ডেস্ক রিপোর্ট : প্রেম, দ্রোহ আর মানবতা এই ত্রয়ী অনুভূতির সমন্বিত কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তার সৃজনে আরও উঠে এসেছে বিপ্লব আর সাম্যের উচ্চারণে মানবমুক্তির উদাত্ত আহ্বান। মানুষের চেতনায় আঘাত করে তাকে জাগিয়ে তোলার বিস্ময়কর ক্ষমতার অধিকারী কাজী নজরুল ইসলামের আবির্ভাব দিবস আজ। ১১৫তম নজরুলজয়ন্তী আজ।

জ্যোতির্ময় অসাম্প্রদায়িক বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের লেখনীতে বারবার উচ্চারিত হয়েছে প্রেম, সাম্যমৈত্রী ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের বাণী। বাংলার সাহিত্যাকাশে নজরুলের আবির্ভাবকে বলা যায় অগ্নিবীণা হাতে ধূমকেতুর প্রকাশ।

আজ ১১ জ্যৈষ্ঠ। ১৩০৬ বঙ্গাব্দের (১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে) এই দিনে অবিভক্ত বাংলার পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোলের জামুরিয়া থানাধীন চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম নেন নজরুল। ডাকনামদুখু মিয়া। সে নামের সঙ্গে সুবিচার (!) করতেই হয়তো শৈশবে পিতৃহারা হন নজরুল। এরপর বাধার দুর্লঙ্ঘ্য পর্বত পাড়ি দিতে হয়েছিল তাকে। অতঃপর একদিন সকলকে চমকে দিয়ে বাংলার সাহিত্যাকাশে দৌর্দণ্ড প্রতাপে আত্মপ্রকাশ করেন মহাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈনিক কবি। নজরুলের এ অভ্যুদয় ধূমকেতুর সঙ্গেই তুলনীয় কেবল। বসন্ত নাটক উত্সর্গ করতে গিয়ে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার সম্পর্কে যথার্থই বলেছেন, ‘কাজী নজরুল ইসলাম কল্যাণীয়েষু, আয় চলে আয়রে ধূমকেতু/ আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু, দুর্দিনের এই দুর্গশিরে উড়িয়ে দে তোর বিজয় কেতন। তিনি নিজেও নিজের আত্মপরিচয় তুলে ধরেছিলেন কাব্যছন্দে— ‘আমি চির বিদ্রোহী বীর/ বিশ্ব ছাড়ায়ে উঠিয়াছি একা চির উন্নত শির

কাজী নজরুল ইসলাম শুধু সামাজিক বৈষম্য নয়, ধর্মীয় লিঙ্গভেদের বিরুদ্ধেও লিখেছেন। বাংলা কাব্যে তিনি এক নতুন ধারার জন্ম দেন। এটি হলো ইসলামী সংগীত তথা গজল। তিনি প্রায় তিন হাজার গান রচনা এবং সুর করেছেন; যা নজরুল সংগীত নামে পরিচিত। মধ্যবয়সে তিনি পিক্‌স ডিজিজে আক্রান্ত হন। এর ফলে আমৃত্যু তাকে সাহিত্যকর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন থাকতে হয়। এক সময় তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। ১৯৭২ সালে ২৪ মে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। এ সময় জাতির জনক রষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেন। বাংলা সাহিত্য এবং সংস্কৃতিতে তার বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৭৪ সালের ৯ ডিসেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাকে সম্মানসূচক ডি.লিট উপাধিতে ভূষিত করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমাবর্তনে তাকে এই উপাধি প্রদান করা হয়। একই সালে কবির ছোট ছেলে ও বিখ্যাত গিটারবাদক কাজী অনিরুদ্ধ মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ্যেরও অবনতি হতে শুরু করে। এ বছরের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশ সরকার কবিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদান করে। একই বছরের ২১ ফেব্রুয়ারি দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক পদকএকুশে পদক প্রদান করা হয় তাকে। তত্কালীন প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক জিয়াউর রহমান ঢাকার তত্কালীন পিজি হাসপাতালের ১১৭ নম্বর কেবিনে কবির হাতে এ পদক দিয়ে আসেন। সেখানেই কবির শেষ দিনগুলো কাটে। সে বছরের ২৯ আগস্ট তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তিনি তার কবিতাতেই বলে গিয়েছিলেন- ‘মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই, যেন গোরে থেকে ও মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই। এই ইচ্ছারই বাস্তব প্রতিফলন ঘটিয়ে তাকে সমাহিত করা হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পাশে।

কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, উপন্যাস, শিশুসাহিত্যসহ সাহিত্যের বিচিত্র শাখায় লিখেছেন নজরুল। তবে বাংলা গানে এক নতুন ধারার স্রষ্টা তিনি। সীমিত কর্মজীবনে তিনি তিন হাজারেরও অধিক গান রচনা করেছেন। পৃথিবীর কোনো ভাষায় একক হাতে এত বেশি সংখ্যক গান রচনার উদাহরণ নেই। এসব গানের বড় একটি অংশ তারই সুরারোপিত। তার রচিতচল চল চল, ঊর্ধগগনে বাজে মাদল বাংলাদেশের রণসংগীত। তার কিছু গান জীবদ্দশায় গ্রন্থাকারে সংকলিত হয়েছিল যার মধ্যে রয়েছে গানের মালা, গুলবাগিচা, গীতি শতদল, বুলবুল ইত্যাদি। পরবর্তীকালে আরও গান সংগ্রন্থিত হয়েছে। তবে তিনি প্রায়শ তাত্ক্ষণিকভাবে লিখতেন। এ কারণে অনুমান করা হয় প্রয়োজনীয় সংরক্ষণের অভাবে বহু গান হারিয়ে গেছে। এছাড়া কাজী নজরুল গান রচনাকালে ১৯টি রাগের সৃষ্টি করেন, যা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।

(ওএস/এইচআর/মে ২৫, ২০১৪)