বদরুল হায়দার

দশক ফুরালেই কবিতা হয়ে ওঠে নতুন। প্রাকৃতিক বিবর্তন, আধুনিকায়ন ও প্রযুক্তির ব্যাপকতর ব্যবহারের প্রভাব কবির চেতনার স্তর স্পর্শ করে। ফলে পরিবর্তন পরিবর্ধনের ভাব, ভাষা, ছন্দ, উপমা সার্বিকভাবে পরিবর্তিত হয়ে নতুন ধ্যান ধারণায় পরিণত হয়। কবিতা হচ্ছে- কবির নিজস্ব ভাষা ভঙ্গীর আত্মীক দলিল। সমর চক্রবর্তী এ ধারায় ৯০ দশকের কাব্যসত্ত্বা। অতি অল্প বয়সেই তার কাব্য প্রতিভার প্রকাশ ঘটে। ছড়া গল্প নিয়ে শুরু করলেও সমর চক্রবর্তী মূলত:কবি। চিরায়ত আধুনিক কাব্যকলার প্রকাশভঙ্গী তাঁর কবিতায় রয়েছে সচেতন ও আন্তরিকভাবে।
সমর চক্রবর্তী ৯০ দশকে ঢাকার কাব্য জগতে পরিচিতি লাভ করলেও শৈশবই বৃহত্তর ফরিদপুর, পার্শ্ববর্তী খুলনা বিভাগের বিভিন্ন জেলা এবং কলকাতায় কবি হিসেবে সমর চক্রবর্তী বহুলালোচিত। ৯০ দশকের কাব্য জগতের অভ্যন্তরে বসবাস করেও সমরের কবিতা সময় অতিক্রম করেছেন শুরু থেকে। আবেগের বেগে কবি ভ্রমণ করে আনন্দলোকে। স্বভাবজাত কবিতার সঙ্গী সমর চক্রবর্তীর ইতিপূর্বে ৬টি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। দিগন্তের স্বপ্নারোহী কাব্যগ্রন্থ তাঁর ৭ম কাব্যগ্রন্থ।

দশকের গন্ডিবদ্ধতা তাকে কখনো স্পর্শ করতে পারেনি। ভুবনজয়ী স্বপ্নচারী হয়ে সমর চক্রবর্তী নিজেকে তৈরী করেছে- স্বপ্নীল মানুষ। আবেগের উৎকন্ঠা, নীরিক্ষা প্রবণতা দিয়ে জীবনের উত্তর খোঁজেন শত প্রশ্নে।

দ্বিধা-দ্বন্দ্ব, বৈপরিত্য ও মিলনের আকাংখা তাকে নানাভাবে তাড়া করে। ফলে তাঁর কবিতায় পাঠক কবির সত্ত্বার স্পর্শ পায়। কবি ও কবিতার গভীরে প্রবেশ করতে পারে।

"আমি সময়ের পাশে নীরব এক ফুলগাছ; বহুবর্ণের মধ্যে স্ববর্ণ হয়ে দীর্ঘ জীবন ফুটে আছি"

নব্বইয়ের কাব্য ধারার চলমান গতির যে চাকা ঘুরছে সেই গতিশীল পরিমন্ডলে সমর চক্রবর্তীর
কবিতায় চিরায়ত কাব্য স্বভাব রয়েছে প্রত্যক্ষভাবে। জাগতিক জীবনের চরম অনুভূতির পরম সত্ত্বাকে লালন করে তাঁর কবিতা হয়ে উঠে নিজস্বতায়।

"আমি যতই হাঁটি বেড়ে যায় পথ"
অতি আবেগের গভীরে তাঁর কাব্য ভ্রমণ হলেও ইতিহাস, ঐতিহ্য ও বিশ্ব জাগতিক আকুতি রয়েছে প্রচ্ছন্নভাবে। যেখানে কবি ও কবিতার প্রকৃতি রহস্য খুঁজে পাওয়া যাবে।

