নওগাঁর পাকুড়িয়া গণহত্যা দিবস আজ
নওগাঁ প্রতিনিধি : আজ নওগাঁর মান্দা উপজেলার পাকুড়িয়া গ্রামের সেই ভয়াল দিন। একাত্তরের ২৮ অাগস্ট। দিনটি ছিল শনিবার। কাক ডাকা ভোর। এদিন পাকিহানাদার বাহিনী উপজেলার পাকুড়িয়া গ্রামে নারকীয় এক হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। এ হত্যাযজ্ঞে শহীদ হয়েছিলেন, এলাকার ১২৮ জন নিরিহ মুক্তিকামী মানুষ। সেদিন সৌভাগ্যক্রমে বেঁচে গিয়েছিলেন ১৮ জন। তাদের একজন হলেন, মমতাজ উদ্দিন। কোমরে বুলেট নিয়ে আজও তিনি বেঁচে আছেন। বর্তমানে পাকুড়িয়া ইউনাইটেড উচ্চ বিদ্যালয়ে অফিস সহকারির পদে তিনি কর্মরত আছেন। তিনিই জানালেন ঐতিহাসিক গণহত্যা দিবসের বর্বরোতম ট্রাজেডির এ কাহিনী।
মমতাজ উদ্দিন জানান, বাংলা তারিখ মতে দিনটি ছিল ১১ ভাদ্র, শনিবার। কাক ডাকা ভোর। প্রতিদিনের মতো সূর্যোদয়ের প্রত্যাশায় সবেমাত্র ঘুম ভাঙ্গছে গ্রামবাসীর। হঠাৎ গুলির শব্দে ঘুমের ঘোর কাটে তাদের। গ্রামবাসী ঠিক ঠাহর করতে পারেন নি কোথায় এই অশনি সংকেত। গ্রামের স্কুল মাঠের দিকে নয় তো! এরপর আর ফুসরৎ নেই। ততক্ষণে বন্দুকের নল উঁচিয়ে পাকিস্তানি হানাদাররা ঝাঁকে ঝাঁকে ঢুকে পড়েছে গ্রামের ভেতরে।
একটু চালাকি করলেই বুক ভেদ করবে ঘাতকদের বুলেট। নিরুপায় গ্রামবাসি বন্দুকের নলের ইশারায় হাঁটতে থাকে গ্রামের স্কুল মাঠের দিকে। যুবক থেকে বৃদ্ধ প্রায় সকলকেই সমবেত করা হয় সেখানে। তাদের বুঝতে বাঁকী থাকেনা, কি ঘটতে যাচ্ছে আজ। আবেগাপ্লুত কন্ঠে মমতাজ উদ্দিন জানান, মিটিং এর নামে মাঠের সবুজ ঘাসের ওপর সারিবদ্ধভাবে বসানো হয় তাদের। শ্মশানের মতো নিথর মাঠ। হঠাৎ অচেনা ভাষায় গর্জে উঠলো মেজরের কন্ঠ। সঙ্গে সঙ্গে মেশিনগান হাতে মাঠে শুয়ে পড়লো কয়েকজন ঘাতক কমান্ডার। মেজরের নির্দেশের সঙ্গে সঙ্গে গর্জে উঠলো মেশিনগান। চারদিক থেকে নামছিল গুলির বৃষ্টি। নিরিহ মুক্তিকামী মানুষের ওপর ঘাতকদের ব্রাশ ফায়ারে মুহুর্তে রক্তের বন্যায় ভেসে উঠলো মাঠের সবুজ ঘাস। গ্রামের হাছেন আলী, আশরাফুল ইসলাম, আফসার আলী, আফজাল হোসেন ওরা সকলেই পঙ্গুত্ব নিয়ে কালের সাক্ষী হয়ে আজও বেঁচে আছেন। পঙ্গুত্বের সঙ্গে সংগ্রাম করে ইতোমধ্যে শমসের আলী, হেদায়েতুল্লা, জোনাব আলী, মেরুল্যা শাহ, আকন্দি, গাবু পাথর, নসরতুল্যাসহ অনেকেই ইহলোক ত্যাগ করেছেন। সেদিনের হত্যাযজ্ঞে শহীদ হয়েছিলেন নহির উদ্দিন, সাবির উদ্দিন, মসলেম উদ্দিন, ইসমাইল হোসেন, মহির সরদার, আব্বাস আলী, ফজের আলী চৌকিদার, সরুজ মন্ডল, ঝড়– মন্ডল, বজের পাথর, প্রফুল্ল দেওয়ান, মাদার বক্সসহ ১২৮ জন। ঘাতকরা এদিন ফজের চৌকিদারের বিধবা মা বুলন বেওয়াকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছিল। বধ্যভুমির সরকারি একটি ফলক থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। তবে, ফলকে ১২৮ জনের মধ্যে ৭৩ জনের নাম দেখা গেলেও বাকিদের পরিচয়ের কোনো উল্লেখ পাওয়া যায় নি।
