‘যারে নিজে তুমি ভাসিয়ে ছিলে দুঃখ ধারার ভরা স্রোতে
তারে ডাক দিলে আজ কোন খেয়ালে আবার
তোমার ও পার হতে।’
-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

কালের যাত্রা বহমান গতিতে এগিয়ে চলেছে নিরবধি। সময়ের সাহসী সন্তানেরা পাষাণের বক্ষে আপনকর্মের আলোক প্রজ্বলিত ফলায় খোদাই করে স্মৃতি চিহ্ন রেখে অমরলোকে যাত্রা করে। রেখে যাওয়া কিছু কর্ম কিছু স্মৃতি দর্পণে বার বার ফিরে আসে। ক্ষণিকের পথচলার স্বর্ণালী চিহ্নগুলো প্রজন্ম থেকে প্রজন্মের পথচলার উজ্জ্বল দিক নির্দেশনা হয়ে থাকে। মহৎ এর আশা আর অমরত্ব যুগ ও কালের অক্ষয় দলিল। স্বার্থপর সমাজ ব্যবস্থায় লালিত বাসনায় আপন বলয়ের গ-ি অতিক্রম করা মানুষ বিরল। কিছু মানুষ নিজ বাসনাকে পেছনে ফেলে সমাজহিতকর কর্মে আত্মনিয়োগ করে আলোক পথের দিশারী হয়ে নিজ বাসনার উর্ধ্বে মানবপ্রেমকে তুলে ধরে। তেমনি সততা, সংগ্রাম বিশ্বাস আর মেধার অপূর্ব মিশ্রনে গড়ে ওঠা কুসুমিত ইস্পাত চরিত্রের এক সমাজ হিতৈষী খ্যাতিমান ভাষা সৈনিক ও মুক্তিযোদ্ধা, নির্ভিক, সৎ, সংগ্রামী, আপোষহীন, বিরল প্রতিভার অধিকারী প্রখ্যাত চক্ষু চিকিৎসক ডাঃ ননী গোপাল সাহা। পেশাগত জীবনে চক্ষু চিকিৎসক হলেও তিনি সাহিত্য, রাজনীতি, ধর্মতত্ত্ব, দর্শণ, মনোবিজ্ঞানসহ জ্ঞান-বিজ্ঞানের সকল ক্ষেত্রেই বিচরণ করতে আনন্দ পেতেন।

কিংবদন্তি ডাঃ ননী গোপাল সাহা, পিতা প্রয়াত কৃষ্ণ সাহা, মাতা প্রয়াত কুমুদিনী সাহা। জন্ম ১৯৩৩ সালের ১ ডিসেম্বর ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী থানার হাসামদিয়া গ্রামে। তাঁর বাবা ছিলেন ঐ অঞ্চলের ধনাঢ্য ব্যবসায়ী। বাবার অকাল প্রয়াণে তাঁদের পরিবারে অর্থকষ্ট নেমে আসে। ৪ ভাই ও ২ বোনের মধ্যে ননী গোপাল ছিলেন তৃতীয় সন্তান। বিয়ে করেছেন ১৯৫৭ সালে তৎকালীন বোয়ালমারী থানার মধুখালী উপজেলার বাগাট ইউনিয়নের বন্দর গ্রামে প্রয়াত মাখনলাল সাহার প্রথম কন্যা কনক লতা সাহাকে। ডাঃ ননী গোপালের ২ ছেলে ডাঃ তাপস কুমার সাহা ও অনুজ কুমার সাহা এবং একমাত্র কন্যাসন্তান আদরের বিপাশা। মেয়ে বিপাশার স্বামী পংকজ কুমার সাহাও একজন বিশিষ্ট ডাক্তার। ডাঃ ননী গোপাল সাহার বাল্যজীবন কেটেছে শ্যামল সবুজে ঘেরা প্রত্যন্ত অঞ্চলে। পাশের গ্রামের লোকনাথ স্কুল থেকে ১৯৪৫ সালে ষষ্ঠ শ্রেণী পাশ করে ফরিদপুর শহরের ঈশান ইন্ষ্টিটিউশনে ৭ শ্রেণীতে ভর্তি হন। আশ্রয় পেলেন শহরের আলীপুরে ছোট বোনের বাসায়। ১৯৪৭ সালে দেশ বিভক্তির পরে তাঁর মেজদা পশ্চিমবঙ্গের হুগলী জেলার গুপ্তিপাড়া হাই স্কুলে ভর্তি করে দেন। সেখানে একটি দোকান ঘরের পিছনে থেকে লেখাপড়া করতেন। এমনকি নিজে রান্না-বান্না করে খেতেন আর অবসরে দোকান চালাতেন। এরপর বর্ধমান জেলার কালনা শহরের অম্বিকা এম. ই স্কুলে ভর্তি