভাসিয়ে নিয়েছিলো এ চরের বসতঘর ও মানুষ। ঘটেছিলো প্রানহানী। আইলার জলোচ্ছাসেও ক্ষতিগ্রস্থ্য হয়। সাগরের বুকে জেগে ওঠা এই চরে এখন প্রায় সহ¯্রাধিক পরিবারের বাস। ঝড়-জলোচ্ছাস হলেই এই গ্রামের মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ্য হয়। ৩/৫ ফুট পানি বাড়লেই সাগরের জলোচ্ছাসে ভেসে যায় বাড়ি-ঘর। কিন্তু সেই মৃত্যুর বালুকূপেই ভূমিহীন পরিবারগুলো আশ্রয় নিয়েছে।

নাওয়াপাড়া গ্রামের আনোয়ার হোসেন বলেন, এই যে বান্দের (নাওয়াপাড়া সদ্য নির্মিত বাঁধ) বাইরে ঘর গুলা দ্যাহেন না সবাই চুবানি খাইছে নদীতে। তাঁর ভাষায়,“ঝড় হইলেই হ্যারা ভাসে। ঝড় থামলে কাঁদে। এই বাঁধের বিভিন্ন পয়েন্টে অন্তত তিন শতাধিক পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। যারা ২০০৭ সালের সিডরে ক্ষতিগ্রস্থ্য হয়েছে। কিন্তু তাঁদের পূনর্বাসন না হওয়ায় আবার সেই মৃত্যুকূপেই আশ্রয় নিয়েছে।
কাউয়ার চর গ্রামের জেলে পলাশ জানান, নিজেগো তো জমি নাই। হেইয়ার লাইগ্যা এইহানে আইয়া ঘর উডাইছি। দিনে সাগরে মাছ ধরি,রাইতে আইয়া এইহানে ঘুমাই। একই গ্রামের অলিউল্লাহ জানান, মোগো এইহানে ঘর আছে জমিন নাই। মাইনষের জমিতে থাহি টাহা দিয়া। ঝড় বইন্না হইলে দৌড়ায় হালাইয়া থুইয়া। এই ৬০ বছরের কয়বার যে ঘর বইন্যায় গ্যাছে হ্যার কোন হিসাব নাই। সবাই হুনি কার্ডের জমি পায়। কিন্তু মোরা তো ভূমিহীন। মোগো ক্যানো দেয় না হেই কার্ড।

উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়ন ঘুরে দেখা যায়, বেড়িবাঁধের বাইরে ও বাঁধের পাশে যে পরিবারগুলো দীর্ঘ বছর ধরে বসবাস করছে ঝড় হলেই তারাই ক্ষতিগ্রস্থ্য হচ্ছে। কিন্তু এই ক্ষতিগ্রস্থ্য পরিবারগুলোর বিকল্প বসবাসের জায়গা না থাকায় নিশ্চিত মৃত্যু বা ক্ষতি জেনেও সেই মৃত্যুকূপেই বেঁচে থাকার চেষ্টা করছে। এ কারনে ঝড় হলেই এরা ক্ষতিগ্রস্থ্য হচ্ছে।

জানাযায়, কলাপাড়ার চাকামইয়া, চম্পাপুর ইউনিয়নের আশ্রয়ন প্রকল্পের অধিকাংশ ঘর বর্তমানে খালি পড়ে আছে। অনেক পরিবার ঘর বরাদ্দ পেলেও সেই ঘর ভাড়া দিয়ে অন্যত্র বসবাস করছে। এ কারনে এই দুটি আশ্রয়ন প্রকল্পের মালামাল লুটপাট চলছে। সরকার ভূমিহীন পরিবারগুলোকে এই দুটি প্রকল্পে পূনর্বাসন করলে অন্তত শতাধিক পরিবার রক্ষা পেতো।

কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. জাহাঙ্গীর হোসেন জানান, ঘূর্নিঝড় কোমেন আঘাত হানারি সংবাদ পেয়ে তাঁরা প্রস্তুত আছেন। দূর্যোগ প্রবন এলাকা থেকে ইতিমধ্যে বহু মানুষকে অন্যত্র সরিয়ে নেয়া হয়েছে।

সরকার ক্ষতিগ্রস্থ্য বহু পরিবারকে পূনর্বাসন করেছে। পর্যায়ক্রমে সকল ভূমিহীন পরিবারকে পূনর্বাসন করার চেষ্টা করা হবে বলে উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন অফিস সূত্র জানায়।


(এমকেবি/এসসি/জুলাই৩০,২০১৫)