মাসুদ স্বপ্নীল : সংবিধান স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র এর রয়েছে নিজস্ব একটি সংবিধান। বাংলাদেশের সংবিধান ১১টি ভাগ এবং  ১৫৩ টি অনুচ্ছেদে বিভক্ত।বাংলাদেশের সংবিধানের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো এটি দুষ্পরিবর্তনীয়। কিন্তু এখন পর্যন্ত এটি ১৬ বার সংশোধীত হয়। যখন যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় এসেছে সংবিধান সংশোধন করেছে নিজেদের মতো করে।তেমনি ২০০৬ সালের অক্টোবর মাসে তৎকালীন বিএনপি জামায়াত জোট সরকার তাদের মেয়াদের শেষ সময় এসে “তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬” প্রনয়ণ করে যা সংবিধানে ৫৭ ধারায় অর্ন্তভূক্ত করা হয়।

২০০৬ সালে হওয়া এ আইনটি ২০০৯ ও ২০১৩ সালে দুই দফা সংশোধন করা হয়। সর্বশেষ সংশোধনে সাজা বাড়িয়ে ১০ বছর থেকে ১৪ বছর কারাদন্ড করা হয়। আর ৫৭ ধারার অপরাধকে করা হয় অজামিনযাগ্য। বর্তমান তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় বলা হয়েছে, “কোনো ব্যক্তি যদি ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যাহা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেহ পড়িলে, দেখিলে বা শুনিলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হইতে উদ্বুদ্ধ হইতে পারেন অথবা যাহার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করিতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহা হইলে তাহার এই কার্য হইবে একটি অপরাধ।”

সম্প্রতি প্রখ্যাত সাংবাদিক উত্তরাধিকার ৭১ পত্রিকার সম্পাদক প্রবীর শিকদার গত ১০ অগাস্ট তার ফেসবুকে ‘আমার জীবন শঙ্কা তথা মৃত্যুর জন্য যারা দায়ী থাকবেন’ শিরোনামের একটি স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন- “আমি খুব স্পষ্ট করেই বলছি, নিচের ব্যক্তিবর্গ আমার জীবন শংকা তথা মৃত্যুর জন্য দায়ী থাকবেন : ১. এলজিআরডি মন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার খন্দকার মোশাররফ হোসেন এমপি, ২. রাজাকার নুলা মুসা ওরফে ড. মুসা বিন শমসের, ৩. ফাঁসির দণ্ডাদেশ প্রাপ্ত যুদ্ধাপরাধী বাচ্চু রাজাকার ওরফে মাওলানা আবুল কালাম আজাদ এবং এই তিন জনের অনুসারী-সহযোগীরা।”

ওই লেখার কারণে রবিবার মামলার পূর্বেই সন্ধ্যায় গোয়েন্দা পুলিশ সাংবাদিক প্রবীর শিকদারকে তাদের কার্যালয়ে ধরে নিয়ে যায়। তখন তাকে আটক না করার কথা বলা হলেও নানা নাটকীয়তার পরে রাতে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হয় ফরিদপুরে। তখনই জানা যায়, ফেইসবুকে লেখার মাধ্যমে মন্ত্রী খন্দকার মোশাররফের সুনাম ক্ষুণ্ণের অভিযোগ তুলে ফরিদপুর কোতোয়ালি থানায় মামলা করেন ফরিদপুর জেলা কোর্টের এপিপি স্বপন পাল।রবিবার রাতে প্রবীর শিকদারের আটকের খবর ছড়িয়ে পড়লে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এ নিয়ে ব্যাপক সমোলচনা শুরু হয়।পরবর্তীতে তাকে আদালতে ৫৭ ধারায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় এবং তিন দিনের রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেন ফরিদপুর জেলা দায়রা জজ। পরবর্তীতে গত ১৯ শে আগস্ট ফরিদপুরের ১নং আমলি আদালতে হাজির করা হলে বিচারক হামিদুল ইসলাম তার জামিন আবেদন মঞ্জুর করেন। মূলত সাংবাদিক প্রবীর শিকদারকে গ্রেপ্তারের পরপরেই ৫৭ ধারা বাতিল নিয়ে আন্দোলন গড়ে উঠে। উল্লেখ্য আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতে তথ্য প্রযুক্তির উপর ৬৬ ধারা নামে একটি আইন প্রচলিত ছিল। পরবর্তীতে ওই দেশের সুপ্রীম কোর্ট এই আইনটি বাতিল করে।আমাদের সংবিধানের ৩৯ নং অনুচ্ছেদে মানুষের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা দেয়া হয়।যা প্রচলিত তথ্য প্রযুক্তি আইন- ২০০৬ অর্থাৎ ৫৭ ধারার সাথে সাংর্ঘষিক। কেননা ৫৭ ধারার কোথাও সুনিদির্ষ্টভাবে কোন অপরাধের কথা বলা হয়নি। শুধুমাত্র অপরাধ সংগঠনের কথা বলা হয়েছে।এক্ষেত্রে কাউকে যদি এই ধারায় অভিযুক্ত করে মামলা করা হয় তবে সেই মামলায় সে অভিযুক্ত প্রমানিত না হওয়া পর্যন্ত তাকে জেলহাজতে থাকতে হবে।অনেকেই উদ্দেশ্যপ্রনোদিত ভাবে এই ধারা ব্যাবহার করে কতিপয় ব্যাক্তিকে কে হেনস্তা করার জন্য এই আইনে মামলা করতে পারে।

এব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মাহফুজুল হক সুপন বলেন, ‘কোন সভ্য দেশে ৫৭ ধারার মতো আইন থাকতে পারেনা। বর্তমান মহাজোট সরকার একটি অসাম্প্রদায়িক সরকার। কোন অসাম্প্রদায়িক সরকারের সময়ে এ আইনটি থাকতে পারেনা।’ তিনি ৫৭ ধারাকে একটি সাম্প্রদায়িক আইন হিসেবেও অভিহিত করেন। তিনি অবিলম্বে এই আইনটি বাতিল করার আহব্বান জানান বর্তমান সরকারকে।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একাধিক ছাত্রের সাথে কথা হলে তারাও এই ৫৭ ধারাকে বাংলাদেশের সংবিধান থেকে বাদ দেয়ার কথা বলেন।বর্তমান সরকারের অন্যতম ভিশন ডিজিটাল বাংলাদেশ।এই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে তথ্য প্রযুক্তি গুরুত্বপূর্ন অবদান রাখছে কিন্তু ৫৭ ধারার মতো আইন সেই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে এক বড় অন্তরায় হয়ে দাড়িয়েছে। বর্তমান সরকারকে তাদের ভিশন বাস্তবায়নের জন্য হলেও এই আইনের আমূল পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।




(কেকে/এসসি/আগস্ট২৬,২০১৫)