চৌধুরী আ. হান্নান : ব্যাংকের দুরবস্থা, শোচনীয়তা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছে তা আঁচ করতে বেগ পেতে হয় না। বিষয়টি বহুল আলোচিত। ব্যাংকের আটকে পড়া ঋণ, খেলাপি ঋণ নিয়ে যাঁরা দীর্ঘদিন গবেষণা করেছেন, ব্যাংক ব্যবস্থাপনা বিষয়ে বিশেষজ্ঞ বা এ বিষয়ে যাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক তাঁরা এ দুরবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বিভিন্ন সময়ে নানা মূল্যবান পরামর্শ রেখেছেন কিন্তু কে শুনে কার কথা ?

রোগ মারাত্মাক আকার ধারণ করার আগে রোগী ডাক্তারের কথা শুনতে চায় না, ঔষধ সেবন করতে চায় না। অসুখটা কতটা গুরুতর তা রোগী নিজে বুঝতে পারে না। সে জন্য ‘ডাক্তার আসিবার পূর্বে রোগী মারা গিয়েছিল’ অবস্থা সৃষ্টি হওয়ার আগে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হয়। জীবন রক্ষায় শেষ ভরসা হিসেবে অনেক সময় হাসপাতালে রোগীকে লাইফ সাপোর্টের ব্যবস্থা করা হয়।

রাষ্ট্রখাতের ব্যাংকগুলোতে ঋণ জালিয়াতি, অনিয়মের কারণে সৃষ্ট মূলধন ঘাটতি সরকারকে মেটাতে হয়। জনগণের করের টাকা থেকে এ ভর্তুকির অর্থ জোগান দিতে হয়। ভর্তুকি দিয়ে ব্যাংকের স্বাস্থ্য সবল রাখার চেষ্টা লাইফ সাপোর্টের নামান্তর নয় কী ?

গত বছর চার হাজার কোটি টাকার বেশি এই ব্যাংকগুলোর চাকা সচল রাখার জন্য ভর্তুকি দেয়া হয়েছে। সম্প্রতি ২(দুই) দফায় বেসিক ব্যাংকে প্রায় ১২০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়া হয়েছে এবং আরও ২০০ কোটি টাকা অচিরেই না জোগান দিলে ব্যাংকটি দেউলিয়া হওয়ার আশংকা রয়েছে। সেক্ষেত্রে জনগণের আমানতের টাকা ফেরত দেয়ার দায়িত্ব তো সরকারের ঘাড়েই পড়বে। তাছাড়া কেবল সরকারের কোষাগার থেকে ভর্তুকি দিয়ে একটি ব্যাংকে কতদিন টিকিয়ে রাখা সম্ভব ? ভর্তুকি দেয়ার প্রচলন এত সহজ করে দিলে সে তো কষ্ট করে নিজ পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টাই করবে না, পরগাছা হয়ে যাবে। বখাটে ছেলেকে কোন পিতার জুয়া খেলার অর্থ জোগান দেয়া উচিত নয়।

গ্রিস সরকার সস্তা জনপ্রিয়তা হারানোর আশংকায় দেশের দেউলিয়া হয়ে যাওয়া জাতীয় বিভিন্ন সেবা সংস্থাকে বছরের পর বছর অযৌক্তিকভাবে ভর্তুকি দিয়ে আসছিল। আজ সেই গণতন্ত্র ও সভ্যতার সূতিকাগার খ্যাত রাষ্ট্রটি নিজেই দেউলিয়া হওয়ার দ্বার প্রান্তে। অনবরত অযৌক্তিক ভর্তুকি দেয়াকে ও এর একটি কারণ হিসেবে দেখা হয়। ব্যাংকের দুরবস্থা নিরসনের জন্য উদ্যোগ এখনই নিতে হবে ব্যাংক ব্যবস্থাকে দ্বৈত শাসনের কবল থেকে উদ্বার করে একক রেগুলেটরি বডি অর্থাৎ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেয়ার বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ দীর্ঘদিনের। ব্যাংক নিয়ন্ত্রণের জন্য অর্থ মন্ত্রণালয়ে আলাদা বিভাগ সৃষ্টির প্রয়োজন ছিল না।

হলর্মাক কেলেংকারী প্রথম উদঘাটিত হওয়ার পর করণীয় নির্ধারণ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাথে অর্থমন্ত্রণালয়ের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নিয়েছিল। দুর্ঘটনার দায় কেউ নিতে চায় না। কিন্তু একক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় দায় এড়ানোর সুযোগ থাকে না।

