আনিসুর রহমান আলিফ : আমি বাংলাদেশের উত্তর হতে ধেয়ে আসা শীতের প্রবল বাতাস বয়ে আসতে দেখেছি। দেখেছি দক্ষিণের সুবিশাল জলরাশি উন্মত্ত প্রলয় হয়ে বার বার কূলে আছড়ে পড়েছে। আমি সুন্দরবনের ডোরাকাটা বাঘের গগণভেদি গর্জন শুনেছি। দেখেছি অটল অবিচল দাঁড়িয়ে থাকা চিম্বুক, কেউকারাডং।

হায়! আমার অভাগা চোখ এত কিছু দেখেছে, তবুও কাকে যেন না দেখার অতৃপ্ত এক আস্বাদের দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছে বার বার। তাঁকে দেখার আকাঙ্ক্ষা প্রতিটি মুহূর্তে আমাকে ডেকে বলেছে, তুমি তো তাঁকেই দেখতে পাওনি। যিনি বন্ধুর জন্য উন্নত, শত্রুর জন্য চির উদ্ধত। তিনি মুখোশধারীদের কাছে আপোসহীন এক পর্বতের নাম। তিনি সত্যিকারের একজন পিতা, সন্তানের স্বার্থ রক্ষায় তিনি অটল-অবিচল। তিনি সৎ, তিনি শুভ্র, তিনি চির বহমান। তিনি বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

হায়! আমি সত্যিই এক হতভাগা বঙ্গ সন্তান। যে এনে দিয়েছে আমায় অনন্ত এ স্বাধীনতা! যার রচিত স্বাধীনতার কোলে শুয়ে আমি ইচ্ছে খুশিতে দোল খাই, গাই বাংলার গান। বুলেটের আঘাতে তার বুকে যারা বারুদের নোনা গন্ধ মিশিয়েছে আমি তাদের সাথে করি বসবাস ! কত নির্লজ্জ আমি! কত অমানবিক আমার প্রতিদান ! ছিঃ কতো পৈশাচিক আমার শ্রদ্ধাবোধ! যে ছিলো আর্দশের প্রতীক, যে ছিলো অনুকরণীয়- অনুসরণীয়। কাদের ভয়ে, তাঁকে ভুলে আজ কীসের গঙ্গাস্নান করি?

একটি সংখ্যা, ৭১। বঙ্গবন্ধু আমাদের দিয়েছেন মহান ৭১। বিনিময়ে আমরা তাঁকে দিয়েছি রক্তমাখা ১৫ আগস্ট। বাহ্ বাহ্, সত্যিকার প্রতিদান বটে। তাঁর পরিবারের অন্যান্য সদস্যের সাথে সাথে দশ বছরের শিশু পুত্র শেখ রাসেলও আমাদের ঘৃণ্য হাত থেকে রেহাই পায় নি। ১৫ আগস্ট নিশ্চয়ই এই হতভাগা জাতির জন্য এক অভিশাপের নাম। সেদিনের পর থেকে এই দেশে, এই বাংলাদেশে যত শিশুর জন্ম হয়েছে নিশ্চয়ই তাদের আতুর গন্ধের সাথে মিশে আছে বারুদের ঝাঁঝাল গন্ধ। এই গন্ধ ঘৃণার, এই গন্ধ রোষের, এই গন্ধ প্রতিশোধের। চল্লিশটি বছর পার হয়ে গেছে অথচ আমরা এখনও এই হত্যার পরিপূর্ণ বিচার পাইনি। যারা এই অতি জঘন্যতম নিকৃষ্ট হত্যাকাণ্ডটি ঘটিয়েছে তারা কি কোনো মানুষের সন্তান ? তারা কি কারো পিতা? তারা কি কোনো ধর্মের? আমার কাছে ওদের পরিচয় একটাই। ওরা ঘৃণ্য অপরাধী, ওরা হায়না, ওরা নিকৃষ্ট শয়তান।

আমরা যারা পঁচাত্তর পরবর্তী প্রজন্ম। আজ বাঙালি জাতি তথা বিশ্ব বিবেকের কাছে আমাদের প্রশ্ন- আমরা কি এই অন্যায়ের সুষ্ঠ বিচার পাবো না? একটি বিচারের জন্য আজ থমকে আছে ষোল কোটি মানুষের ভাগ্য। একজন নিরাপরাধ মানুষ হত্যা মানে কি গোটা বিশ্ববাসীর মৃত্যু নয়? আজ দেশের আপামর জনগণ এই হত্যার বিচার চায়। কী অপরাধ ছিলো বঙ্গবন্ধু এবং তাঁর পরিবারের? কী দোষ ছিলো দশ বছরের শিশু শেখ রাসেলের ? বিশ্ব-বিবেক, তুমি আর কবে তোমার বিচার দেখাবে, কবে?