বর্বরতম এ হত্যাকাণ্ডে সেদিন পাকিসেনাদের যারা সহযোগিতা করেছিল তাদের অধিকাংশই ছিল দেলুয়াবাড়ি রাজাকার ক্যাম্পের সদস্য। এখনো তাদের নাম প্রকাশ করার সাহস করেন না গ্রামবাসি। তবে সরকারি দায়িত্বশীদের তথ্য দেবেন বলে জানান তারা। শহীদ পরিবারের সন্তানরা জানান, তাদের স্বজন হত্যার বিচার আজ সময়ের দাবি। তারা চান সরকারিভাবে ঘাতকদের সহযোগী রাজাকার সদস্যদের চিহ্নিত করা হোক।
স্বাধীনতার ৪৪ বছর পেরিয়ে গেলেও পাকুড়িয়ার এই শহীদ পল্লীতে সরকারের উল্লেখযোগ্য দৃষ্টি পড়েনি। বধ্যভুমির একপাশে মাত্র কয়েক বর্গফুট গণকবরে এসব শহীদদের সমাধিস্থ করা হয়েছে। স্থানীয় উদ্যোগে গণকবরটি আড়াইফুট উঁচু যেন-তেন একটি ইটের প্রাচীর দিয়ে ঘেরা হয়েছে। জানা গেছে, ১৯৯৬ সালে আওয়ামীলীগ সরকারের সময় শহীদ পরিবারের সদস্যরা শুধুমাত্র একবার ৫ হাজার টাকা করে অনুদান পেয়েছিলেন। এটিই তাদের প্রথম ও শেষ পাওয়া। শহীদ পরিবারের সদস্যরা অভিযোগ করেন, স্বামী-সন্তান হারিয়ে গ্রামের অনেক বিধবা নারী এখনও ভিক্ষাবৃত্তি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। ভিক্ষাবৃত্তি করতে করতেই শহীদ জননী ওকিনা বেওয়াসহ আরো অনেকে ইহলোক ত্যাগ করেছেন।
দিনটিকে স্মরণ করতে প্রতিবছর শহীদ পরিবার কল্যাণ ব্যবস্থাপনা কমিটির সদস্যরা বাড়ি বাড়ি চাঁদা তুলে এ বধ্যভূমিতে তাদের প্রিয় স্বজনদের স্মরণে দোয়া ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করে থাকেন। এরই ধারাবাহিকতায় আজ শুক্রবার বধ্যভুমি সংলগ্ন বিদ্যালয় মাঠে আলোচনা সভা ও মিলাদ মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে। প্রতিবছর আলোচনা সভায় শহীদদের স্মৃতি রক্ষায় সেখানে একটি স্মৃতি সৌধ নির্মাণ ও শহীদ পরিবারগুলোকে মুক্তিযোদ্ধা পরিবার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার দাবি জানানো হয়। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধা কোঠায় ছেলে-মেয়েদের চাকরির দাবিও জানিয়ে আসছেন শহীদ পরিবারের সদস্যরা। কিন্তু আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি। স্থানীয় এমপি বর্তমানে সরকারের মন্ত্রী পরিষদের অন্যতম একজন সদস্য হলেও এই বধ্যভূমির ব্যপারে তাঁর কোন আগ্রহ আর নেই বলেই দাবী করলেন এলাকাবাসী।
ঐতিহাসিক পাকুড়িয়া বধ্যভূমিতে ‘শহীদ স্মৃতি কমপ্লেক্স’ ও গবেষণাগার তৈরি করা হোক এ দাবি এখন এলাকাবাসীর।
(বিএম/পি/অাগস্ট ২৭, ২০১৫)