শরীয়তপুর প্রতিনিধি: পদ্মার অব্যাহত ভাঙ্গনে পাল্টে যাচ্ছে শরীয়তপুর জেলার মানচিত্র।

উজান থেকে নেমে আসা ঢলের পানি, প্রবল স্রোত ও অতিবর্ষণের কারণে সর্বনাশা পদ্মার ভয়াবহ ভাঙ্গনে ৪ দিনে জেলার ৩টি উপজেলার ৭ ইউনিয়নের অন্তত ২০ গ্রামের কয়েক শত পরিবার গৃহহারা হয়েছে। বিলীন হয়ে গেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ইউপি স্বাস্থ্যকেন্দ্রসহ অনেক স্থাপনা। অনিশ্চিত হয়ে পরেছে শত শত শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ।

পদ্মার ডান তীরে ৬০ কিলোমিটার এলাকায় তীর সংরক্ষণ বাঁধ না দিলে জেলার মূল ভূখন্ডের একটি বিশাল অংশ পদ্মা গর্ভে বিলীন হয়ে যাওয়ার আশংকার কথা বলেছেন স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড।

সরেজমিন পরিদর্শন করে ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, মাত্র ৩ সপ্তাহ থেমে থাকার পরে গত ২৬ আগস্টের পর থেকে শরীয়তপুরের জাজিরা, নড়িয়া ও ভেদরগঞ্জ উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের ২০ গ্রামে ফের শুরু হয়েছে প্রমত্ত পদ্মার সর্বগ্রাসী ভাঙ্গন। গত ৬ দিনে জাজিরার বড়কান্দি, পালেরচর ও কুন্ডেরচর ইউনিয়নের ১০টি গ্রাম, নড়িয়ার চরআত্রা, নওপাড়া ও ঘড়িসার ইউনিয়নের ৭টি গ্রাম এবং ভেদরগঞ্জ উপজেলার চরভাগা ও উত্তর তারাবুনিয়া ইউনিয়নের ৩টি গ্রামের সহস্রাধিক বসত বাড়ি, স্কুল, হাসপাতাল, শত শত একর ফসলী জমি, রাস্তা, মসজিদ, হাট বাজারসহ অসংখ্য স্থাপনা নদী ভাঙ্গনে বিলীন হয়েছে। ভাঙ্গন কবলিত এলাকায় এখনো কোন সরকারি সাহায্য পৌঁছায়নি বলে জানিয়েছেন ক্ষতিগ্রস্তরা।

সরেজমিন দেখা গেছে, বড়কান্দি ইউনিয়ন পরিষদ ভবন ও দেড় শতাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানসহ দুর্গার হাট বাজারের অস্তিত্ব নদী ভাঙ্গনে বিলীন হয়ে গেছে। বড়কান্দি ইউনিয়ন স্বাস্থ্য কেন্দ্রটির একাংশ ও ভাঙ্গনের কবলে পরেছে। এদিকে নড়িয়া উপজেলার ওয়াপদা ও সাধুর বাজার লঞ্চঘাট, চরজুজিরা বড় সমজিদ নদী বক্ষে চলে গেছে। এছারা ভেদরগঞ্জের উত্তর তারাবুনিয়া ৪১নং ছুরিরচর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের দুইটি ভবন ভাঙ্গনের কবলে পরে নদীর ভিতর পরে গেছে। ফলে ৭ শতাধিক শিক্ষার্থী তাদের শিক্ষা কার্যক্রম নিয়ে চরম বিপাকে পরেছে। একই এলাকার তারাবুনিয়া ষ্টেশন বাজারের অর্ধ শতাধিক দোকান ঘরও নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে।

৪১নং ছুরিরচর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয় এর পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী হুমায়রা আক্তার বলেন, “মাত্র ৩ মাস পরে আমাদের স্কুল সমাপনি পরীক্ষা। এসময় আমাদের স্কুলটি নদীতে ভেঙ্গে নিয়ে গেল। এখন আমরা কোথায় ক্লাস করবো আর কিভাবেই পরীক্ষার প্রস্তুতি গ্রহন করবো। আমরা সরকারের কাছে অনুরোধ করবো অতি তাড়াতাড়ি আমাদের একটি নতুন ভবন নির্মান করে দেয়ার জন্য”।

চরআত্রা ইউনিয়নের বেপারী কান্দি ও মুন্সিকান্দি গ্রামের ক্ষতিগ্রস্ত সায়েরা বেগম, দুলু মিয়া বেপারী, মালতি বেগম, সেলিনা আক্তার, মাজেদা বেগম, সম্পা আক্তার, সিদ্দিকুর রহমান সরদার ও পারভিন সুলতানা বলেন, “পদ্মা আমাদের সব কিছু কেড়ে নিয়েছে। আমরা মানুষের ফসলের ক্ষেতে ঘর দরজা ভেঙ্গে জড়ো করে রেখেছি। আমরা শিশু-বৃদ্ধ সকলকে নিয়ে খোলা আকাশের নিচে কোন রকমে বেঁচে রয়েছি। আমাদের কাছে কেউ কোন সহায়তা নিয়ে এখনো আসেনি। আমরা সরকারের কাছে মাথা গোজার একটু ঠাঁই চাই”।

নদী গর্ভে বিলীন হওয়া ছুরিরচর প্রাথমিক বিদ্যালয় পরিদর্শনে গিয়ে শরীয়তপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. মিজানুর রহমান খান বলেন, অধিদপ্তরের সাথে যোগাযোগ করে এবং স্থানীয় জেলা প্রশাসনের সহায়তা নিয়ে দ্রুততম সময়ের মধ্যে ক্ষতিগ্রস্ত বিদ্যালয়ের পাঠ কার্যক্রম চালু করা হবে এবং একটি নতুন ভবন নির্মানেরও ব্যবস্থা করা হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের শরীয়তপুর জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আব্দুল খালেক বলেছেন, পদ্মা নদীর ডান তীর বলে খ্যাত জাজিরার নাওডোবা থেকে গোসাইরহাটের আলাওলপুর পর্যন্ত ৬০ কিলোমিটার এলাকা পদ্মার ভাঙ্গন কবলিত। প্রতি বছর বিভিন্ন দূর্যোগে এই অঞ্চলের বিপুল এলাকা নদী গর্ভে হারিয়ে যাচ্ছে। তীর সংরক্ষণ বাঁধ নির্মান করে ডান তীরকে রক্ষা করা না গেলে অদূর ভবিষ্যতে জেলার মূল ভূখন্ডের একটি বিরাট অংশ জেলার মানচিত্র থেকে বিলুপ্ত হয়ে যাবে।

(কেএনআই/এলপিবি/সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৫)