আলী আখতার গোলাম কিবরিয়া : সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খান বুঝতে পারছেন না প্রবীর সিকদার সাংবাদিক না এক্টিভিস্ট! খান সাহেব নিশ্চয়ই মানবেন যে, জার্নালিজমই হচ্ছে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় এক্টিভিজম। নাহলে একাত্তরের ১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানী ঘাতকরা বেছে বেছে জার্নালিস্টকে হত্যা করতো না। প্রবীর সিকদার জার্নালিস্ট না হয়ে এক্টিভিস্ট হলে ভারতের প্রবাদ প্রতীম সাংবাদিক খুশওয়ান্ত সিং সাংবাদিক নন, তিনি এক্টিভিস্ট।

 

খুশওয়ান্ত সিং সাংবাদিক হয়েও অসাম্প্রদায়িকতার পক্ষে যে এক্টিভিজম চালিয়েছেন সেটি বিবেকের কাছে প্রচন্ড রকমের দায়বদ্ধতা থেকেই চালিয়েছেন। প্রবীর সিকদার ঠিক তেমনটাই করেছেন এবং করে যাচ্ছেন। স্বাধীন সাংবাদিকতার অর্থ এই নয় যে মানবতাবিরোধী-যুদ্ধাপরাধী রাজাকারদের পক্ষে ইনিয়ে-বিনিয়ে কথা বলার সুযোগ থাকে। জনাব খান, আমি একজন ক্ষুদে সাংবাদিক, দৈনিক সংবাদে কাজ করি। থাকি গ্রামে, হাতীবান্ধা উপজেলায়। আপনাকে জ্ঞান দেয়ার ধৃষ্টতা আমার নেই। তবে নিশ্চয়ই আমার সাথে আপনি দ্বিমত করবেন না যে, সত্য-মিথ্যার মাঝখানে দাঁড়ানোর নাম নিরপেক্ষতা নয়। সত্যের পক্ষে জোরালো অবস্থান নেয়ার নামই নিরপেক্ষতা। সেই সত্যের আলোকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় শাণিত শহীদ পরিবারের সন্তান প্রবীর সিকদার রাজাকারদের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবস্থান নিয়ে তাঁর নিরপেক্ষতা প্রমাণ করেছেন। জার্নালিজম বা সাংবাদিকতার নৈতিকতার জায়গা থেকে এতটুকুও বিচ্যুত হননি তিনি।

প্রবীর সিকদার দৈনিক জনকন্ঠে মুসা বিন শমসেরকে নিয়ে যে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন করেছিলেন সেটা জার্নালিজম। এমনকি এখনও উনি উত্তরাধিকার ৭১ নিউজে যে খবর প্রকাশ করেন তা জার্নালিজমই। জার্নালিজম বা সাংবাদিকতার কারণে ২০০১ সালে দুর্বৃত্তদের বোমা ও চাপাতির আক্রমণে একটি পা হারিয়েছেন তিনি, একটি হাতের সক্ষমতা হারিয়েছেন, শরীরে আজও বয়ে বেড়ান বোমার অসংখ্য স্প্লিন্টার। সেই প্রবীর সিকদার আবার গ্রেফতার হলেন ২০১৫ সালে। জনকন্ঠে প্রকাশিত প্রতিবেদন উত্তরাধিকার ৭১ নিউজে পুন:প্রকাশ করার পরপরই ওনার কাছে হত্যার হুমকি আসতে থাকে। এর আগে হুমকি আসেনি। অর্থাৎ জার্নালিজমের কারণেই প্রবীর সিকদার জীবন শংকায় পড়েছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী তিনি পুলিশের কাছে জিডি করতে গিয়েছিলেন। পুলিশ জিডি নেয়নি। বাধ্য হয়ে প্রবীর সিকদার তাঁর ফেসবুক টাইম লাইনে জন-ডায়েরি করেন। কারণ সামাজিক যোগাযোগের এই মাধ্যমটি এসেছে জনমানুষের কন্ঠস্বর হয়ে।

জনাব নাঈমুল ইসলাম খান, আপনাদের সাংবাদিকতার সোনালী সময় এখন অতিক্রান্ত প্রায়। সাংবাদিকতার সাদা-কালো যুগটি ক্রমশ ফুরিয়ে যাচ্ছে। পৃথিবীর নানা দেশে সংবাদপত্র ছাপা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। এখন নতুন মিডিয়া অর্থাৎ ইন্টারনেট ভিত্তিক সংবাদপত্র সোস্যাল মিডিয়ায় জায়গা করে নিচ্ছে। আমরা প্রবীর সিকদারের টাইমলাইনে ওনার ওয়েব পোর্টালের খবরের লিংক বেশী দেখতে পাই। ফেসবুক টাইম লাইন হচ্ছে ডিজিটাল ডায়েরি সেখানে ব্যক্তিগত চিন্তার প্রকাশ তো থাকবেই। কিন্তু প্রবীর সিকদারের সাংবাদিকতা এবং ব্যক্তিগত ডায়েরি সাংঘর্ষিক হয়নি। সাংবাদিকতার রীতি-নীতি তিনি ক্ষুন্ন করেননি। প্রবীর সিকদার সাংবাদিকতা করেন। প্রিভিলেজ নিয়ে বেড়ানো খরগোস সমাজের লোক নন তিনি।

আমার মনে হয়, সাংবাদিক নাঈমুল ইসলাম খান হয়ত বয়সের কারণে অনলাইন মিডিয়ার সঙ্গে একটা প্রজন্ম ব্যবধানে পড়ে গেছেন। মূল ধারার মিডিয়াগুলো জনস্বার্থ রক্ষা করতে অনেকাংশে ব্যর্থ হবার কারণেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিকল্প মিডিয়া হিসেবে দাঁড়িয়ে গেছে। এই সত্যটি তিনি বুঝতে চান না। বুঝতে চান না যে, আজকাল সোস্যাল মিডিয়া থেকেই বিভিন্ন তথ্য-উদ্ধৃতি জোগার করতে হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী যখন বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন তখন নাঈমুল সাহেবদের সাব-এডিটররা নিষ্পলক দৃষ্টি রেখেছিলেন মি: মোদীর টুইটার অ্যাকাউন্টের দিকে। আমাদের দেশের দৃশ্যপটও দ্রুত বদলাচ্ছে। এখন মুল ধারার মিডিয়ার আগেই খবর আসে সোস্যাল মিডিয়ায়। সিলেটের শিশু রাজন হত্যাকান্ডের ভিডিও ফুটেজ সোস্যাল মিডিয়ায় শেয়ার করা না হলে মূল ধারার মিডিয়া জানতেই পারতো না রাজনের ট্রাজেডি। আমরাও এত দ্রুত শিশু রাজনের কষ্টগুলো বুকে ধারণ করে কাতরাতে পারতাম না। শেষে বিনয়ের সাথে বলি, জনাব খান অহংবোধ ছাড়ুন, চোখ খুলুন। (কৃতজ্ঞতা: মাসকাওয়াথ আহসান)
লেখক : শিক্ষক ও সাংবাদিক

(ওএস/এএস/আগস্ট ২৫, ২০১৫)