হন। ওখান প্রায় দেড় বছর ওই স্কুলের মেসে থাকতেন। ১৯৪৯ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিয়ে দেশে ফিরে এসে মিটফোর্ড মেডিকের স্কুলে ভর্তি হবার চেষ্টা করলেন। লক্ষ্য এমএমএফ ডাক্তার হওয়া। অনেক চেষ্টা তদবির সত্ত্বেও ব্যর্থ হলেন। এ ব্যর্থতাই তাঁর জীবনের মোড় ঘুড়িয়ে দিল। শেষ মুহুর্তে ভর্তি হলেন ফরিদপুর রাজেন্দ্র কলেজে। কলেজের অধ্যক্ষ অবনীমোহন চক্রবর্তীকে অবাক করে দিয়ে ঐধষভ ুবধৎষু ও অহহঁধষ দুই পরীক্ষায়ই প্রথম হলেন। পয়সা কড়ির অভাব, অসুস্থতা সব মিলিয়ে ফাইনাল পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে উত্তীর্ন হলেন। এরপর ঢাকা মেডিক্যালে ভর্তি হলেন। আজকের এই বাংলাদেশ জন্মের ভ্রুণ রচিত হয়েছিল ১৯৫২ -এর ২১ ফেব্রুয়ারীতে। বাংলার দামাল ছেলেদের বুকের রক্তে লাল হয়েছিল ঢাকার রাজপথ। এখনও প্রতি ফাল্গুনে কৃষ্ণচুড়ার ডালে আগুন লাগিয়ে আমাদের সব স্মৃতিচারণে পাগল করে তোলে। বিশিষ্ট ডাক্তার মোহাম্মদ জাহেদ, খুলনার ডাঃ জ্ঞানেন্দ্রনাথ ও ডাঃ ননী গোপাল সাহাসহ বৃহত্তর ফরিদপুরের অনেক দামাল ছেলে এ আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহন করেন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারী ইতিহাসের সাক্ষী সেই মিছিলে অন্যদের সাথে ডাঃ ননী গোপাল সাহাও ছিলেন। অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেও বাঁচেনি রফিক, শফিক, জব্বার, বরকত। ২২ ফেব্রুয়ারী সকালে রফিক ও জব্বারের বিকৃত লাশের থেকে আনা ছেঁড়া কাপড় নিয়ে যে মিছিল হয়েছিল সেখানেও ডাঃ ননী গোপাল সাহা ছিলেন। ভাষা শহীদের সম্পর্কে তিনি বলেছেন, ‘৫২ -এর ২১ ফেব্রুয়ারীর বীর যোদ্ধারা বুলেটের আঘাতে চিরকালের মতো হারিয়ে গেছে। কিন্তু যে আদর্শের আগুন তাঁরা জ্বালিয়ে দিয়ে গেছেন সে আগুন কোন দিন নিভে যাবে না। বাঙালি জাতির অস্তিত্ব যতদিন থাকবে, সে আগুন ততদিন প্রজ্জ্বলিত হয়ে থাকবে।’ বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে এবং বাংলা একাডেমির উৎসাহে ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহনকারী ১২৩ জনের সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছিল সেখানে ডাঃ ননী গোপাল সাহা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারনা পোষণ করেছেন। তিনি সবসময় ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির পক্ষে ছিলেন। রাজনীতিতে ধর্মের প্রভাব তিনি একেবারেই পছন্দ করতেন না। ব্রিটিশ ভারতের অগ্নি বিপ্লবী কমরেড নাচোলের নারী নেত্রী ইলা মিত্রকে জেল থেকে ছাড়িয়ে গোপনে চিকিৎসার নামে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়ার জন্য পাসপোর্ট ও ভিসা করার কাজে ডাঃ ননী গোপাল সাহার ছিল গুরুত্বপূর্ণ অবদান। ১৯৫৬ সালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হতে এমবিবিএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। গইইঝ পরীক্ষার জবংঁষঃ ড়ঁঃ হবার আগেই বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলেন। স্ত্রী কনকলতার বয়স ছিল মাত্র ১৪ বছর। এমবিবিএস পাশ করার পর বৃহত্তর ময়মনসিংহের বর্তমান টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে মি.রণদাপ্রাদ সাহার কুমুদিনী হাসপাতালে যোগদান করেন। কাজের মাঝে পরিপূর্ণ ডাক্তার হলেন। ১৯৫৬ সালে দুই বছর চাকুরি করার পর চাকরি ছেড়ে দিয়ে মাটির ছেলে আবার ফরিদপুরে ফিরে এলেন। এতো কিছুর ফাকে মঞ্চ অভিনয়, ক্রীয়াঙ্গনে বিচরণ, রাজনৈতিক দলে নাম না লেখালেও স্বৈরাচারী আইয়ুবশাহীর বিরুদ্ধে সক্রিয় ভাবে আন্দোলনে অংশ গ্রহন করেন। এজন্য তাকে আইয়ুব সরকারের অবর্ণনীয় অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হতে হয়। এরপর এলো ১৯৭১ এর রক্তঝরা সংগ্রাম। বাঙালি জাতি বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল। ২৫ মার্চের ভয়াল কালো রাত্রিতে পাক হানাদার বাহিনীর লোকেরা ঢাকার বুকে নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালালো। ডাঃ ননী গোপাল সাহা জন্মভূমি ছেড়ে ভারতে প্রবেশ করে স্বাধীনতার স্বপক্ষে কাজ করতে শুরু করলেন। তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনীর শিবিরগুলোতে মেডিকেল সহায়তা প্রদানের জন্য ‘বাংলাদেশ এ্যাম্বুলেন্স কোর’ গঠিত হয়। কোরের কাজ ছিল মেডিকেল এসিস্ট্যান্ট হিসেবে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ দিয়ে মুক্তিবাহিনীর শিবিরে প্রেরণ করা। এ কোরের সম্পাদক ছিলেন ডাঃ ননী গোপাল সাহা। ১৬ ডিসেম্বর পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটল। দেশ স্বাধীন হলে দেশে ফিরলেন। তারপর ১৯৭৪ সালে মার্চে যুক্তরাজ্যে যান উচ্চ ডিগ্রি নিতে। রয়েল এলবার্ট এডওয়ার্ড হাসপাতালে চাকুরী গ্রহন করেন। চাকুরীকালীন সময়ে উক্ত হাসপাতালের কনসালটেন্ট ডাক্তার লী’র সুপাশিশে ডাবলিনে ডিও করেন। ১৯৭৭ সালে ওয়েলসে স্ট্যানলে হাসপাতালে চাকুরী করার সময় এফআর সিএস পরীক্ষা শেষ করে অসুস্থ অবস্থায় সংকল্প পরিত্যাগ করে দেশে প্রত্যার্পণ করেন। ১৯৮০ সালে মার্চে ‘সানডে শিশু ক্লিনিক’ এক কাজ শুরু করেন। পরবর্তীকালে ফরিদপুর ডায়াবেটিক সমিতি, ডা. জাহেদ মেমোরিয়াল শিশু হাসপাতাল, অন্ধকল্যাণ সমিতি, ফরিদপুর হার্ট ফাউন্ডেশন, ফরিদপুর রেডক্রিসেন্ট সোসাইটিসহ আরো অনেক মানবকল্যান প্রতিষ্ঠানের সাথেই ছিল তাঁর নিবিড় সম্পর্ক। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তিনি মানবসেবায় নিয়োজিত রেখেছিলেন। ১৯৮৮ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে এমন একজন সমাজসেবীকে ‘স্বাধীন বঙ্গভূমির অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। অমানবিক অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে মানবেতর বন্দী জীবন কাটালেন ছয় মাস। দুঃখ করে বলেছেন, ‘স্বর্গ নরক কথা দু’টি ছোট বেলা থেকে শুনে আসছি। স্বর্গের রূপ কেমন জানিনা তবে নরকের বাস্তব রূপ কারাগারে প্রত্যক্ষ করলাম।’ ডাঃ ননী গোপাল সাহার মুক্তির জন্য ফরিদপুরের কয়েকশত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ স্বাক্ষর করে স্মারকলিপি জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে স্বরাষ্ট মন্ত্রনালয়ে পাঠানো হলো অথচ কোন কাজ হয়নি। পরে ওনার ¯েœহভাজন লক্ষ্মী ঘোষের সহয়তায় স্ত্রী হাইকোর্টে রিট করেন। হাইকোর্ট থেকে বিনা বাধায় মুক্তি সনদ মেলে। ১৯৮৯ সালে ২১ এপ্রিল কারাগার থেকে মুক্তি পান। এর আগেও ১৯৭০ সালে অন্যায় ভাবে মিথ্যা মামলায় তাকে গ্রেফতার করে যশোর থানা ও ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে তাঁর প্রতি অমানুষিক নির্যাতন চালানো হয়। তবু দেশপ্রেমের প্রতি ছিল তাঁর অবিচল বিশ্বাস। ডাঃ ননী গোপাল সাহা দুঃখ করে বলেছেন- ‘আমার জীবনটাই কালবৈশাখীর ঝড় যা শুধু ধ্বংসই করেছে, দিয়েছে খুবই সামান্য।’

ডাঃ ননী গোপাল সাহা ফরিদপুর শহরে চক্ষুচিকিৎসক হিসেবে সুদীর্ঘকাল চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত ছিলেন এছাড়াও অপরাপর গুণাবলীর মধ্যে তিনি ছিলেন একাধারে অনলবর্ষী বক্তা, মানবতাবাদী, রাজনৈতিক, সমাজসেবক প্রতিভাবান নাট্যকর্মী, সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। সাম্প্রতিক সময়ে তাঁর ‘আমার দেখা ভাষা আন্দোলন, ‘মুক্তিযুদ্ধ ও রাজনীতি’ নামক দু’টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। ডাঃ ননী গোপাল সাহা তাঁর প্রফেশনাল ক্ষেত্রে সুনামের অধিকারী ছিলেন। তাঁর চেয়ে বেশী বিদগ্ধ ছিলেন সাংস্কৃতিক ব্যক্তি হিসেবে। বিশেষতঃ স্বামী বিবেকানন্দ, কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শ্রীকৃষ্ণ পরমহংস দেব, পল্লী কবি জসীম উদ্দীনসহ বাংলা সাহিত্যের পাশাপাশি ইংরেজী সাহিত্যে বাংলা রেনেসাঁস। ইউরোপিয়ান রেনেসাঁসসহ এমন কেন বিষয় নেই যে তাঁর ছিল অজানা। সব বিষয়ে তাঁর ছিল পা-িত্ব। চমৎকার বক্তব্য দিতেন। বক্তৃতা করতে করতে উনি এতটাই আবেগপ্রবন হয়ে যেতেন, উনার শারীরিক অসুস্থতার কথা যেতেন। ডাক্তার এবং পরিবারের আপনজনের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও যে কোন অনুষ্ঠানে ছুটে যেতেন। এসবের মাঝে বেঁচে থাকতেই তিনি বেশী পছন্দ করতেন। প্রাঞ্জল ভাষায় সুন্দর করে বুঝিয়ে দেওয়ার গুণ তাঁর মধ্যে যথেষ্ট ছিল। দর্শক