ব্যাংকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা নিয়োগ বাংলাদেশ ব্যাংকের পুর্বানোমোদন নেয়ার শর্ত রয়েছে ব্যাংক কোম্পানী আইনে। কিন্তু সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন না নিয়ে একটি সরকারি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দিয়েছে অর্থ মন্ত্রণালয়। বলা হয় ব্যাংক খ্যাতের প্রধান নিয়ন্ত্রক কেন্দ্রীয় ব্যাংক, অথচ বিধিবদ্ধ বিধান থাকা সত্বেও অনেক ক্ষেত্রে তা না মেনে বিধি ভঙ্গের খারাপ নজির সৃষ্টি করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংকের নিকট ব্যাংক খাতের নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা একক হাতে না দিলে, বাংলাদেশ ব্যাংক স্বাধীনভাবে কাজ করতে না পারলে ব্যাংক ব্যবস্থার দুরবস্থা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব নয়।

আসলে সরকারি ব্যাংকের নিয়ন্ত্রক দু’টি নয়, বহু। সরকারের আমলা, রাজনীতিবিদ ও ঋণখেলাপিরা তাদের মধ্যে অন্যতম। বড় বড় ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপিরা ব্যাংক পরিচালনায় নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে নেপথ্য নায়ক বললে বাড়তি বলা হবে না। কারণ অর্থ যার ক্ষমতা তার, আইনও তার।

ব্যাংক ব্যবস্থার দিকে তাকালে হিন্দু পুরাণ মহাভারতে বর্ণিত দ্রোপদির পঞ্চ স্বামীর কাহিনী মনে হবে। এ জন্যই ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপকগণ গ্রাহকের সাথে প্রাথমিক আলোচনায় ব্যাংকিং নীতি মালার আলোকে স্পষ্ট করে কথা বলতে দ্বিধা করেন। তাকে ভাবতে হয় এ গ্রাহকটি কোন পা-বের লোক অর্জুন না ভীম বা অন্য কেউ।

কাজেই প্রথমত : বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ অনুযায়ী ব্যাংক ব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একক নিয়ন্ত্রণে যত দ্রুত ছেড়ে দেয়া যাবে ততই মঙ্গল।

দ্বিতীয়ত : চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলামের পরামর্শ মোতাবেক ঋণখেলাপিকে দ্রুত বিচারের আওতায় আনার জন্য ‘খেলাপি ব্যাংক ঋণ ট্রাইবুনাল’ গঠন করা হোক। প্রাথমিকভাবে প্রতিটি ব্যাংকের শীর্ষ দশ ঋণখেলাপিকে চিহ্নিত করা এবং পর্যায়ক্রমে অগ্রসর হতে হবে। বর্তমান বিচার ব্যবস্থার মাধ্যমে খেলাপি ঋণ আদায় এবং ঋণখেলাপিদের শাস্তি প্রদান সম্ভব হচ্ছে না। সে ক্ষেত্রে এ বিষয়ে ফলপ্রসূ ব্যবস্থা হিসেবে আলাদা ট্রাইবুনাল গঠন করার কোন বিকল্প নেই।

তৃতীয়ত : এক শ্রেণীর হতভাগ্য ব্যাংক কর্মকর্তা জাল জালিয়াতি রোধে সক্রিয় থাকার কারণে নানা রকম হয়রানির শিকার হয়েছে। হলর্মাক, বেসিক ব্যাংক, বিসমিল্লাহ গ্রুপ ইত্যাদি বড় বড় ঋণ জালিয়াতি রোধে যারা নৈতিক দায়িত্ব থেকে বাধার সৃষ্টি করেছিল তারা এখন কোথায়? যাদেরকে ‘বোকা’ বলে বিদ্রুপ করা হয়ে থাকে। ব্যাংকের পরিচালনা পরিষদের চেয়ারম্যান বা প্রধান নির্বাহী যখন নিজেই ব্যাংকের অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অনৈতিক ইচ্ছা পুরণ করার জন্য নীল নকশা বাস্তবায়নের জন্য নির্দেশ দিতে থাকেন, তখন সৎ-নিষ্ঠাবান কর্মকর্তাগণ বড় অসহায় হয়ে পড়েন। জলে কুমিরের সাথে বসবাস করার মত ব্যাপার হয়ে দাঁড়ায়।

তারপরও যারা অনৈতিক কাজে সহযোগিতা না করার ‘অপরাধে’ পদোন্নতি বঞ্চিত হন, বদলি হয়ে দূর-দূরান্তে ছিটকে পড়েন, তারা সাহসী বীর। তাদের খুঁজে বের করে ব্যাংক ব্যবস্থাপনার মূলধারায় ফেরত আনতে হবে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাফল্য উল্লেখ করার মত। অনেক ক্ষেত্রেই অর্জন বিস্ময়কর। বর্তমান রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার কারণে দেশ দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে-নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশে পৌঁছে গেছে। মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হওয়া এখন কেবল সময়ের ব্যাপার।

উত্তাল নদীতে পারাপারের নৌকায় হাল ধরেছেন আমাদের শেখের কন্যা। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের প্রত্যাশা তিনি পৌঁছে দেবেন কূলে, পৌঁছে দেবেন গন্তব্যে। কিন্তু তার আগে সকল অপচয়ের ছিদ্র বন্ধ করা চাই।

লেখক : সাবেক ব্যাংকার