যতদিন পর্যন্ত এই নিকৃষ্ট খুনিদের বিচার কাজ সমাপ্ত না হবে, ততদিন এই বাংলা প্রকৃতির শাপ থেকে মুক্ত হতে পারবে না। যতদিন পর্যন্ত সকল রাজনৈতিক দল তাদের সকল ভেদাভেদ ভুলে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে এক আসনে আনতে না পারবে, ততদিন এই দেশের রাজনীতিতে সুস্থ পরিবেশ আসবে না, আসতে পারে না।

শোকের এই মাসে, বঙ্গবন্ধুকে শ্রদ্ধা জানাতে, তাঁকে স্মরণ করতে, পথে-ঘাটে, রেডিও-টিভিতে, বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালিত হয়। আমরা কতটুকু ধৈর্য নিয়ে তাঁর মহত্বের কথা শুনি? না জেনে না বুঝে আদিম যুগের বর্বরদের মতো বলি, এত বাড়াবাড়ি কেন? আমাদের উপলব্ধি আর কবে হবে? যে জাতি তার পিতাকে যথাযথ সম্মান করতে পারে না সে কীভাবে বিশ্ব দরবারে সম্মান পাবে? মূর্খের দল চায়ের দোকানে বসে পান চিবোতে চিবোতে মুখে যা না আসে তাও বলে ফেলে। বলি, পশুর কী উপলব্ধি আছে? নেই। উপলব্ধি নেই বলেই তো তারা মানুষ থেকে আলাদা। যে মানুষের মধ্যে কোনো উপলব্ধি নেই তাকে পশু থেকে কী করে আলাদা করবো। তারা তো স্বাধীনতার মানেই বোঝে না ! আমার মতে এই দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ যদি নয় মাসে সমাপ্ত না হয়ে নব্বই বছর ধরে চলতো তাহলে কিছুটা হলেও হয়তো স্বাধীনতার সুখ কী তা তারা উপলব্ধি করতে পারতো। এত দ্রুত এত বড় প্রাপ্তি ! সহজে কি সহ্য হয়?

একটি বর্ষা, একটি শীতের কষ্ট শেষ হওয়ার আগেই এই জাতির হাতে স্বাধীনতার সনদ এসে গেছে। আমার কাছে একটি শীত, একটি বর্ষা তো পিকনিকে যাওয়ার আনন্দের মতোই। এক নিমিশেই শেষ হয়ে যায়। যদি ফিলিস্তিনিদের মতো হতো? বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ যুদ্ধ বেঁধে থাকতো। হায় খোদা! তুমি নিশ্চয়ই আমাদের উপর রহমত বর্ষণ করেছো। আমাদের দেশের জন্য এমন এক নেতার জন্ম দিয়েছ। যার হাত ধরে মাত্র নয় মাসেই স্বাধীনতা এসে গেছে ! তুমি আমাদের উপর নিশ্চয়ই বড় মেহেরবান।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে একটি যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশের দায়িত্ব তিনি নিজের কাঁধে নিয়েছেন। পরিকল্পনা করেছেন কী ভাবে এই দেশকে একটি উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করা যায়? তখন তাঁর এই মহতি উদ্যোগে খুব বেশি কেউ সাড়া দেয়নি। দেশে তখন নাই-নাই খাই-খাই অবস্থা। ত্রিশ লক্ষ শহীদ আর অগণিত মা বোনের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলার প্রতিদান এলো প্রকৃতির হাত ধরে। ছড়িয়ে পড়লো প্রাকৃতিক দুর্ভিক্ষ। এত কিছুর পরেও তিনি ছিলেন অটল-অবিচল। শুরু হলো সংবিধানের কাজ, আইন প্রণয়নের কাজ। বাংলাদেশ কে একটি স্বনির্ভর রাষ্ট্রে পরিণত করার লক্ষ্যে তিনি শুরু করলেন বিভিন্ন উদ্যোগ। দেশের চাকা ধীরে ধীরে সচল হতে শুরু করলো।

কতো সাদামাটা ছিলো তাঁর জীবন! প্রথমে তিনি এই দেশের প্রেসিডেন্ট পরবর্তিতে প্রধানমন্ত্রী অথচ তাঁর মানসিকতা ছিলো কত বন্ধুপরায়ণ ! কৃষক-মজুর সকলকেই তিনি যখন-তখন বুকে জড়িয়ে আলিঙ্গন করতে পারতেন। তারমধ্যে কোনো অহংকার ছিলো না। মানুষে মানুষে তিনি কেনো ভেদাভেদ খুঁজে পেতেন না। তাইতো এই রাষ্ট্রকে তিনি করলেন ধর্ম নিরপেক্ষ একটি রাষ্ট্র। এখানে ধর্ম যার যার দেশ সবার।