শ্রোতা বিদগ্ধ চিত্তে উপভোগ করতেন। এমনকি মৃত্যুর দিনটি ছিল ভগবান শ্রীকৃষের শুভ আবির্ভাব দিবস। প্রথমবারের মতো রাষ্ট্রীয়ভাবে দিবসটি পালন করা হচ্ছিল। সকালে জেলা প্রশাসক কর্তৃক আয়োজিত জন্মাষ্টমীর অনুষ্ঠানে ঘন্টা খানেক তাৎপর্যপূর্ণ বক্তব্য উপস্থাপন করেছিলেন। বিদগ্ধ শ্রোতাম-লী পরিতৃপ্ত হন। হৃষ্টচিত্তে প্রশংসাসূচক সাধুবাদ উচ্চারিত হয়। বিকেলে ছিল সাহিত্য পরিষদে দেশ বরেণ্য নন্দিত কথা সাহিত্যিক হুমায়ূন আহমেদ ও খ্যাতিমান চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের স্মরণ সভা ও ইফ্তার পার্টি। একে একে অনেকেই বক্তব্য দিলেন। নাম ঘোষণা করতেই ধীরে মৃদু লয়ে উঠে সুস্মিত চেহারার প্রজ্ঞাবান সুবক্তা, কথার যাদুকর, কথার শিল্পী, নিরহঙ্কার সেই মহারাজ রোস্ট্রামে এসে দাঁড়ালেন। ক্লান্তিময় অবয়ব। বুকে একটু হাত দিয়ে বললেন -‘শরীরটা বেশী একটা ভালো নয়। মনে হয় বেশী একটা বলতে পারবো না।’ তারপরও শুরু করলেন মননের রেশমি সুতোয় বুনে চললেন বাচনিক কারুকাজ। সময়, সীমা, বয়স ভুলে বরাবরের মতো। অলংকারে, অনুপ্রাসে, অনভবে, অভিজ্ঞতায়, প্রজ্ঞায় প্রবচনে। ঋষিকল্প মানুষটি যখনই যা নিয়ে বলেন রাজকোষ খুলে যায়। বোঝা যায় নিবিষ্ট পড়ার ধার তার রক্তে। ইতিহাস, ঐতিহ্য, ধর্ম, সংস্কৃতির অভিঘাত আলোড়ন তাঁর মজ্জায়। বিবর্ণ মননের এই আঁধার শহরে তিনি যেন মনীষার বাতিঘর। চলনে-বলনে, লিখনে-চিন্তনে, আচার-আচরনে ৭৯ বছরের আয়ুষ্কাল তাকে ক্রমাগত ব্যাক্তি থেকে ব্যক্তিত্বের উঁচুতে নিয়ে গেছে। চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদ সম্পর্কে বলে চললেন অবিরল প্রবাহে। নদীর মতো বক্তব্য খর¯্রােতা তীক্ষ্ম মুখ হতে থাকে। কিন্তু রোজার বিকেল। আজানের আগেই সভা শেষ করতে হবে। প্রথামাফিক প্রধান অতিথি, সভাপতির বক্তব্য তখনও বাকি। উপস্থাপক আইকন্টাক্ট করার চেষ্টা করেন। উদ্দাম গতির রথের রশি টেনে ধরলেন সারথী। কত স্মৃতি তারেক মাসুদের সাথে। ঘরোয়া, আড্ডায়, রিক্সায়, হাঁটাপথে কত স্বপ্নের কথা, সাহিত্য, সংস্কৃতি নিয়ে ফরিদপুরকে নিয়ে একটা সিনেমা বানাবার কথা। আর সেই তারেক মাসুদ আমাদের নিরন্তর সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে চলে গেল। রুমালে মুখ মুছতে মুছতে রোষ্ট্রাম ছেড়ে দিয়ে নিজ আসনে মাথাটা একটু ঝুকিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে বসলেন। চোখে ক্লান্তির ঝিমুনি, মিহি আবছা এক রকমের তন্দ্রা। এরপর বাকিরা যথাবিহিত সংক্ষেপে বক্তব্য সারলেন। ততক্ষণে দিনের আলো মিইয়ে এসেছে। ইফ্তারি সবার সামনে। মৃদু কন্ঠে কেউ কেউ দোয়া দুরুদ পড়ছেন। সবটুকু আলো নিঃশেষে উজার করে বিলিয়ে পশ্চিম প্রান্তের গাছগাছালির আড়ালে ঢলে পড়ছে অস্তগামী সূর্য। মসজিদের