"না, কিছুতেই স্থির নয় উচাটন মন, এই যে দ্রোহ, প্রেম, হাহাকার প্রতিদিন অস্থিরও নয়, সরল সে জল"

জীবনবাদী অনুভূতির কারণে সমর চক্রবর্তী নানাবিদ অনুসঙ্গ প্রসঙ্গকে উপমা উৎপেক্ষায় ব্যবহার করেছেন। যেখানে সমকালীন অন্যসব কবিও কবিতা থেকে তাঁকে আলাদাভাবে শনাক্ত করা যায়।
সমর চক্রবর্তীর রক্তমজ্জায় কবিতা রয়েছে। জন্মগত স্বভাবজাত কবিতাসত্তার স্ফুরণ রয়েছে তাঁর কবিতায়। দ্বিধা দ্বন্দ্বের মধ্যে প্রেম-বিরহ, আশা-হতাশার সামগ্রিক উপাদান রয়েছে কবিত্ব শক্তিতে।

"ত্রিশ বছর পর মনে হয় যেন গতকালেই মুখোমুখি আমি আর কাকলি মজুমদার"

মূলতঃ দিগন্তের স্বপ্নারোহী কাব্যগ্রন্থটি প্রেম-প্রকৃতি,নিসর্গ ও নির্জনতার দ্বান্দ্বিক স্বপ্নের অভিঘাত ।

"জানতো সময়েরই ভগ্নাংশ, অবশিষ্ট এক ভারী পারদ, পাথর, শূণ্যে ওড়ে না"

বাঙালি জীবনের অদেখা সুন্দর আর আগুন ছোঁয়া দুঃখ দু'টিকেই স্পর্শ করেছেন- প্রকৃতি প্রেমিকের চরিত্রে। নষ্টালজিয়া ও হৃদয়ভূমির আবেগ- তাঁর কবিতার অভ্যন্তরে সয়ংক্রিয়ভাবে উপস্থিত।

সমর চক্রবর্তীর দিগন্তের স্বপ্নারোহী কাব্যগ্রন্থটি অধিকাংশ পংক্তিতেই আবেগ ও বিবকের প্রশ্নউত্তর খেলা করে নিজস্ব ভাষায়। যদিও সামগ্রিক মননের ভেতর থেকে উঠে আসে পরম্পরার দৃশ্যাবলী। শিরোনাম কাব্যগ্রন্থে তা ফুটে ওঠে বোধের গভীরে-

"পাখিময় মনবৃন্তের ফুল ঊড়ে যায়- অশ্রুবিন্দুর রেখা ধরে
স্বপ্নরেখার উপর গড়িয়ে গড়িয়ে কোন দিগন্ত হারায়?"

স্বপ্নচারীতা দিগন্ত প্রসারী মনযানে ভ্রমণ করে নিঃশেষ হয়ে যায়। যেখানে প্রেম ও পুজারী একসাথে অবস্থান করে। শূণ্যভ্রমণের পূর্ণতায় দিগন্তে হারিয়ে ফেলে আত্মকথন-

"সহসাই বোধ হয়, অনির্দেশিত ভ্রমণের কোনো গন্তব্য থাকতে নেই"

বিনয় আকুতি ও পরমসহিষনুতা তাঁর কবিতায় পরম ও চরমভাবে পরিব্যপ্ত। যা সত্য সুন্দর আনন্দে নানাভাবে হৃদয়ে দোলা দেয়। সবুজ প্রকৃতির নির্জনতায় নিরবিচ্ছিন্ন পরম শান্তির গভীরে তার প্রাণের অফুরাণ সুখ দুঃখকে কবিতায় স্থাপন করে আবেগ ও বিবেকের সচেতনতায়।

"আকাংখাগুলো ফুটে থাকে যেন রাতের নীরব তারা"