একটি জনপদের জন্য, একটি দেশের জন্য, বঙ্গবন্ধুর মতো একজন নেতা জন্ম নিতে কত-শত বছর লেগে যায়। ক’জন বুঝতে পারে? কত ইবাদত, কত পূণ্যির বদলে। কত স্বপ্নের ক্ষেতে চোখের জলের সেচ দিয়ে জন্ম হয়েছিলো তাঁর। তিনি এসেছিলেন আমার, আমাদের, তথা গোটা জাতির পিতা হয়ে। তাঁর কাছ থেকে কতো কিছু শেখার ছিলো, কত কিছু পাওয়ার ছিলো। হায় ! মাত্র পঞ্চান্ন বছরের স্বল্প জীবনের মধ্যে বারোটি বছর জেলখানার চার দেয়ালের মধ্যেই তিনি কাটিয়ে দিয়েছেন। কতো বঞ্চনা, কতো গঞ্জনা যে তাঁকে সইতে হয়েছে তা আর কয়টা পৃষ্ঠায় লিখা যাবে? এই জাতির ভাগ্যের জন্য নিজের জীবনকে তিনি হাতের মুঠোয় নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। তিনি জানতেন, যে কোনো মুহূর্তে তার জীবনের সমাপ্তি ছায়া নেমে আসতে পারে। তবুও বক্ষ উঁচু করেই তিনি চলেছেন। অস্ত্রের মুখে পড়ে, অর্থের মুখে পড়ে কখনও তিনি মাথা নত করেন নি। কত প্রকারের প্রলোভন তাকে দেখানো হয়েছে ! কিন্তু না, তিনি জাতির পিতা। বাঙালি জাতির কথা ভেবে তিনি সব কিছু সম্বরণ করতে পেরেছিলেন। তাইতো দেশ স্বাধীন হবার পরে বিশ্ব নেতাদের সাথে চলেছেন মাথা উঁচু করে। বিশ্ব দরবারে তাঁকে যখন বিভিন্ন সম্মানে ভূষিত করা হচ্ছে তখন সেই পাকিস্তানিরা ঈর্ষায় জ্বলে পুড়ে, পরাজয়ের ক্ষোভে আবার নীল নকশা এঁকেছে। আর এই দেশে যারা তাদের দোসর তারা পাকিস্তানের ডাকে ঠিকই সারা দিয়েছে। তারা কুকুরের বেশে হাড়-হাড্ডি নিয়ে লড়াই করার মতো ক্ষমতা পাবার লোভে এমন জঘন্যতম কাজটি করতে পেরেছে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন একজন সরলমনা মানুষ। এই দেশের মানুষকে তিনি তাঁর নিজের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের মতোই মনে করতেন। তাই কাছে পিঠে সকলের প্রতি ছিলো তাঁর অগাধ বিশ্বাস। তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্র প্রধান, অথচ নিজের দেহ রক্ষার জন্য তেমন কোনো বন্দোবস্তই ছিলো না। তৎকালীন তাঁর যারা উপদেষ্টা ছিলেন তারা কি মহাত্মা গান্ধির মৃত্যুর ইতিহাস জানতেন না ? কেন তারা সেখান থেকে শিক্ষা নেননি ? ফলাফলে যা হবার তাই হলো। আমরা হারালাম আমাদের মহান নেতা। পঙ্গু হয়ে গেলো বাংলাদেশ। চোর হোক আর ডাকাত, তখন যার হাতে অস্ত্র সেই রাজা।

পৃথিবীর ইতিহাসে পিতৃ হত্যার এমন নজির আর আছে কী? শুনেছি আমেরিকান মাফিয়ারাও তাদের শত্রুপক্ষের পরিবারের লোকজনকে মারে না। অথচ রক্তাক্ত ১৫ আগস্টে ঐ হায়নারা একই পরিবারের এতগুলো মানুষকে এক নিমিশেই মেরে ফেললো ! মায়ের আশ্রয়ে থাকতে চায় যে শিশু তাঁকে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে বুকের উপর চালিয়ে দিলো গুলি ! উহ, এ যে কত জঘন্য, কত বিকৃত মানসিকতা !

মাঝে মাঝে সকাল বেলা আমি পুব আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকি। সূর্যটা ধীরে ধীরে উদিত হয়। জাগ্রত স্বপ্ন আমাকে দৃশ্য দেখায়। আসবে সেই দিন, অবশ্যই আসবে একদিন। ১৫ আগস্টে মানুষ একযোগে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। মাথায় থাকবে কালো কাপড়। অশ্রু সিক্ত নয়েনে দলে দলে সবাই হেঁটে যাবে ঐ সূর্যের দিকে। অন্তরের অন্তস্থল থেকে তাঁকে জানাবে বিনম্র সম্মান। বাতাসে ধ্বনিত হবে, জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু। এই একটি আওয়াজ সাগরের প্রবল ঢেউয়ের মতো হয়ে সীমানার কাঁটাতার পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়বে বিশ্ব থেকে মহাবিশ্বে।