মিনার থেকে মাগরিবের আজানের মোলায়েম সুর ছড়িয়ে পড়ল মফঃস্বল শহরে। মুসুল্লিরা সবাই পানি মুখে দিচ্ছেন। ডাঃ ননী গোপাল সাহার সামনেও ইফ্তারি। বাল্যবন্ধু সর্বজন শ্রদ্ধেয় শিক্ষক জগদীশ চন্দ্র ঘোষ হাতের মৃদু চাপে ডাক দিলেন। এই প্রথম বন্ধুর ডাক অগ্রাহ্য করলেন ধ্যানস্থ মনিমূর্তি। আবার মৃদু ঝাঁকুনি দিলেন। এবারও নিঃসাড়। ঢলে পড়লেন যোগাসনের ঋষিপ্রবর। দ্রুত এ্যাম্বুলেন্স এনে নিয়ে যাওয়া হলো সদর হাসপাতাল। ইমারজেন্সির ডাক্তার পালর্স, প্রেসার, হার্ট, চেক করলেন এমন একজনের যিনি বিগত অর্ধশতাব্দী ধরে গোটা শহরের পালর্স, প্রেসার ঠিক রাখছিলেন। প্রাণের শেষ অবশেষটুকু ফিরিয়ে আনতে সর্বাত্মক চেষ্টা করলেন ইমারজেন্সির ডাক্তার। একবার দু’বার, কয়েকবার। ততক্ষনে আকাশ থেকে সূর্যের শেষ আলোকটুকুও মুছে গেছে। অদ্ভুদ কালো এক ভূতুরে আলখেল্লার নিচে হারিয়ে গেছে ফরিদপুর। ৯ ই জুলাই ২০১২ বিশাল কর্মময় জীবনের ইতি ঘটল। আমরা হারালাম একজন ভাষা সৈনিক, সুবক্তা, দেশ প্রেমিক, দক্ষ মানবসেবক, চক্ষুবিশেষজ্ঞ, অকুতোভয়, প্রতিবাদী এক বলিষ্ট ব্যক্তিকে।। জীবনের পড়ন্ত বেলায় ডাঃ ননী গোপাল সাহার কোন কিছু চাওয়া-পাওয়ার ছিল না। তবে তিনি শেষ ইচ্ছা পোষণ করে লিখেছিলেন তাঁর কাব্যগ্রন্থে ‘আমার জন্মভুমিতেই শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে চাই। এই বাংলাদেশের মাটি, আকাশ ও বাতাসে একদিন ছাই হয়ে মিশে যেতে চাই।’ তাঁর মৃত্যুর আগে একমাত্র কন্যা বিপাশাকে কিছু নির্দেশ দিয়ে চিঠি লিখেছিলেন। তার মধ্যে শেষ শর্তটা লিপিবদ্ধ করা হলো-

বিপাশা মা আমার,
যদি ভারতে আমার মৃত্যু হয় তাহলে মৃতদেহ ভারতেই দাহ করতে হবে। ফরিদপুরে মরদেহ আনার প্রয়োজন নেই। যদি সম্ভব হয় কিছু চিতাভস্ম এনে অম্বিকাপুর শ্মশান ঘাটের মাটিতে ছড়িয়ে দিতে হবে। আমি চেয়েছিলাম আমার প্রিয় জন্মভমি এই বাংলাদেশের মাটিতে ও আকাশে বাতাসে ছাই হয়ে মিশে যেতে । আমার দেওয়া সব নির্দেশগুলো যেন পালন করা হয়।
ডা. ননীগোপাল সাহা
১৬. ০৬. ২০১১

মহান সৃষ্টিকর্তা তাঁর শেষ ইচ্ছা পূরণ করলেন। জীবনে অনেক মানুষের মৃত্যু দেখেছি কিন্তু ডাঃ ননী গোপাল সাহার মতো এমন শান্তির মৃত্যু কখনও দেখি নাই। কাছের মানুষ, ভক্ত-গুণগ্রাহীদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে দিয়ে পরপারের পথে অনন্তযাত্রা করলেন। এই শোক বড় বেদনার, বড় যন্ত্রণার। এক বিশিষ্ট শিক্ষাবিদের উক্তি “অ ঃৎঁষু মৎবধঃ ংড়ঁষ ঢ়ধংংবফ ধধিু, রঃং ধহ রৎৎবঢ়ধৎধনষব ষড়ংং ভড়ৎ ঁং.” সত্যিকার অর্থেই এ ক্ষতি অপূরণীয়। বিদ্রোহী কাজী নজরুল -এর একটি কবিতার কয়েকটি পঙ্ত্তি দিয়ে যবনিকা টানছি-

‘বিদায় সন্ধ্যা আসিল ওই ঘনায় নয়ণে অন্ধকার
হে প্রিয় আমার, যাত্রা পথ অশ্রু পিছল করো না আর।’