গভীর অনুগামী অনুসন্ধানী এক রৈখিক অভিন্নতা তাঁর কবিতাকে করেছে সমকালীন থেকে আলাদা। কবির জীবনাচারের চলন বলন ধ্যান, জ্ঞান ও অভিজ্ঞান সব মিলিয়ে ফলবতী হৃদয়ের অবারিত উদ্যান, মোহগ্রস্থ মিলনের সমতা ও দ্বন্দ্ব একইবৃত্তে অবস্থান করে।

"অকষ্মাৎ দিগন্তের এক স্বপ্নারোহী ব্লাকহোলের গভীর অতল থেকে উঠে আসে"

সমর চক্রবর্তীর কবিতায় স্বপ্ন ও শূণ্যতা ব্যাপকতা পেয়েছে। জাগতিক ক্রোধ ও ঘৃণাকে প্রকাশ করতে গিয়ে প্রেমের দোলাচলে ভেসেছেন স্বাভাবিকতায়। সময়ের ভগ্নাংশ কবিতায় ফুটে উঠেছে স্বার্থকভাবে।

"কখনো কখনো মানুষকে খুব একা হতে হয়
নির্জনতার গভীরে সবকিছু সঁপে দিয়ে
শূণ্য হতে হয় নিজেকে"

দিগন্তের স্বপ্নারোহীর অন্তরে প্রবেশ করে কবি বাস্তবের অভিজ্ঞানকে কবিতায় স্থাপন করে বিশ্ব প্রেমিক হয়ে। যেখানে প্রেমের কাছে সত্য ও সুন্দর একাকার হয়ে যায়। জনজীবনের নিরাবেগ, নিভৃতচারী অনুসন্ধান আপাদপমস্তক লালন করে প্রকৃত প্রেমিক হয়ে। জীবনের লক্ষ্যগুলোর সাথে চেতনাকে এক করতে পেরেছে স্বার্থকভাবে-

"না, কিছুই মনে পড়ে না- মুখস্থ ভাষার সকল বিজ্ঞাপন এখন শুধু আশা হয়ে হাসে, হৃদয় পরবাসে"

বোধের আনন্দ-যন্ত্রণাকে সহজ অনুভূতিতে প্রকাশ করতে গিয়ে সমর চক্রবর্তী প্রেম ও প্রকৃতিকে গভীরভাবে উপলব্ধি করেন। চেতন-অবচেতনে দৃষ্টির সূক্ষ্মতম অনুসন্ধানের আগ্রহী হতে দেখা যায়। স্বপ্নীল সুন্দর সত্য-সম্প্রীতিকে কবিতায় স্বাভাবিকভাবে স্থাপন করে পরমানন্দে।

দিগন্তের স্বপ্নারোহী কাব্যগ্রন্থে কবি সমর চক্রবর্তী কবিতায় ভেসে বেড়ান স্বপ্নচারীতার অবাধ মিলনে-

"পাখিময় মনবৃন্তের ফুল উড়ে যায়- অশ্রুবিন্দুর রেখা ধরে-
স্বপ্নরেখার উপর গড়িয়ে কোন দিগন্তে হারায়..."

তাঁর কাব্যের কবিতাগুলোর ভাব-ভাষা,শিল্প-সৌন্দর্যে নান্দনিক ।কবিতায় ,অসংখ্য অভিজ্ঞতালব্ধ স্মরণযোগ্য পংক্তি,প্রবাদ প্রতীম বাক্য,নতুন শব্দ ভাষার বাক্য নির্মাণ যা বাংলা কবিতার নতুন মেজাজ ।

দিগন্তের স্বপ্নারোহী/সমর চক্রবর্তী
প্রকাশকালঃ একুশে বইমেলা, ফেব্রুয়ারি ২০১৫
প্রকাশঃ কবিতা চর্চা
প্রচ্ছদঃ উত্তম সেন
মূল্যঃ ১০০.০০